সিবিআই নতুন করে ‘আবিষ্কার’ করলেও প্রাথমিকের দুর্নীতিতে সুপারিশের ভিত্তিতেই যে মেধাবীদের বঞ্চিত করে নিয়োগ হয়েছিল তা ইতোমধ্যেই স্পষ্ট। তবে সেই সুপারিশ কেবলই ‘সুপারিশ’ ছিল না। টাকার বিনিময়েই সুপারিশের তালিকা তৈরি হতো। কুন্তল ঘোষ, বাগদার সেই ‘সৎ’ রঞ্জন, কালীঘাটের কাকুরা কেন্দ্রীয়ভাবে এজেন্টের ভূমিকা পালন করতেন। তারপর সেই তালিকা শিক্ষা মন্ত্রীর হাত ঘুরে মানিক ভট্টাচার্যের কাছে যেত।
সম্প্রতি সিবিআই আদালতে যে নথি জমা দিয়েছে তাতে ২০১৬’র প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে তৎকালীন শাসক তৃণমূলের নেতা, বিধায়ক, মন্ত্রীদের সুপারিশের একটি তালিকা যুক্ত করেছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি, বিকাশ ভবনে তল্লাশি চালিয়ে সেই তালিকা সংক্রান্ত নথি হাতে এসেছিল তদন্তকারী আধিকারিকদের। অবৈধভাবে অযোগ্যদের নাম সুপারিশ করা প্রত্যেকেই তৎকালীন শাসক তৃণমূলের নেতা ছিলেন। পরে তাঁদেরই কয়েকজন বিজেপি-তে যোগ দেন। তালিকায় রয়েছে শুভেন্দু অধিকারির ভাই প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী, তৎকালীন পুলিশের শীর্ষ কর্তা ভারতী ঘোষ। দু’জনেই পরবর্তীতে বিজেপি-তে যোগ দেন। এছাড়াও রয়েছেন মমতাবালা ঠাকুর, ক্যানিংয়ের বাহুবলী বিধায়ক সওকত মোল্লা, বীণা মণ্ডল, নির্মল ঘোষ, প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা, রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, গুলশন মল্লিক। সকলেই এরা তৃণমূলের। আদালতে জমা দেওয়া সেই তালিকায় দেখা গিয়েছে এর মধ্যে সর্বাধিক সুপারিশ এসেছিল বাকুঁড়া থেকে মন্ত্রী হওয়া তৃণমূল নেতা শ্যামল সাঁতরার তরফে। ২২ জনের নাম সুপারিশ করেছিলেন টাকার বিনিময়েই। সেই তৃণমূল নেতা শ্যামল সাঁতরাকেই আবার মুখ্যমন্ত্রী বাকুঁড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান পদে বসিয়েছেন। তবে এটাই পূর্ণাঙ্গ তালিকা নয়। আরও একাধিক রাঘববোয়ালের নাম রয়েছে যাঁরা সুপারিশ পাঠাতেন এজেন্টর মাধ্যমে টাকা তোলার পরে। সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির হাত ঘুরে এমন প্রায় ৩২১ জনের সুপারিশের নামের তালিকা মানিক ভট্টাচার্যের কাছ পাঠানো হয়েছিল। তারমধ্যে প্রায় ১৩০’র বেশি জনের চাকরি হয়েছিল সেই সুপারিশের ভিত্তিতে।
সিবিআইয়ের এই নথি সামনেই শাসক তৃণমূল-বিজেপি দুই শিবিরে অস্বস্তি, বিজেপিও চুপ। তালিকায় দেখা গিয়েছে, দিব্যেন্দু অধিকারি ১১ জনের নাম সুপারিশ করেছিলেন। সিবিআই তদন্তেও স্পষ্ট টাকার বিনিময়েই সুপারিশের চক্র চলেছে। আবার ভারতী ঘোষ ৪ জনের নাম সুপারিশ করেছিলেন। লোকসভায় বিজেপি’র প্রার্থীও হয়েছেন একদা মুখ্যমন্ত্রীকে সরকারি সভায় ‘মা’ বলে সম্বোধন করা এই প্রাক্তন পুলিশ আধিকারিক। ফলে বিজেপি শিবিরও যৌথ সুপারিশের তালিকায় রীতিমতো বিব্রত। এরই মধ্যে বিজেপি’র সাধারণ সম্পাদক জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় সেই তালিকা ফেসবুকে পোস্ট করে এই দুর্নীতিতে ‘কেউ ছাড় পাবে না’ বলে মন্তব্য করার পরেই শুভেন্দু অধিকারীর ভাই দিব্যেন্দু অধিকারী পালটা মামলার চিঠি পাঠান। বিজেপি সূত্রেই জানা গিয়েছে, সেই চিঠিতে সামাজিক মাধ্যমে জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়ের এই পোস্ট মুছ ফেলার জন্য জানানো হয়। না হলে মামলার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। খোদ শুভেন্দু অধিকারীর ভাইয়ের হুঁশিয়ারির পরেই সেই পোস্ট সামাজিক মাধ্যম থেকে ডিলিট করতে বাধ্য হন বিজেপি’র সাধারণ সম্পাদক। বিজেপি’র রাজ্য অফিসের এক পদাধিকারীর কথায়, প্রাথমিকে নিয়োগে তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে বলতে গেলে সতর্ক থেকেই বলতে হবে। কারণ এটা বাস্তব এমন অভিযোগ থাকা বেশ কয়েকজন এখন আমাদের দলেই এসেছে। আসলে তৃণমূলে থাকতে গেলে দুর্নীতি করতেই হতো। তাঁরা সেটা বুঝতে পেরেই তো তৃণমূল ছেড়ে আমাদের দলে এসেছে’।
