Shal Forest

গ্রামের সাইকেল ডায়েরি

ফিচার পাতা

খেতমজুর সারাবছর খেতমজুর নন। তবে তিনি আর কী কী? ‘সিভিকবাবু’ কেমন লোক? ‘কন্ট্রোলের চালে সারা মাস চলে না’, তাহলে কিভাবে চলে শিবু মুর্মুর? জঙ্গলে আদিবাসীদেরই তাড়া করছে কে? মজুরি-চোর মাথা তুলেছে কিভাবে? 
মেঠো পথ আর শাল জঙ্গলে এমন অনেক প্রশ্নের ছড়ানো উত্তর কুড়িয়ে এনেছেন মনোজ আচার্য।

কেমন আছে আমার গ্রাম বাংলা,সেখানের মানুষের জীবন-জীবিকা? সেটা জানতে বুঝতেই বন্ধু সোমনাথ মাইতিকে সঙ্গে নিয়ে সাইকেলে পাড়ি দিয়েছিলাম দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির গ্রামে গ্রামে। এই সাইকেল অভিযানের নেপথ্যে আরও একটা কারণ ছিল। আসলে শহর কলকাতার প্রাত্যহিকী বড্ড একঘেয়ে লাগছিল। সবুজের সমারোহ, মেঠো গন্ধমাখা আমার গ্রাম বাংলার মানুষ ,প্রকৃতি দেখার পরিকল্পনা অনেকদিন করছিলাম। সেই মোতাবেক দুর্গা পূজার সময় সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম।
শরৎকাল। এই সময়টা গ্রাম বাংলার প্রকৃতিকে চেখে দেখার স্বাদটাই আলাদা রকমের অনুভূতির। যাইহোক, সাইকেলে চেপে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমানের অনেকগুলি গ্রাম, জনপদ ঘুরে গ্রাম জীবনের বেশ কিছু অভিজ্ঞতা হৃদয়ের ঝুলিতে পুরে ফিরেছিলাম। যদিও সেসব অভিজ্ঞতার সব বর্ণ,শব্দ,বাক্যের ব্যঞ্জনায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তবুও তুলে ধরলাম কিছু কথা। 
পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঘাটাল, চন্দ্রকোনা, রসকুণ্ডু, গড়বেতা হয়ে  বাঁকুড়ার দিকে ছুটছিলাম। দীর্ঘ পথ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পেরিয়ে চলছিলাম। দু’ধারে ঘন জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে পিচের রাস্তা চলে গেছে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার। সবুজের সমারোহে প্রকৃতির সে এক অপূর্ব শোভা। প্রায় জনমানবহীন এই পিচ রাস্তার ধার ঘেঁষে মাঝে মাঝেই জঙ্গলের ভিতরে চলে গেছে সুদীর্ঘ লাল মোড়ামের পথ। এগুলো স্থানীয় গ্রামগুলোতে যাওয়ার রাস্তা। এমনই একটা রাস্তা ধরে আমরা পৌঁছে গেছিলাম কঁড়াশলি গ্রামে। চারিধারে জঙ্গল ঘেরা এই গ্রামকে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। তবে কয়েক যুগ ধরে এখানে আদিবাসী মানুষের বসবাস। রোদে, জলে পুড়ে কালো তামাটে চেহারার মানুষগুলোর চোখে মুখে এক অদ্ভুত জীবনী শক্তি দেখেছি। চাষ-আবাদ নির্ভর জীবিকা নয়, যদিও কিছু আছে, তবে তা খুবই সামান্য। বনজ সম্পদের ওপরেই নির্ভরশীল বেশিরভাগ জীবন। কেন্দু পাতা, শাল পাতা, জঙ্গলের কাঠ, হাঁস, মুরগি, ছাগল, গোরু,শুয়োর এসবই জীবনধারণের পেশাগত অবলম্বন। আলাপ হয়েছিল শিবু মুর্মুর সঙ্গে। বয়স বছর চল্লিশের, তবে অভাব দারিদ্র বয়সকে আরও কয়েক বছর সামনের দিকে নিয়ে ফেলেছে। জঙ্গলের কাঠ, কেন্দু,শাল পাতা সংগ্রহ করেই জীবনধারণ। কয়েক কিমি দূরে ছান্দার বাজারে বন থেকে সংগ্রহ করা পাতা কাঠ বিক্রি করে সংসার প্রতিপালন। জানতে চেয়েছিলাম এতে রোজগার কেমন? উত্তরে জানালো,‘‘ভালো নয় বাবু, তাছাড়া ফরেস্টের লোক এখন জঙ্গলে গেলে তাড়া করে, লুকাই, লুকাই সব করতে হয়।’’ ভাবছিলাম, প্রকৃতির কোলে, প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরে, তাঁর দেওয়া গাছগাছালি, বনজ সম্পদের ওপর নির্ভর করে যে মানুষগুলো কয়েক যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাদের জীবিকায় এভাবে কোপ বসানো হচ্ছে। তবে মানুষগুলির চাহিদা নিতান্তই সামান্য। সেকারণে,ওই সামান্য রোজগার, বনের শাক লতা পাতা, আর পরনের সাদামাটা জামাকাপড়েই তাঁরা সন্তষ্ট। কিন্তু সেটুকুও যে মেলা দুস্কর হচ্ছে। মিলছে কই? শিবু মুর্মুর কথায়,‘‘কন্ট্রোলে চাল দেওয়া হয়, তবে,তাতে ক’দিন চলে!’’ বাস্তবিক, হাড়ভাঙা খাটুনির জীবনে রেশনের দেওয়া চাল পরিমিত নয়। এ বিষয়ে, শিবু মুর্মুর আক্ষেপ,‘‘যে টুকুন দেয় তাতে দিন কতক চলে,পুরা মাস পেট টুকুন ভরে লা।’’ 
সংবাদপত্রে এই জঙ্গলমহলের মানুষগুলোর জন্য অনেক উন্নতি করার সরকারের বড়াইয়ের কথা পড়ে ছিলাম। কিন্তু খবরের কাগজের সে বড়াই, প্রচারের সঙ্গে বাস্তবতার মিল কয়েক যোজন দূর। বন্ধু সোমনাথ তাঁর ক্যা মেরাটি বের করে ছবি তুলছিল। শিবু মুর্মু সন্দিগ্ধ চোখে বলল,‘‘ওই সিভিকবাবুরা নিষেধ করেছে বাইরের অচেনা লোকেদের কাছে হঠাৎ হঠাৎ ইন্টারভিউ না দিতে।’’ যদিও শিবু মুর্মুর ছেলে বললেন,‘‘আসলে মাওবাদীদের জন্যই এটা বারণ করা।’’ ‘সিভিকবাবু’ বলতে, বর্তমানে গ্রামে গ্রামে কিছু সরকারি পোষ্য তৈরি করা হয়েছে। যাদের আমরা সিভিক ভলান্টিয়ার বলে জানি। এরাই বর্তমানে প্রত্যন্ত গাঁয়ের মানুষের কাছে পুলিশ হিসাবে পরিচিত। আতঙ্কের কারণও। প্রত্যন্ত গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলো এদের ভয় করে। বর্তমান সরকার খুবই ছক কষে, প্ল্যান প্রোগ্রামের মধ্যদিয়েই গ্রামগুলিকে কবজা করে যে রেখেছে সেটা বুঝলাম। তবে গ্রামের সহজ সরল জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়াও যে লাগতে শুরু করেছে সেটাও এই অভিযানে বুঝেছি। পার্শ্ববর্তী শহরে কিংবা দেশের বিভিন্ন জায়গায় এই প্রত্যন্ত গ্রামের অনেকেই চাকরি বাকরি করতে যেতে শুরু করেছে। কারণ হিসাবে বুঝেছি, গ্রামে জীবন-জীবিকার দৈন্যদশা। গ্রামের সবুজ বনানীর হাতছানি থেকে জীবিকা সংস্থানের কারণ অনেককেই ভিনদেশী করে দিচ্ছে। 
আটারি গ্রামের তারক সোরেনের ছেলে রঘু সোরেন রাজমিস্ত্রির কাজ শিখতে কলকাতায় গিয়েছিল, বর্তমানে সেখানেই ছেলে বউ নিয়ে থাকে। বুঝলাম গ্রাম ক্রমশ শহরমুখী হচ্ছে। জীবিকার কারণে। গ্রাম বাংলার চিরাচরিত ধারাভাষ্যে বদল আসছে। গাঁয়ের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। কিন্তু, মাঠঘাট,পাহাড়, জঙ্গল,নদী নালায় ঘেরা গ্রাম বাংলার যে ছবি, চিরাচরিত ঐতিহ্য তাকে আধুনিকতার প্রচণ্ড প্রলেপ দিয়ে মুড়ে কি আমাদের ভালো হবে? মাঠ থাকবে, জঙ্গল থাকবে, জমিতে ফসল ফলবে, গাছগাছালি, বনজ সম্পদ এগুলো রক্ষা করে, গাঁয়ের মানুষের জীবন-জীবিকার উন্নতি সাধনের মধ্য দিয়েই তো গ্রাম বাংলাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ইকো সিস্টেমের এই ভাবনা থেকে সরে গেলে  মানুষের বসবাস যোগ্য অনুকূল প্রাকৃতিক পরিস্থিতি আগামীতে থাকবে তো? কর্পোরেটমুখী চিন্তার থাবায় আদতে গ্রাম, গ্রামের মানুষের কি উন্নতি হতে পারে? এই প্রশ্নগুলোই মনে আসছিল। 


