‘দিন বদলের জন্য রাত দখল। বদল চাই রাজ্যে চলতে থাকা সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্থার।’ বৃহস্পতিবার সিপিআই(এম) রাজ্য সদর দপ্তর মুজফফর আহমেদ ভবনে সাংবাদিক সম্মেলনে একথা বলেন সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীনাক্ষী মুখার্জি।
বৃহস্পতিবারের সাংবাদিক সম্মেলন থেকে রাজ্যের নারী নিরাপত্তা সহ একাধিক বিষয় নিয়ে রাজ্য সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মীনাক্ষী মুখার্জি। সেলিম বলেন, ‘‘গত বছর ১৪ আগস্ট তৃণমূলের গুন্ডা বাহিনী এবং পুলিশ মিলে আরজি কর হাসপাতালে হামলা চালায়। তারপর মীনাক্ষী সহ আরও অনেকে নোটিশ দেওয়া হয়। মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন এসএফআই ডিওয়াইএফআই কর্মীরা এই হামলা করেছে। ভাঙচুর করেছে। সেই বিষয়ের কোন তদন্ত হয়নি। আমরা ছবি দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে ছিলাম কারা সেদিন হালমা করেছিল। কলকাতা পুলিশ এখনও তাদের ধরতে পারেনি। যারা অপরাধ করেছিল তারা সেদিন রাতে হামলা করেছিল আরজি করে।’’
মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, ‘‘আজকে মেয়েদের রাত দখল। যাদের মানুষের অধিকার রক্ষা করার কথা ছিল তারা চুপ ছিল। সেই কারণ রাজ্যে একের পর এক অপরাধের ঘটনা ঘটেছে মহিলাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু একজন অপরাধীকেও ধরা হয়নি, আসলে এই ঘটনা গুলোর সাথে যারা যুক্ত তারা সরকারের সাথে কোন না কোন ভাবে যুক্ত রয়েছে। হয় তারা প্রশাসনের মাথায়, না হলে দলের লোক।’’
তিনি বলেন, ‘‘মানুষ হিসাবে মেয়েদের বেঁচে থাকার অধিকার আজ রাজ্যে প্রশ্নের মুখে। এই সরকার কোন তথ্য সামনে আনে না। কারণ জানে তাদের প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে মানুষের কাছে।’’
মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, ‘‘আজ গোটা রাজ্য জুড়ে সাধারণ মানুষ, মেয়েরা নিজেদের অধিকারের জন্য রাত দখলের আহ্বান জানিয়েছে। আজকে পশ্চিমবঙ্গ গোটা ভারতে বিজেপি শাসিত রাজ্য গুলোকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে মেয়েদের ওপর অত্যাচার এবং নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে। যেই রাজ্য নারী নিরাপত্তায় প্রথমে থাকতো আজ সেই রাজ্যে নারী নিরাপত্তা প্রশ্নের মুখে। বিজেপি শাসিত রাজ্য গুলোকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছনে ফেলছে পশ্চিমবঙ্গ মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের প্রশ্নে।’’
এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে সিপিআই(এম) নেতৃত্বের পক্ষ থেকে তথ্য দিয়ে দেখানো হয়, রাজ্যে বাল্য বিবাহের হার সব থেকে বেশি। রাজ্যের বাল্য বিবাহের হার ৪১.৬%। দ্বিতীয় স্থানে আছে বিহার, সেখানে বাল্য বিবাহের হার ৪০.৮ %। বাল্য বিবাহের সব থেকে কম বাম শাসিত কেরালায়। সেখানে বাল্য বিবাহের হার ৬.৩%।
পণ সংক্রান্ত হত্যার ঘটনায় চতুর্থ স্থানে পশ্চিমবঙ্গ। এনসিআরবি তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে রাজ্যে পণ সংক্রান্ত হত্যার ঘটনা ৬৩৭। শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ, ২০২২ সালে সেখানে পণ সংক্রান্ত হত্যার ঘটনা ২২১৮, বিহারে ১০৩৮। মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকারের সময় পণ প্রথা বন্ধ করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর মনোভাব দেখানো হয়। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে সেই সব হারিয়ে গিয়েছে।’’
