জীবন-জীবিকার পক্ষে লড়াই তীব্র করতে হবে। সেই সঙ্গে অতি দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াইয়ের সমন্বয় ঘটাতে হবে। অতি দক্ষিণপন্থার বিপদকে প্রতিরোধে কেবল বামপন্থীদের পক্ষেই দ্বিমুখী সংগ্রামের সমন্বয় গড়ে তোলা সম্ভব। মঙ্গলবার ‘গণশক্তি’-র ৫৭ তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে এভাবেই সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য প্রকাশ কারাত।
এদিনের অনুষ্ঠানে আলোচনার বিষয় ছিল ‘দক্ষিণপন্থার বিপদ ও তার প্রতিরোধ’। প্রধান বক্তা ছিলেন কারাত। সভাপতিত্ব করেন প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা এবং বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। বক্তব্য রাখেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, গণশক্তির সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী।
দেশের প্রসঙ্গে কারাত বলেছেন, কেবল এক-দু’জন বৃহৎ পুঁজিপতি নয়। বরং, বৃহৎ পুঁজির মালিক সব অংশই ভারতে উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে মদত জোগাচ্ছে। কারণ বৃহৎ বুর্জোয়া বুঝছে সবচেয়ে বেশি ফায়দা এই সময়েই পাচ্ছে। তাদের পক্ষে হিন্দুত্ববাদী-কর্পোরেট বন্দোবস্ত স্থিতিশীল ব্যবস্থা।
সেলিম তাঁর ভাষণে রাজ্যের পরিস্থিতি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করেন। গ্রামে গ্রামে পদযাত্রা এবং লালঝান্ডার পাশে মানুষের সমবেত হওয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, এরাজ্যে দক্ষিণপন্থার বিপদকে মোকাবিলা করার মতো করেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বামপন্থী আন্দোলন। দক্ষিণপন্থার বিপদ মোকাবিলার দায়িত্ব পালন করবেন বামপন্থীরা।
বিশ্ব পরিস্থিতির নিরিখে দক্ষিণপন্থার বিপদকে ব্যাখ্যা করেছেন কারাত। ভারত প্রসঙ্গে মনে করিয়েছেন বিজেপি আসলে আরএসএস’র রাজনৈতিক মুখ। কিছুদিন আগেও বাংলায় আরএসএস’কে খুঁজে পাওয়া যেত না। ফ্যাসিবাদী হিন্দুরাষ্ট্র গঠন তার লক্ষ্য। প্রতিরোধের লড়াইকে সফল করতে হলে আরএসএস-কে বোঝা জরুরি।
অতি দক্ষিণপন্থার প্রভাব বাড়ল কেন? বিশ্ব পরিস্থিতির নিরিখে কারাতের ব্যাখ্যা, মানুষ হঠাৎ অতি দক্ষিণপন্থী হয়ে পড়েছেন এমন নয়। আর্থ সামাজিক পরিস্থিতিই তার মূলে রয়েছে।
নয়া উদারবাদ মানে লগ্নি পুঁজির একচ্ছত্র শাসন। নয়া উদারবাদ ব্যর্থ হয়েছে, মন্দার কবলে পড়েছে অর্থনীতি। কর্পোরেটের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলিতে বিপুল অঙ্কের ‘বেল আউট’ প্যাকেজ বা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। আর জনগণের জন্য চালু হয়েছে সরকারের ব্যয় সঙ্কোচন। কাজ নেই, থাকলেও বিপজ্জনক। কাজের সুরক্ষা নেই সামাজিক সুরক্ষা নেই। অতি দক্ষিণপন্থা নয়া উদারবাদকে দায়ী করেনি, কোথাও ব্যবস্থাকে দায়ী করেও না। অতি দক্ষিণপন্থা শ্রমজীবীরই অন্য অংশকে শত্রু বানিয়েছে। কাজ চলে যাওয়ার জন্য তাদের দায়ী করা হয়েছে। ইউরোপে চিহ্নিত করা হয়েছে অভিবাসী বা অশ্বেতাঙ্গদের। ভারতে যেমন ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দায়ী করা হচ্ছে।
ইউরোপের দেশে দেশে কেবল উত্থান নয়, অতি দক্ষিণপন্থী এবং নয়া ফাসিবাদী বিভিন্ন দল সরকারে আসীনও হয়েছে। ভোটে পরাজিত হলেও সমাজে, রাজনীতিতে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে। ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানির মতো দেশগুলির উদাহরণ দেন তিনি। কেবল শিল্পোন্নত দেশে নয় ভারত, তুরস্ক, ব্রাজিলের মতো উন্নয়নশীল দেশেও এই শক্তি রাজনীতিতে প্রভাবশালী।
মূল্যবৃদ্ধি, কর্মহীনতার মতো জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে জোর দিয়েছেন কারাত। সেই সঙ্গে বলেছেন, কেবল এই লড়াই অতি দক্ষিণপন্থার বিপদ মোকাবিলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। ভারতে আরএসএস যে জাতীয়তাবাদের প্রচার করে সেখানে ভৌগলিক অঞ্চলের সব মানুষের কথা থাকে না। আরএসএস ধর্মীয় পরিচিতির নিরিখে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রচার করে। হিন্দু স্বাতন্ত্র্যবাদকে জনমনে গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা করে। তার এই আদর্শগত প্রচারের মোকাবিলা করতে পারে বামপন্থীরাই।
ত্রিপুরায় ২০১৮’র নির্বাচনে বিজেপি’র জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দেওয়া ভাষণের উল্লেখ করেন কারাত। মোদী বলেছিলেন, বামপন্থীদের হারিয়ে ত্রিপুরায় সরকার গঠন মতাদর্শগত বিজয়। অন্য ভোটে জয়ের চেয়ে আলাদা। কারাতের মন্তব্য, আরএসএস ভাল বোঝে যে মতাদর্শগত লড়াইয়ে বামপন্থীদের গুরুত্ব কী।
কারাতের আহ্বান, জীবন-জীবিকার লড়াইয়ের সঙ্গে এই মতাদর্শগত লড়াইয়ের সমন্বয় গড়তে হবে। অন্য অ-বামপন্থী দল ‘নরম হিন্দুত্ব’ দিয়ে মোকাবিলা করতে চায়। কিন্তু লাভ হয় না। গুজরাটে যেমন ‘আপ’-র লাভ হয়নি। কিন্তু বামপন্থীরা দ্বিমুখী লড়াই চালাতে পারলে অন্য গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিও সমবেত হতে থাকে।
দিল্লির কৃষক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা তুলেছেন কারাত। ফসলের দামের লড়াই জাত বিভাজনের দেওয়ালেও ধাক্কা দিতে পেরেছে। আবার কৃষকের লড়াইয়ের সমর্থনে জাতীয় স্তরে একযোগে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়নের সংহতি আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক।
Comments :0