SUPERSTITION BLIND FAITH

কুসংস্কার-অন্ধত্ব কাড়ছে প্রাণ,
নীরব তৃণমূল-বিজেপি

রাজ্য

SUPERSTITION BLIND FAITH

প্রতীম দে

পরপর দু’টি ঘটনা দেখেছে বাংলা। সোমবার তিলজলা উত্তাল হয়েছে শিশুহত্যার প্রতিবাদে। নির্মম আচরণের পিছনে ‘তান্ত্রিকের পরামর্শ‘ সামনে এসেছে। রবিবার বীরভূমের আহমেদপুরে পিটিয়ে খুন করা হয়েছে শ্রমজীবী আদিবাসী দম্পতিকে। এসেছে ডাইন অপবাদে পিটিয়ে খুনের অভিযোগ। দেশকে পথ দেখানো রাজ্যের গর্বের পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে পুরনো মোড়লরাজ ফিরে আসার লক্ষণও স্পষ্ট। 

আগে কখনও হয়নি তা নিশ্চয় নয়। কিন্তু কুসংস্কার, বিশেষ করে, যখন মানুষ খুন করার বন্দোবস্ত দেখা যেত, প্রতিহত করার প্রয়াস ছিল সামাজিক স্তরে। রাজনৈতিক আন্দোলনও মুখ ঘুরিয়ে রাখতে চেষ্টা করেনি। বরং দায়িত্ব নিয়েছে সচেতনতা গড়ার। কোথায় সেই উদ্যোগ?

মঙ্গলবার সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম প্রশ্ন তুলেছেন, ‘‘সর্বত্র মুখ্যমন্ত্রীর ছবি দিয়ে এত হোর্ডিং, কুসংস্কার-অন্ধতার বিপক্ষে একটি কথাও কোনও হোর্ডিংয়ে বলা নেই কেন?’’ 

৯ ডিসেম্বর ১৮২৯’তে সতীদাহ প্রথা রদের আইন পাশ। এমনি এমনিই হয়নি। সামাজিক আন্দোলনের ভূমিকা ছিল। কিন্তু আজ ১৯৩ বছর পর সমাজে ফের ধর্মেরনামে কুসংস্কারের বাড়বাড়ন্ত দেখা যাচ্ছে। আগে বলা হতো ভালো নম্বর পেতে গেলে পড়াশোনা করতে হবে। এখন টিভি খুললে, বাসের সিটের গায়ে, ট্রেনের কামরায় দেখা যাচ্ছে জ্যোতিষীরা গ্যারান্টিদিয়ে বলছেন তাঁর দেওয়া আঙটি পরলে, তাঁর দেওয়া মন্ত্র পরীক্ষার আগে মনে মনে বললে, ভালো নম্বর পাওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।

 

ডাইনি সন্দেহে মহিলাকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে। আদিবাসী মহিলার সাথে উচ্চবর্ণের কোন পুরুষের প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়ায় মহিলার বিরুদ্ধে সালিশি সভা বসিয়ে সাজা দেওয়ার ঘটনা সামনে আসছে। 

সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য রামচন্দ্র ডোম তিলজলা এবং আহমেদপুরের দুই ঘটনার তীব্র নিন্দা করেন। তিনি বলেন, ‘‘বীরভূমের এবং তিলজলার ঘটনা পশ্চাৎমুখী প্রবণতা। শাসকের অবৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা এর জন্য দায়ী। আধুনিক যুক্তিবাদী সমাজ তৈরির প্রধান উপাদান হচ্ছে শিক্ষা। কিন্তু আমাদের রাজ্যের এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি নিরক্ষরতা দূর করার বদলে তা বাড়িয়ে দিচ্ছে। যার জন্য এই ধরনের কুসংস্কার আমাদের গিলে খাচ্ছে।’’

প্রবণতা গোটা দেশে রয়েছে। অন্ধত্ব এবং কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অগ্রণী নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারেকে খুন হতে হয়েছে। বস্তুত যুক্তিবাদ, বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচারকদের ‘ধর্মবিরোধী’ দেগে দেওয়া হচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে। প্রধানমন্ত্রী সওয়াল করছেন গণেশ মূর্তি দেখিয়ে, যে বেদের যুগেই প্লাস্টিক সার্জারি চলত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খাপ পঞ্চায়েত’-কে ভারতীয় গণতন্ত্রকের প্রতীক বলে আলোচনাসভার নির্দেশিকা পাঠাচ্ছে ইউজিসি। আর এ রাজ্যে রামনবমীর মিছিলে অস্ত্রত হুঙ্কারের প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি। রাজনৈতিক আবহ সমাজে প্রভাব ফেলছে। 

