সুরাহার বদলে বাড়ছে জটিলতা, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে চিকিৎসা করাতে নাজেহাল বহু মানুষ। একদিকে কার্ড থাকলেও রোগীকে ভর্তি না নিয়ে ফিরিয়ে দেওয়ার ভুরিভুরি অভিযোগ উঠেছে একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। রোগীর আত্মীয়স্বজনদের অভিযোগ, স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে চিকিৎসা করে বকেয়া অর্থ মেলে না সরকারের থেকে।
রাজ্যের গরিব, মধ্যবিত্তের ভরসা তাই সরকারি হাসপাতালই। কিন্তু গত বছর দশেকে সরকারি হাসপাতালগুলির হাল খারাপ হয়েছে।
হাওড়ার বাসিন্দা স্বপন ব্যানার্জি তাঁর অফিস চলাকালীন বুকে ব্যথা অনুভব করেন। সঙ্গে সঙ্গেই হাওড়া জেলা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। হৃদযন্ত্রের সমস্যা ধরা পড়ে তাঁর। কিন্তু সেখান থেকে তাঁকে রেফার করা হয় আলিপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে। এরপর স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসা করাতে অস্বীকার করে ওই হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। রোগীর কাছে সেই মুহূর্তেই চাওয়া হয় ৬০-৭০ হাজার টাকা। এরপর তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যেতে গেলে পথেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসা হয়নি বাঁকুড়া ওন্দা ব্লকের পার্শ্বলা মণ্ডলেরও। পায়ে যন্ত্রণা হওয়ায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা স্বাস্থ্যসাথী অস্বীকার করে মোটা অংকের টাকা দাবি করে। তাঁর পরিবার অন্যত্র নিয়ে যেতে চাইলেও রোগীকে হাসপাতালে আটকে রাখা হয় বলে অভিযোগ। পরে মারা যান রোগী।
অতি সম্প্রতি এই ধরনের বেশ কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছে রাজ্য স্বাস্থ্য কমিশনও। কমিশনের কাছে অহরহই দায়ের হচ্ছে অভিযোগ। এমনই একটি মামলার প্রসঙ্গে কমিশন জানিয়েছে, জনৈক সন্দীপ দাস কমিশনের কাছে অভিযোগ করেছিলেন তাঁর রোগীর ক্ষেত্রে দু’টি অর্থোপেডিক সার্জারি হয়েছে কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে। একটি সার্জারি হয়েছে রোগীর কোমরে ও অন্যটি হয়েছে পায়ে। একটি অপারেশন স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে করলেও অন্যটিতে ওই হাসপাতাল ১ লক্ষ ৯৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত নিয়েছে। কমিশনের বক্তব্য, এরকম করা যায় না। হাসপাতাল যে অর্থ নিয়েছে তা ফেরত দিতে হবে। অন্যদিকে, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থেকে ১২ হাজার টাকা কেটে নেওয়ার পরেও বালুরঘাটের বাসিন্দা লতিকা মণ্ডলের চিকিৎসার ক্ষেত্রে নেওয়া হয়েছে অতিরিক্ত আরও অর্থ, তবুও হয়নি অপারেশন। এমনই অভিযোগ উঠেছে সেখানে এক হাসপাতালের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে বিক্ষোভও দেখিয়েছেন রোগীর পরিবার।
অর্থাৎ নির্দেশিকাই সার। সাধারণ গরিব মানুষ স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে কতটুকু সুবিধা পাবেন তাই নিয়ে জটিলতা আরও বাড়ছে রাজ্যে। মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবারই বলেন, স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসা না করলে বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল হবে। সেকথার যে কোনও গুরুত্বই নেই, বারবারই তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তাহলে এরকম অন্তঃসারশূন্য নির্দেশিকার অর্থ কি? রাজ্য সরকারের অ্যাডভাইসরিতে বলা হয়েছে বেসরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে ১৯০০-এর কিছু বেশি টি প্যাকেজ দেওয়া আছে। দেখা গেছে অনেক সময়ে প্যাকেজ বহির্ভূত অর্থ দাবি করেছে কিছু কিছু বেসরকারি হাসপাতাল, সেরকম ক্ষেত্রে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কোথায়।
