ত্রিপুরায় গণতন্ত্র ফেরাতে রাজ্যের বিজেপি সরকারকে উৎখাতের ডাক দিল সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী দলগুলি এবং কংগ্রেস। বৃহস্পতিবার আগরতলায় এক যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে রাজ্যের মানুষের কাছে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিন বিধানসভায় বামফ্রন্টভুক্ত দলগুলি এবং কংগ্রেসের নেতারা বৈঠকে বসেন। আসন সমঝোতা নিয়ে এক প্রস্থ কথা হয়েছে বলে নেতারা জানিয়েছেন। আরও আলোচনা হবে। বামফন্টের আহ্বায়ক নারায়ণ কর ছাড়াও সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরি বৈঠকে ছিলেন। বামফ্রন্টের অন্য শরিক দলগুলির রাজ্য সম্পাদকরাও ছিলেন বৈঠকে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বৈঠকে ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বীরজিৎ সিনহা এবং সুদীপ রায় বর্মণ। পরে সাংবাদিক বৈঠকে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস নেতারা ছাড়াও সিপিআই (এম-এল)-র রাজ্য সম্পাদক উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে জীতেন্দ্র চৌধুরি বলেন, বিজেপি সরকারের পাঁচ বছরে রাজ্যবাসীর উপরে যে সামগ্রিক আক্রমণ, তা থেকে ত্রিপুরার মানুষকে উদ্ধার করতে হলে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার জরুরি। আইনের শাসন, সংবিধানের যে নির্দেশিকা সেটা যাতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করা যায়, তারজন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফেরানো অত্যন্ত জরুরি। রাজ্যের এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আজকে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দলগুলি এক জায়গায় উপস্থিত হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচন সংবিধানের মাধ্যমে জনগণের হাতে একটা অস্ত্র। তা প্রয়োগের জন্য আহ্বান জানান তিনি। এর আগেই সাংবাদিক সম্মেলনের সূচনায় কংগ্রেস নেতা সুদীপ রায় বর্মণ বলেন, রাজ্যে গণতন্ত্র আর অবশিষ্ট থাকবে কি না, তা নিশ্চিত নয়। সেই কারণে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক শক্তি এক জায়গায় আসতে বাধ্য হয়েছে। ব্যক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে যারা বিজেপি’র পতন নিশ্চিত করতে চান, তারা সকলে এক জায়গায় আসুন।
জীতেন্দ্র চৌধুরি বলেন, বিজেপি সরকারে আসার পরে রাজ্যে একটিও নির্বাচন অবাধে হয়নি। সন্ত্রাস, ভোট লুট, অবাধে ছাপ্পার নজির দেখেছেন রাজ্যবাসী। তাই নির্বাচনে কমিশনের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ রাজ্যে এলে, তাদের কাছে প্রতিটি রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের দাবি জানানো হয়। তারাও জানিয়ে ছিলেন রাজ্যে হিংসামুক্ত অবাধ শান্তিপূর্ণ ভোট হবে। নির্বাচন কমিশন রাজ্যে ‘জিরো পোল ভায়লেন্স মিশন’ প্রচার শুরু করছে। এর থেকেও প্রমাণ হয় বিরোধীদের অভিযোগের সত্যতা। কিন্তু দেখা গেল, নির্বাচন ঘোষণার দিনই রাজ্যজুড়ে অবাধে তাণ্ডব চালালো বিজেপি। নির্বাচন কমিশনের ঘোষণাকেই চ্যালেঞ্জ করে মন্ত্রীদের নেতৃত্বে বিজেপি অতি উৎসাহে হিংসা করতে নামল। উল্লেখ্য, বুধবার নির্বাচন কমিশনের ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পরেই দেখা গেল, মজলিশপুরে কংগ্রেসের মিছিল আক্রান্ত হলো। কংগ্রেসের সর্বভারতীয় নেতা অজয় কুমার সহ ৩০ জন আক্রান্ত হলেন। রাজনগরের বড়পাথারীতে বিরাট মিছিল, সমাবেশ হলো। তারপর ঘরে ফেরার সময়ে সিপিআই (এম) বিধায়ক সুধন দাসের গাড়ি আক্রান্ত হলো। চার-পাঁচটা গাড়ি ভাঙচুর করল বিজেপি দুষ্কৃতীরা। অনেকে জখম হলেন। কমলপুরে ত্রিপ্রা মথার কর্মীকে খুন করা হলো। তিনি বলেন, কোনও ঘটনাই প্রত্যন্ত অঞ্চলে হয়নি যে পুলিশ পৌঁছতে পারবে না। কমিশনের ঘোষণার পরেও কিভাবে বিরোধী দলের কর্মসূচি আক্রান্ত হচ্ছে সেই প্রশ্ন তোলেন তিনি। জীতেন্দ্র চৌধুরি বলেন, নানা ধরনের কেন্দ্রীয় বাহিনীতে রাজ্য ছেয়ে গেছে। আরও বাহিনী আসছে বলে কমিশন জানিয়েছে। তারপরেও কীভাবে বিজেপি’র মন্ত্রীরা অবাধে হামলার নেতৃত্ব দিচ্ছেন?