  

তিলজলায় সন্তান লাভেরআসায় সাত বছর বয়সী নাবালিকাকে খুন করেছে এক ব্যাক্তি। কেন খুন করলেন তিনি? কারণ একজন তান্ত্রিক বিধান দিয়েছেন যে, নবরাত্রির আগে একজন শিশুকে মারলে তবে তাঁর সন্তান লাভের আসা পূরণ হবে।

শুধু রোবোটিক সার্জারি নয়। এখন চিকিৎসা বিজ্ঞান একজন মৃত মানুষের দেহ থেকে বিভিন্ন অঙ্গ নিয়ে অন্য একজন ব্যাক্তি শরীরে তা স্থাপন করে তাঁকে জীবন দান করছে। সমাজ যখন এগিয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা বিজ্ঞান যখন উন্নতি করছে তখন কেন এই কুসংস্কার?

আসল রহস্য লুকিয়ে আছে অন্য দিকে। তা হলো শিক্ষা। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসার না হওয়ার জন্য। বিজ্ঞান চেতনার প্রচার না হওয়ার কারণে সমাজে জ্যোতিষ বিদ্যার নাম করে, তান্ত্রিকদের নিদান জাঁকিয়ে বসছে মানুষের মনে। 

বীরভূমের আহমেদপুরের নোয়াপাড়ায় গরিব ভাগচাষি পান্ডু হেমব্রম ও তাঁর স্ত্রী পার্বতী হেমব্রমকে বাড়ির সামনেই বাঁশ দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাতে খুন করা হয়। গ্রামের আগের মোড়ল রুবই হাঁসদার স্ত্রী দিন কয়েক আগে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সেই মৃত্যুর জন্য দম্পতিকে ডাইন আখ্যা দিয়ে তাদের উপর অত্যাচার শুরু করেছিল বর্তমান মোড়লের দলবল।

এই মোড়ল কারা? গ্রামে মাতব্বর। ২০২৩ সালে গ্রামে মাতব্বর। 

রামচন্দ্র ডোম তিলজলার ঘটনা প্রসঙ্গে বলছেন, ‘‘কসবায় যেই ঘটনা ঘটেছে সেখানে কী শুধুই অন্ধ বিশ্বাস নাকি যৌন কারণ রয়েছে তা তদন্ত করে দেখতে হবে। কারণ অভিযুক্ত শিকার করেছেন নির্যাতনের ঘটনাটি।’’ চিকিৎসক ডোম বলছেন, ‘‘এই কুসংস্কারের মোকাবিলা করার জন্য প্রশাসনের যেমন সতর্ক হতে হবে, ঠিক সেই ভাবে সতর্ক হতে হবে সাধারণ মানুষজনকে। একই সঙ্গে তিনি আরএসএস এবং তৃণমূলের ভুমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘আরএসএস এবং শাসক দল তৃণমূল যেই ভুমিকা পালন করছে তাতে এই সব কুসংস্কারকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। যা উদ্বেগজনক।’’

১৯৭৮ সালের পর থেকে গ্রামে মোড়ল রাজ ছিল না। মানুষের তৈরি করা পঞ্চায়েত মানুষের সমস্যার সমাধান করে এসেছে। কিন্তু শেষ কয়েক বছরে ফের গ্রামে গ্রামে ফিরেছে মোড়ল রাজ। যারা মোড়ল হয়ে গ্রাম শাসন করছেন তাঁরা প্রত্যেকেই প্রায় স্থানীয় তৃণমূল নেতা। 

সেলিম মনে করিয়েছেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে বিজ্ঞান সচেতনতার প্রচার করা হতো। বিজ্ঞান মঞ্চের মতো বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার করত। তৃণমূল এবং বিজেপি এই রাজনৈতিক সামাজিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে।’’ 

আদিবাসী সমাজের উন্নতির জন্য একাধিক সমাজিক প্রকল্প শুরু করেছিল বামফ্রন্ট সরকার। শিক্ষার আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য সাঁওতালি ভাষায় পঠন পাঠন শুরু হয় আদিবাসীদের মধ্যে।  তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে আদিবাসীদের বঞ্চনা শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালের ব্রিগেডের মঞ্চ থেকে সেই বিষয় নিয়ে সরব হয়েছিলেন সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য দেবলীনা হেমব্রম।  

গ্রাফিক্সঃ মনীষ দেব

Comments :0

Login to leave a comment