শিবু মুর্মুরা হতাশ গলায় বলে চলছেন,‘‘কন্ট্রোলের ওটুকুন চালে সবসময় পেট ভরেনা,বলে চলেন ফরেস্টের লোকেরা তাড়া করেন তাই লুকাই লুকাই জঙ্গলে যাই...।’’ 
কড়াশলি গ্রামের গরিব মানুষের জীবন যন্ত্রণার ছবি হৃদয়ে গেঁথে আবারও সাইকেল নিয়ে দুই বন্ধু ছুটছিলাম।  এবার পৌঁছেছিলাম বাঁকুড়ার রাধানগর গ্রামে। আলাপ হয়েছিল হরিসাধন দাসের সঙ্গে। বিঘে চারেক জমি আছে। তবে সে জমিতে নিজে খরচ জুগিয়ে চাষবাস করতে পারেন না বেশিরভাগ মরশুমে। কারণ,নগদ টাকার অভাব। বুঝলাম,চাষের জন্যে যে পুঁজিটুকু দরকার সে পুঁজিটুকুই নেই গ্রাম বাংলার বেশিরভাগ প্রান্তিক কৃষকদের। সাইকেল অভিযানে গ্রাম বাংলা ঘুরতে ঘুরতে কৃষক জীবনের চরম আর্থিক সঙ্কটের এমনই ধারাভাষ্য  নজরে পড়েছিল। অনেকের সঙ্গে কথা বার্তায় যা বুঝেছি তার সারমর্ম এই— ফসল ফলাতে যা ব্যয় হয় বহু ক্ষেত্রে চাষের খরচের টাকা টুকুও ওঠে না। অনেকেই সুদে টাকা ধার নিয়ে চাষ করে পরে সমস্যায় পড়েছেন। লাভ তো দুরের কথা উপরন্তু সুদে নেওয়া দেনার টাকা শোধ করার দুশ্চিন্তায় একসার দশা। এমনই অভিজ্ঞতার কথা শুনলাম হরিসাধন দাসের থেকেও। গত বছর এক বিঘা জমিতে বরবটি ফলিয়ে ছিলেন। আর বাকি তিন বিঘায় ধান চাষ করেন। তবে, ধানের ফলন ভালো হয়নি। বরবটির ফলন ভালো হয়েছিল। কিন্তু বরবটির বাজার দর যা ছিল তাতে মনমরা হয়ে পড়েছিলেন। ‘‘আড়াইটাকা কিলো দরে সে বরবটি বেচেছি, খরচের টাকাটাও ওঠেনি। এখন তো উচ্চফলনশীল চাষবাস, সার থেকে নানা রকম কীটনাশক না দিলে চলে না,সে সবের যা বাজার দর তাতে একটা বিপুল অঙ্কের খরচ। এত খরচ করে দু’পয়সা লাভের মুখ না দেখলে চাষবাসের ইচ্ছে হয় বলুনতো’’— আক্ষেপের সুরেই কথাগুলো বলে চলেছিলেন হরিসাধন দাস। গত বছর চাষে চরম লোকসান ও দেনার মুখে পড়ে এবছর আর জমিতে নিজে চাষ করেননি হরিসাধন। বিঘা পতি মাত্র তিন হাজার টাকায় চার বিঘা জমি লিজে দিয়ে দিয়েছেন। বললাম তার মানে এই চারবিঘা জমি থেকে মাত্র ১২ হাজার টাকা! এতে চলবে কি করে? খানিকটা হতাশ গলাতেই তাঁর উত্তর,‘‘চাষ করে দেনার দায়ে পড়ার চাইতে সেটাই ভালো। তবুও তো নিশ্চিত বারো হাজার টাকা পেয়েছি।’’ এতে বছরভর কিভাবে চালাবেন? ‘‘বাড়িতে হাঁস,মুরগি, গোরু ছাগল আছে আর খেতমজুরি করে কোনোরকমে চলে যাবে’’,আক্ষেপে ভরা যন্ত্রণা নিয়েই কথাগুলো বললেন হরিসাধন। 