এই পরিস্থিতিতে শনিবার ২১ জানুয়ারি মিছিল এবং সিইও-কে ডেপুটেশনের ডাক দেওয়া হয়েছে এদিনের সাংবাদিক বৈঠক থেকে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বীরজিৎ সিনহা জানিয়েছেন, ওই মিছিল হবে নাগরিক সমাজের পক্ষে। কোনও দলীয় পতাকা থাকবে না। ‘আমার ভোট আমার অধিকার’ দাবি তুলে মিছিল হবে। তারপর ডেপুটেশন দেওয়া হবে। জীতেন্দ্র চৌধুরি বলেন, মানুষ যাকে পছন্দ তাঁকে ভোট দিক। কিন্তু নিজের ভোট নিজে দিক এটা নিশ্চিত করতে হবে। তাই ওইদিনের মিছিলে সকলকে আসার জন্য তিনি আহ্বান জানান।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জীতেন্দ্র চৌধুরি বলেছেন, ত্রিপ্রা মথাও এই সমঝোতার মধ্যে আসবে বলে তিনি আশাবাদী। মথার প্রধান প্রদ্যোত বিক্রম কিশোর মাণিক্য দেববর্মণ দিল্লিতে রয়েছেন। তাঁর সঙ্গে এদিন ফোনে কথা হয়েছে জানিয়ে জীতেন্দ্র চৌধুরি বলেন, বিজেপি’র খুনের রাজনীতির হীন চক্রান্তের বিরুদ্ধেই মথা প্রধান মতামত জানিয়েছেন। তিনি সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গেও আছেন বলে জানিয়েছেন। বিজেপি বিরোধী দলগুলির মধ্যে ভোট ভাগাভাগির সুযোগ যাতে শাসক দল না পায়, তিনি তার দলের মধ্যেও সেই চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন। আমরা মথাকে পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী বলেও মন্তব্য করেন জীতেন্দ্র চৌধুরি।
ত্রিপ্রা মথার পৃথক ত্রিপাল্যান্ড দাবির সঙ্গে সহমত কিনা, এই প্রশ্নে জীতেন্দ্র চৌধুরি সিপিআই (এম) সহ বামপন্থীদের অবস্থান স্পষ্ট করে দেন। তিনি বলেন, সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে আমরা ত্রিপুরার আদিবাসীদের যতরকম ক্ষমতায়ন, উন্নয়ন সম্ভব তার পক্ষে। কিন্তু ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে ত্রিপুরায় বিভাজনের বাস্তবতা নেই। তিনি জানান, আমাদের ইশ্তেহারেও আদিবাসীদের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা হবে। কবে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত হবে, মথার জন্য অপেক্ষা করা হবে কি না, এই সব এক গুচ্ছ প্রশ্নের জবাবে সিপিআই (এম) রাজ্য সম্পাদক সহাস্য জবাবে বলেন, বিজেপি’র প্রার্থী ঘোষণার আগে আমরা আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করে প্রার্থী ঘোষণা করে দেব, এইটুকু বলতে পারি।
সিপিআই (এম)-কংগ্রেস কাছাকাছি আসায় বিজেপি’র সুবিধে হবে বলে মনে করছে শাসক দল। এমন এক প্রশ্নের জবাবে কংগ্রেস নেতা সুদীপ রায় বর্মণ বলেন, আমাদের কাছাকাছি আসায় যদি ওদের সুবিধে হয়, ওদের তো খুশি হওয়ার কথা। ওরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে কেন! তিনি বলেন, এই সমঝোতায় শুধু কংগ্রেস বা বামফ্রন্টের কর্মীরা খুশি হয়েছেন, তাই নয়। রাজ্যের মানুষ অত্যন্ত খুশি হয়েছেন।
Comments :0