রাজ্যের জেলাগুলিতে দেখা যাচ্ছে শহর ও প্রান্তিক এলাকার বহু মানুষ এখনো স্বাস্থ্যসাথী কার্ড থেকে বঞ্চিত। শুধু তাই নয়, বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ফিরিয়ে দিচ্ছে-এমন অসংখ্য ঘটনা কলকাতা সহ জেলাগুলিতে অহরহ ঘটেছে। বহু অভিযোগ দায়ের হয়েছে স্বাস্থ্য কমিশনে। নির্দেশিকা আরও কড়া হয়েছে, কিন্তু অবস্থা একই থেকে গেছে। বহু রোগীরই পরিজনদের বক্তব্য, এতদিন ধরে যে রোগী ফিরিয়ে দিয়েছে বিভিন্ন হাসপাতাল, তার কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, কটা হাসপাতালের লাইসেন্স ক্যানসেল হয়েছে তার জবাবও তো দিতে হবে প্রশাসনকে।
একদিকে, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ইস্যু করে দিয়ে দায় সারছে সরকার। অন্যদিকে খরচের হিসাব নিয়ে প্রমাদ গুনছে কর্পোরেট হাসপাতালগুলি। দু’পক্ষই ঘোর অন্ধকারে। রাজ্যের বিরোধী দলগুলির কথায়, সোশাল মিডিয়া জুড়ে— ‘আমি স্বাস্থ্যসাথী কার্ড পেয়ে গেলাম’ ধরনের বক্তব্য ও অনেকের ছবি দিয়ে প্রচার চলছে। মুখ্যমন্ত্রী একরতফা প্রচার করে বলে চলেছেন— সবার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড করে দিয়েছি রাজ্যে, গরিব মানুষ বিনা পয়সায় চিকিৎসা পাচ্ছেন। কিন্তু আদৌ কি তাই? প্রশ্ন তুলছেন রাজ্যবাসী। এখনও স্বাস্থ্যসাথী কার্ড নিয়ে গেলে প্রায়শই বলে দেওয়া হয় বেড নেই। প্রশ্ন উঠছে এটা প্যাকেজিং, ব্র্যান্ডিং কৌশল কিনা তা নিয়ে। পুরানো সিস্টেমকে নতুনভাবে চালানোর চেষ্টা- বিমা কোম্পানিগুলিকে টাকা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা।
সিপিআই(এম) সহ বিরোধীদলগুলির বক্তব্য, সাধারণ মানুষকে নিয়ে ছেলেখেলা চলছে। আসলে সরকার দিশাহীন, তাদের প্রকল্পও ধোঁয়াশায় ভরা। শুরু থেকেই স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পকে ঘিরে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। প্রকল্প সরকারের, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই তৃণমূল পার্টি অফিসগুলি সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে।
সম্প্রতি স্বাস্থ্যসাথী নিয়ে ভোগান্তি ও সমস্যা দূর করতে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইউনিট বা (পিএমইউ) গঠনের কথা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। এই ইউনিটই নাকি এবার থেকে শুনবে সমস্যার কথা। ওদিকে আবার স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে অস্থিরোগ বা অর্থোপেডিক চিকিৎসা নিয়ে কিছু কড়াকড়ির কথাও ঘোষিত হয়েছে স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফে। নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, পথ দুর্ঘটনা ছাড়া যে কোনও অর্থোপেডিক সমস্যায় বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে চিকিৎসা করতে গেলে সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকের চিঠি লাগবে। চিকিৎসক কারণ উল্লেখ করে চিঠি দিয়ে রেফার করলে তবেই বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পে চিকিৎসা করা যাবে। এই নির্দেশিকা জারির পরেও তৈরি হয়েছে আরও একপ্রস্থ ধোঁয়াশা ও জটিলতা।
Swashthya Sathi
স্বাস্থ্যসাথীতে চিকিৎসা হচ্ছে না বেসরকারি হাসপাতালে
×
Comments :0