Samsung

জানকবুল লড়াইয়ে স্যামসাঙের কর্মীরা

উত্তর সম্পাদকীয়​


নীলাদ্রি সেন

দক্ষিণ কোরিয়ার দক্ষ প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর মধ্যে স্যামসাঙ ইলেকট্রনিক্সের নাম খ্যাতির শীর্ষে বলা যেতে পারে। আমাদের দেশে স্যামসাঙের দুটি কারখানা রয়েছে। এর একটি দিল্লির অদুরে উত্তর প্রদেশের আধুনিক শিল্প শহর নয়ডায়। অপরটি তামিলনাডুর রাজধানী চেন্নাই থেকে ৫৬ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে শ্রীপেরেমবুদুরের সাঙ্গুভাচাত্রামে। দক্ষিণ ভারতের এই কারখানাই এখন সিওলে স্যামসাঙের হেডকোয়ার্টারের কর্তাদের কপালের ভাঁজ বাড়িয়ে তুলেছে। 
শ্রীপেরেমবুদুরে স্যামসাঙ তাদের উৎপাদন শুরু করে ২০০৭ সাল থেকে। এই কারখানাতে মূলত টেলিভিসন, এয়ার কন্ডিশনার, রেফ্রিজারেটার ও ওয়াশিং মেশিন তৈরি করা হয়। স্থায়ী অস্থায়ী মিলিয়ে প্রায় দু’হাজার কর্মী রয়েছেন এখানে। স্যামসাঙের মোট মুনাফা বার্ষিক ১২০০ কোটি ডলারের মধ্যে ৩০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ৩৬০ কোটি ডলার মুনাফা আসে শ্রীপেরেমবুদুরের এই কারখানা থেকে। 
উৎপাদন চালু হবার পর থেকে ষোলো বছর এই কারখানাতে কোনও কর্মী ইউনিয়ন গড়ে তোলবার অনুমতি দেয়নি স্যামসাঙ কর্তৃপক্ষ। কর্মী ইউনিয়ন না থাকায় কর্মীদের বেতন ও কাজের সময় নিয়ে স্যামসাঙ কর্তৃপক্ষের বঞ্চনা ক্রমশ বাড়তে থাকে। দিনে প্রায় বারো ঘণ্টা কাজের সময় বেঁধে দেওয়া হয়। নামেই ন’ঘণ্টার দুটি শিফট - সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা ও রাত ৮টা থেকে ভোর ৫টা। নির্ধারিত সময় এটা হলেও কর্মীদের বাধ্য করা হয় সপ্তাহে চার দিন প্রতি শিফটে ন্যূনতম এগারো ঘণ্টা করে কাজ করতে। এরমধ্যে কোনও বিরতি না নিয়ে  চার থেকে পাঁচঘণ্টা একটানা কাজ করতেও বাধ্য করা হয়। কর্মীরাই অভিযোগ করেছেন যে দশ থেকে পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে একটি টেলিভিসন বা ওয়াশিং মেশিন বা রেফ্রিজারেটার অথবা এয়ার কন্ডিশনার তৈরি করে দিতে তাদের ওপরে অসম্ভব চাপ দেয় স্যামসাঙ কর্তৃপক্ষ।
গত বছর ২০২৩ সালে স্যামসাঙের শ্রীপেরেমবুদুর কারখানার কর্মীদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়েছে ৩৫০০ টাকা। ঢালাও মুনাফা হলেও এই বছর ২০২৪ সালে তাকে নামিয়ে আনা হয়েছে মাত্র ২৪০০ টাকাতে। এই কারখানার কাছাকাছি থাকা কোনও কারখানাতে এত কম ইনক্রিমেন্ট দেয় না কর্তৃপক্ষ। স্যামসাঙের বিপুল মুনাফার সঙ্গে কর্মীদের এই বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট কোনোভাবেই সঙ্গতিপূর্ণ নয়। অল্প সংখ্যক স্থায়ী কর্মীদের 'এ', 'বি' ও 'সি' এই তিনটি গ্রেডে ভাগ করে কাজ চলে এই কারখানায়। 'এ' গ্রেডে রয়েছেন হাতে গোনা দশ-পনেরো জন। এদের বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ২৫০০ টাকা। গ্রেড 'বি' ও গ্রেড 'সি'র শ্রমিকরা পান যথাক্রমে বার্ষিক ১০০০ টাকা ও ৯০০ টাকা। নামমাত্র কয়েকজন সর্ব্বোচ্চ ৫০-৫৫ হাজার টাকা বেতন পান। দশ বছর ধরে এই কারখানায় কর্মরতদের মধ্যে অধিকাংশের বেতন ৩০ হাজার টাকার নিচে।
দক্ষিণ ভারতে কারখানা চালুর পর ষোলো বছর  ইউনিয়ন গঠনের কোনও অনুমতি না দিলেও পরিস্থিতির আকস্মিক বদল ঘটে যায়। স্যামসাঙের খোদ চেয়ারম্যান কোটি কোটি টাকার আর্থিক তছরুপে যুক্ত একথা সকলের গোচরে এসে যায়। এরমধ্যে ভারতে অ্যাপল, আমাজনের মতো বহুজাতিক সংস্থায় বেতন বৈষম্য ও শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কর্মীরা ঐক্যবদ্ধভাবে কর্তৃপক্ষের নিষেধকে উড়িয়ে দিয়ে সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে ইউনিয়ন গড়ে তুলেছেন। সিওলের হেডকোয়ার্টারেও স্যামসাঙ কর্তৃপক্ষের বেতন বৈষম্য সহ অন্যান্য কর্মী