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যখন কণ্যাশ্রী প্রকল্পের ১২ তম বর্ষ পালন করছে বৃহস্পতিবার তখন দেখা যাচ্ছে তার সরকারের আমলে মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুট ছাত্রীর হার বেড়েছ। ২০২৩-২৪ সালে রাজ্যে ৭.৮% ছাত্রী মাধ্যমিক স্তরে স্কুলছুট হয়েছে। বার বার রাজ্যের স্কুল গুলোয় ড্রপ আউট নিয়ে সরব থেকেছে বামপন্থী ছাত্র যুবরা। স্কুলছুটের দিক থেকে শীর্ষে বিজেপি শাসিত রাজস্থান। সেখানে স্কুলছুটে ছাত্রীদের হার ১২.৮%, উত্তরপ্রদেশে ১১.৪%। কেরালায় স্কুলছুটের হার সব থেকে কম, ০.৪%।
উল্লেখ্য এনসিআরবি তথ্য অনুযায়ী নারী পাচারের দিক থেকে শীর্ষে এই রাজ্য। তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের রাজ্যে ২০৫৫ গুলো নারী পাচারের ঘটনা ঘটেছে। দ্বিতীয়তে রাজস্থান, তৃতীয়তে মহারাষ্ট্র।
২০২২ সালে রাজ্যে ৫,৮৯২টি নারী ও শিশু অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। শীর্ষে থাকা উত্তরপ্রদেশে ঘটেছে ১৪,২৭৭ গুলো ঘটনা।
ধর্ষণের ক্ষেত্রে শাস্তির হারের দিক থেকেও পিছিয়ে এই রাজ্য। নথিভুক্ত হওয়া অভিযোগের ভিত্তিতে রাজ্যে ধর্ষণের ক্ষেত্রে শাস্তির হার ৩৫.৪%। শীর্ষ রয়েছে গুজরাট। সেখানে শাস্তির হার ৩৯.৮%। এনসিআরবি তথ্য অনুযায়ী কেরালায় ধর্ষণের ক্ষেত্রে শাস্তির হার সব থেকে বেশি। সেখানে শাস্তির হার ৭৬.৪%।
এনসিআরবি তথ্য অনুযায়ী ২০২০ থেকে ২০২৩ এর মধ্যে রাজ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ষণের ঘটনা ২৫। শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ, সেখানে এই সময় ঘটেছে ৪৮টি ঘটনা।
ধর্ষণের ঘটনার নিরিখে ষষ্ট স্থানে আছে এই রাজ্য। রাজ্যের ২,৫১৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে রয়েছে রাজস্থান, সেখানে ঘটেছে ৬,৩৩৭টি ধর্ষণের ঘটনা।
মীনাক্ষী মুখার্জি বলেন, আমাদের লড়াই নতুন একটা সমাজ তৈরি করার জন্য। লড়াই সমাজ বদলের। চলতে থাকা রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই।
তিনি বলেন, ‘‘দোষীদের কেন সাজা হয় না বলেই আরজি কর, কসবার ঘটনা ঘটেছে। সাজা দেওয়ার দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ ৩৫.৪ শতাংশ। গুজরাটের পর পশ্চিমবঙ্গ। কয়েক কোটি মানুষ পথে নেমেছিলেন আ জি করের প্রাতিষ্ঠানিক খুনের বিরুদ্ধে। এরপরও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে কর্মক্ষেত্রে।’’
সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য বলেন, ‘এই রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনাকে প্রেম বলা হয়, বন্ধুর সাথে ঝামেলা বলা হয়। তার সাথে শাসক দলের নেতাদের বিভিন্ন মন্তব্যকে ধর্ষণকে উৎসাহ দিচ্ছে।’
মীনাক্ষী বলেন, ‘গত ১৪ আগস্ট গোটা রাজ্য যখন রাস্তায়। আরজি করের সামনে দেখছি কিছু গুন্ডা ওই এলাকার তারা হাসপাতালে হামলা করছে। পুলিশ পিছনে পালাচ্ছে। ঘন্টাখানেক পর পুলিশ বেরিয়ে আসে। সিসিটিভি ফুটেজ নষ্ট করা হয় সেই ঘটনার। বিচার চেয়েছিল যারা তাদের জেরা করা হলো। কিন্তু যারা গোটা স্বাস্থ্য সিন্ডিকেট চালালো তাদের বিরুদ্ধে কোন কথা নেই। প্রমাণ লোপাট করলো যারা তাদের ধরা হলো না । এদের না ধরলে রাজ্যে নারী নিরাপত্তা আসবে না।’’
মীনাক্ষী প্রশ্ন তোলেন, ‘২০১৮ সালের পর থেকে স্বাস্থ্য দপ্তরের কোন তথ্য আছে? প্রসূতি গর্ভবতীদের নিয়ে কোন তথ্য আছে? কতজন মহিলা সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় মারা গেলেন তা জানতে পারবেন না। স্বাস্থ্য কেন্দ্র গুলোয় গর্ভবতী মহিলাদের কি ঠিক চিকিৎসা হচ্ছে? এর কোন উত্তর নেই।’’
Minakhi Mukherjee
দিন বদলের জন্য রাত দখল : মীনাক্ষী মুখার্জি

×
Comments :0