তবে প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে এর আগে কালীঘাটের কাকুর বিরুদ্ধে ইডি’র চার্জশিটেও এই সুপারিশ চক্রের চেহারা সামনে এসেছিল। ২০১৪’র প্রাইমারি টেটের ৩২৫ জন চাকরিপ্রার্থীর তালিকা যা কুন্তল ঘোষ পাঠিয়েছিলেন সুজয় ভদ্রের কাছে। ৩২৫ জনের মধ্যেই একাধিকজন খালি খাতা জমা দিয়েছিল। তাঁদেরই পাস করিয়ে দেওয়া এবং পরবর্তী নিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য কুন্তল ঘোষ ৩ কোটি ২৫ লক্ষ টাকা তুলেছিল। ৩২৫ জনের সেই তালিকা এরপর মানিক ভট্টাচার্যের কাছে পাঠান কালীঘাটের কাকু ওরফে সুজয় ভদ্র। চার্জশিটে ইডি স্পষ্ট জানায়, অভিষেক ব্যানার্জির বার্তাবাহক হয়েই মানিক ভট্টাচার্যের অফিসে যেতেন সুজয় ভদ্র। ২০১৪’র টেটে ওই ৩২৫ জনকে পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য ঐ চাকরি প্রার্থীদের নথি সুজয় ভদ্র মানিক ভট্টাচার্যের কাছে দিয়েছিলেন, অভিষেক ব্যানার্জির বার্তাবাহক হয়েই।
স্বাধীনতার পরে এরাজ্যের বুকে শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগ দুর্নীতির সবথেকে বড় কেলেঙ্কারি। এর আগে এসএসসি’র শিক্ষক-শিক্ষাকর্মী নিয়োগের সাতটি মামলায় সিবিআই’ তদন্তের নির্দেশ হয়েছে। তদন্ত চলছে। গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি, নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে নিয়োগ দুর্নীতি তদন্তে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে শাসক তৃণমূল।
সুপারিশ এসেছিল তৃণমূলের একাধিক শীর্ষ নেতাদের কাছ থেকে। দক্ষিণ কলকাতার একাধিক বড় নামও রয়েছে। প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে জেরার করে এমন একাধিক বড় নাম আগেই পেয়েছিল সিবিআই, যদিও তদন্ত এখনও সেই অভিমুখে এগোয়নি। সুপারিশের একাধিক নথি হাতে এসেছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের। তাতে মিলেছে পার্থ চ্যাটার্জির ‘রেকমেন্ডশন’র স্বাক্ষরও। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগের সুপারিশে আগের তারিখ দিয়ে সইও রয়েছে।
শুধু ২০১৬ বা ১৪’র প্রাথমিক নিয়োগ নয়, এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতিতেও সুপারিশ গেছিল মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির তরফে। নিয়োগ কমিটির প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহার মাধ্যমেই সেই স্বাক্ষর সংবলিত সুপারিশের তোড়া পৌঁছাতো এসএসসি’র তৎকালীন প্রোগ্রামার সমরজিৎ আচার্যের মাধ্যমে। একটা চক্র হিসাবেই কাজ হয়েছে। এই বৃত্তে আছে একাধিক নাম। পিরামিডের মাথায় পার্থ চ্যাটার্জি থাকলেও, সরকারের শীর্ষমহলের সম্মতি ব্যতিরেকে তিনি কিছু করেননি। প্রাথমিক ছাড়াও নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি, গ্রুপ-সি পদে চাকরির সুপারিশ সংবলিত নথি সিবিআই’র হাতে এসেছে। একেকটি বান্ডিলে কমপক্ষে দেড়শো থেকে দুশোটি এমন সুপারিশ সহ নিয়োগের নথি। প্রতিটিতে পাতায় সই নয়। বান্ডিলের ওপরে আলাদা কাগজে ‘রেকমেন্ডড’ বা ‘অ্যাপ্রুভড’ লিখে সেখানে সই রয়েছে। অন্তত এমন তিনটি বান্ডিলে সই রয়েছে পার্থ চ্যাটার্জির।
Primary School Job Scam
সুপারিশ চক্রের তালিকা দীর্ঘ, বেকায়দায় তৃণমূল-বিজেপি

×
Comments :0