স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে তিরিশ হাজার কর্মী ‘ন্যাশনাল স্যামসাঙ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’র নেতৃত্বে আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। এইসব ঘটনার অভিঘাতেই গত বছর ২০২৩ সালের জুলাই মাসে শ্রীপেরুমবুদুরে স্যামসাঙ কারখানায় সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে গড়ে তোলা হয় ‘স্যামসাঙ ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’। কারখানার ১৭২৩ জন স্থায়ী কর্মীর মধ্যে ১৫৫০ জন স্বেচ্ছায় সিআইটিইউ ইউনিয়নের সদস্য হন। একই সময়ে সিওলে উন্নততর বেতনের দাবিতে ন্যাশনাল স্যামসাঙ ইলেকট্রনিক্স ইউনিয়ন সংস্থার প্রণয় ৩০ হাজার কর্মচারীকে নিয়ে জোরদার আন্দোলন শুরু করে। শ্রীপেরেমবুদুর কারখানাতে সদ্য গড়ে ওঠা স্যামসাঙ ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সাধারণসভা করে সিওলের আন্দোলনকে সংহতি জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। যদিও কর্তৃপক্ষ সিআইটিইউ অনুমোদিত এই কর্মী ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দেয়নি।
এই বছরের ১১ জুলাই ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষের কাছে দাবিসনদ জমা দেওয়া হয়। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে ২০২৪ থেকে ২০২৬ এই তিন বছরের মধ্যে স্যামসাঙের এই কারখানার কর্মীদের বেতন প্রথম বছর ৭০ শতাংশ, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছর যথাক্রমে ১৫ শতাংশ করে বৃদ্ধি করতে হবে। স্যামসাঙ ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে হবে। শিফটিং অ্যালাওয়েন্স ১৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫০ টাকা করতে হবে। পিতৃত্বকালীন ছুটি তিন দিন থেকে বাড়িয়ে সাতদিন করতে হবে। বার্ষিক সার্ভিস ওয়েটেজ ৫০০ টাকা করতে হবে। কর্মী ইউনিয়নকে যৌথ দর কষাকষির অধিকার দিতে হবে। একই শিক্ষাগত যোগ্যতায় থাকা কর্মীদের সমহারে বেতন প্রদান করতে হবে।
সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে শ্রীপেরেমবুদুর কারখানাতে কর্মী ইউনিয়ন গঠন হওয়াতে বেকায়দায় পড়ে স্যামসাঙ কর্তৃপক্ষ। কর্মীদের ঐক্য ভেঙে দিতে তারা " ওয়ার্কার্স কমিটি " গঠন করে কর্মীদের তাতে যোগ দেবার জন্য চাপ দিতে থাকে। নবগঠিত সিআইটিইউ কর্মী ইউনিয়নের নেতৃত্বকে বদলি এমনকি ছাঁটাইয়ের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়। ১৯২৬ সালের ট্রেড ইউনিয়ন আইন অনুসারে স্যামসাঙ ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেসনের আবেদন করা সত্ত্বেও তাদের আইন নির্দিষ্ট ৪৫ দিনের মধ্যে অনুমোদন দেবার জায়গায় নব্বই দিন পার করে দেওয়া হয়। শ্রম কমিশনারকে হাত করে স্যামসাঙ কর্তৃপক্ষ সিআইটিইউ’র ইউনিয়নের রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত আটকে দেবার চেষ্টা করে। শোনা যায় কর্তৃপক্ষের দালাল ওয়ার্কার্স কমিটিতে যোগ দেবার জন্য কর্মীদের দামি উপহার দেবার টোপ পর্যন্ত দেওয়া হয়, কিন্তু কর্মীদের সচেতন মনোবলের কাছে এই অশুভ চক্র শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হয়।
একাধিকবার বলা সত্ত্বেও স্যামসাঙ কর্তৃপক্ষের ইউনিয়নের দাবিসমুহকে অগ্রাহ্য করবার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের শেষ পথ হিসাবে ৯ সেপ্টেম্বর থেকে স্যামসাঙ ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন শ্রীপেরুমবুদুর কারখানাতে অনির্দিষ্টকালীন ধর্মঘটে যেতে বাধ্য হয়। শিল্প বিরোধ অধিনিয়মের নির্দিষ্ট ধারায় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ধর্মঘটের চোদ্দদিন আগে ১৯ আগস্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঁচ দফা দাবিতে ধর্মঘটের নোটিস দেওয়া হয়। ১৭০০ জন স্থায়ী কর্মীর মধ্যে ১৫০০ জন ন্যায্য অধিকারের দাবিতে কারখানা অচল করে ধর্মঘটে চালিয়ে যান। টেলিভিসন তৈরির কাজে যুক্ত মহিলা কর্মীরাও পরবর্তীকালে এই ধর্মঘটে শামিল হন। সবমিলিয়ে শ্রীপেরেমবুদুরে স্যামসাঙ কর্মীদের সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে এই ধর্মঘট সংগ্রাম স্যামসাঙ কর্তৃপক্ষের ভিত টলিয়ে দিয়েছে। এই সময়টা ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য বিক্রয়ের অত্যন্ত ব্যস্ত সময়। উৎসবের মরশুম। দশেরা, দিওয়ালি, ক্রিসমাস তারপর ইংরেজি নববর্ষ। প্রচুর উৎপাদন করতে হয়। বিক্রিও এইসময় সর্বত্র অনেকটা বেড়ে যায়। এমন সময়ে এই ধর্মঘটের ফলে স্যামসাঙের শ্রীপেরেমবুদুর কারখানাতে ৮০ শতাংশের বেশি উৎপাদন কমে গিয়েছে। এয়ার কন্ডিশনারের ঊৎপাদন ১৩,৮০০ থেকে নেমে এসেছে ৮০০০ ইউনিটে। ওয়াশিং মেশিন উৎপাদন ৩০০০ থেকে নেমে এসেছে ১৪০০ তে। রেফ্রিজারেটার তৈরি ১০,০০০ থেকে নেমে এসেছে মাত্র ৭০০ তে। যেহেতু বিভিন্ন যন্ত্রকে একত্রিত করে টেলিভিসন তৈরি হয় এই কারখানাতে, তাই এই কাজটা শুধুমাত্র হচ্ছে। সস্তা মজুরিতে হাজারখানেক চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের দিয়ে কর্তৃপক্ষ কোনোরকমে উৎপাদনের কাজ টিকিয়ে রাখতে চাইলেও উৎপাদন যে বসে গেছে তা তারা টের পেয়ে গেছে।
তাই এবার নতুন ফন্দি। ধর্মঘটী কর্মীদের বাড়িতে কর্তৃপক্ষের তরফে পাঠানো হচ্ছে "স্ন্যাকস কিট " । তাতে থাকছে বিভিন্ন রকমের ফল আর চকোলেট। পরিবারকে এইসব দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে তারা যেন পরিবারের উপার্জনকারীকে ধর্মঘট থেকে সরিয়ে আনেন। কর্মীদের হোয়াটসঅ্যাপে এখন ধর্মঘট ভাঙতে কর্তৃপক্ষের পাঠানো এইসব খাদ্য সামগ্রীর ছবি প্রচুর পরিমাণে শেয়ার হতে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এত করেও কর্মীদের ধর্মঘটের রাস্তা থেকে এক চুলও সরানো যায়নি। এরমধ্যে ধর্মঘটীরা দাবি জানিয়ে মিছিল করে গ্রেপ্তার হয়েও নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকেন।
শ্রমজীবীর বৃহত্তর ঐক্যের ময়দানে পা রেখেছে শ্রীপেরেমবুদুরের সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে স্যামসাঙ ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের লড়াই। এখন সে আর একা নয়। লড়াইতে ঐক্যের বার্তা এসেছে জে কে টায়ারস, অ্যা পোলো টায়ারস, হুনডাই, ইয়ামাহা ও বিএমডব্ল্যর সিআইটিইউ পরিচালিত অটোমোবাইল শিল্পের কর্মী ইউনিয়নগুলোর কাছ থেকে। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে অ্যাপল-এর উৎপাদন সরবরাহকারী সংস্থা ফ্লেক্সের কারখানার কর্মীরাও ঠিক এভাবেই উন্নত বেতন কাঠামো ও ইউনিয়নের স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। জুনে ফক্সকমের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লিঙ্গ বৈষম্যের অভিযোগ উঠলেও এভাবেই কর্মীদেল ঐক্যবদ্ধ করে সংগ্রাম গড়ে তোলে সিআইটিইউ। 
শ্রীপেরেমবুদুরে স্যামসাঙের কারখানাতে কর্তৃপক্ষ শ্রম আইন ও কারখানা অধিনিয়ম অমান্য করে চরম কর্মী শোষণ করে চলেছে। তার বিরুদ্ধে কর্মী ঐক্য গড়ে তুলে যে প্রতিরোধের লড়াইতে নেমেছে সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে স্যামসাঙ ইন্ডিয়া ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন, তাতে এইসব আন্দোলন সংগ্রামের কথাই বার বার উঠে আসছে। দক্ষিণ ভারতের শ্রমজীবীর জীবন জীবিকার এই লড়াই অচিরেই দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাঙ কর্তাদের হুঁশ ফেরাতে বাধ্য করবে, যা এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা।
 

Comments :0

Login to leave a comment