খেতমজুরি নিয়ে কথা হচ্ছিল রুইদাস মণ্ডলের সঙ্গে। নিজের চাষের জমি নেই। এক বিঘা জমির ওপর বসত বাড়ি গাছগাছালি। খেতমজুরি করেই সংসার প্রতিপালন। এখন খেতমজুরদের রোজ কত? জানতে চাইতেই বলল দাদা অনেক আন্দোলন করে এখন রোজ আড়াইশো টাকা হয়েছে। তবে কাজের কন্ট্রাক্ট যে নেয় তাকে পনেরো টাকা দিতে হয়। ঠিকাদারির থাবা থেকে খেতমজুরদেরও রক্ষে নেই। আসলে দিকে দিকে জীবিকার সঙ্কট, ঘাপলা, তোলাবাজির এক সংস্কৃতি তৈরি করেছে। উপায়ন্তর না পেয়ে রুজির তাগিদে গ্রামের এই মানুষগুলোও এই তোলাবাজিকে স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিয়ে জীবন নির্বাহ করে চলছে। আমি দিনে দুশো টাকার হিসাবে হিসাব কষে রুইদাসকে বললাম তার মানে মাসে হাজার ছয়েক টাকা রোজগার ,গ্রামে কষ্টে সৃষ্টে এতে চলে যায় কি বলেন? রুইদাস মণ্ডল এ প্রশ্নের উত্তরে বলেন,‘‘আপনারা শহুরে মানুষ সবটাই অঙ্ক,যোগ বিয়োগ দিয়ে বিচার করেন। তবে খেতমজুরির কাজ সবসময় হয় না। মাসে দিন পনেরো জুটলেও মরশুম ভেদে সেটাও মেলে না।’’ তাহলে চলে কি করে? রুইদাসের উত্তর আমরা খেত মজুররা শুধু খেতমজুরি নিয়েই থাকিনা। ও ভরসায় বছরভর পেট চালানো যায় না। গাঁয়ের অনেকেই বছরের একটা বড় সময় দুর্গাপুর, বর্ধমান, কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে বিকল্প কাজের সন্ধানে চলে যান। কেউ রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ, কেউ ঠিকাদারি সংস্থার সঙ্গে রাস্তা মেরামতের কাজে আবার কেউ হকারি পেশা নিয়ে মাসকতক রুজির আশায় গ্রামের বাইরে থাকেন। তবে সে বিষয় নিয়েও আক্ষেপ রুইদাসের গলায়,‘‘রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে কাজ করে অনেক সময় টাকা পয়সা পেতে বেগ পেতে হয়। ঠিকাদার সংস্থার অধীনে কাজ করার বহুদিন বাদে অনেক সময় কিস্তিতে কিস্তিতে টাকা পেতে হয়। অনেকের হাড়ভাঙা খাটুনির টাকাও মার গেছে।’’ 
অবস্থা সম্পন্ন কৃষকরাও দেখেছি কৃষিকাজের প্রতি অনীহা প্রকাশ করছেন। চাষে লাভ হয় না। অথচ,বাজারের তরিতরকারির বেলাগাম দামে খামতি নেই। তথাকথিত কৃষক মান্ডিগুলি দেখেছি নীল সাদা রঙের জাকজমকে সাজানো। তবে তাতে কৃষকের কি সুরাহা হচ্ছে? অনেকেই অভিযোগ করেছেন,‘‘মান্ডিগুলো ওজনে কারচুপি করে, বস্তা প্রতি দু’-তিন কেজি মাইনাস করে দাম দেয়।’’ 
বঞ্চনার সেই ধারাভাষ্য নিয়েই বেলিয়াতোড় হয়ে ডান দিক বেঁকে বড়জোরার দিকে ছুটছিলাম। এবার গন্তব্য দুর্গাপুর…

Comments :0

Login to leave a comment