মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন খোদ বিজেপিরই বিধায়ক পাওলেনলাল হাওকিপ। তিনি বলেছেন যে মেইতি-কুকি সংঘর্ষ বেশিরভাগই রাষ্ট্রীয় মদতে হচ্ছে এবং কুকি অধ্যুষিত গ্রামে আক্রমণ পুলিশ কমান্ডোদের দ্বারা মেইতেই মিলিশিয়া দ্বারা সংঘঠিত করা হচ্ছে।
‘‘হিংসা বন্ধ হবে, যেই মুহূর্তে (মুখ্যমন্ত্রী) বীরেন সিং তার মিলিশিয়াদের লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হবেন,’’ তিনি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিংকে ৩ মে থেকে রাজ্য শুরু হওয়া সঙ্কটের সাথে জড়িত করেছেন।
তিনি যোগ করেছেন, ‘‘রাষ্ট্রীয় মদতের প্রমাণ স্পষ্টভাবে এই সত্য থেকে বোঝা যায় যে একটি সম্পূর্ণ জাতিগত সাম্প্রদায়িক হিংসা হিসাবে যা শুরু হয়েছিল তা পরে মুখ্যমন্ত্রীর দ্বারা ‘মাদক সন্ত্রাসীদের’ বিরুদ্ধে রাজ্যের যুদ্ধ হিসাবে চিত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল।’’
হাওকিপ, যিনি নিজে কুকি উপজাতির একজন, সংসদের বাদল অধিবেশনের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী যেদিন মণিপুরে তার নীরবতা ভেঙেছিলেন সেদিন টুইট করেছিলেন: “কখনও কখনও আপনি চান কুকি মহিলারা নগ্ন হয়ে হাটুক এবং ধর্ষণ হোক এবং তাদের চোখের সামনে তাদের সম্প্রদায়ের খুন হয়ে যাওয়া পুরুষরা যেন চিতা বাঘ। প্রধানমন্ত্রী হয়তো বিষয়টিকে আরও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।”
মণিপুরে মে মাসে হিংসা শুরু হওয়ার আগেই বিধায়ক রাজ্য বিজেপি সভাপতিকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের বক্তৃতা এবং কর্মকান্ড নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তিনি এবং বিজেপির অন্যান্য কুকি বিধায়করাও প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন, গত মাসে মোদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে একটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছিলেন। তিনি এখনও উভয়ের কাছ থেকেই কোনও প্রতিক্রিয়া পাননি।
মণিপুরের কুকি-জো বিধায়করা এপ্রিল মাসে নয়াদিল্লিতে ক্যাম্প করেছিলেন রাজ্যে বিভাজনকারী এবং পক্ষপাতমূলক নীতি অনুসরণকারী মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে। বেশ কয়েকজন কুকি-জো বিধায়ক পদত্যাগও করেন, একজন যিনি এন. বীরেন সিংয়ের উপদেষ্টা ছিলেন এবং অন্য একজন রাজ্য পর্যটন কর্পোরেশন থেকে অভিযোগ করেছিলেন যে তাদের কোনও কাজ বরাদ্দ করা হয়নি।
হাওকিপ, নিজে একজন কুকি উপজাতির অন্তর্গত, পাহাড়ে উচ্ছেদ অভিযানে আপত্তি জানিয়েছিলেন এবং লিখেছিলেন যে রাজ্যের ‘‘পাহাড় এবং উপত্যকা উভয়ের জন্যই একটি সঠিক বন্দোবস্ত নীতি দরকার, উচ্ছেদ নয়। নীতির বিষয়গুলি মন্ত্রিসভায় আলোচনা করা দরকার কোনো ব্যক্তির ইচ্ছা সাপেক্ষ নয়’’।
তিনি মণিপুরে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতায় হতাশ এবং বলেছেন যে তিনি তার মার্কিন সফরের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারলেও, ৭৯ দিনের জন্য তাঁর নীরবতা হতাশাজনক ছিল। অন্যান্য জিনিসগুলির মধ্যে, তিনি নিম্নলিখিত পয়েন্টগুলি তৈরি করেছেন:
১। আইনসভা এবং বিচার বিভাগের উপর মেইতিদে নিয়ন্ত্রণের কারণে ইম্ফল উপত্যকার মেইতি সম্প্রদায়কে রাজ্যের বেশিরভাগ সম্পদ বরাদ্দ করা হয়।
২। আইনসভার পার্বত্য অঞ্চল কমিটিকে তার সাংবিধানিক কার্যাবলী এবং ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
৩। সীমানা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ স্থগিত ছিল কারণ তা রাজ্যের জনসংখ্যার বর্ধিত শতাংশের সাথে মিলিয়ে উপজাতিদের জন্য আরও আসন বরাদ্দ করার সুপারিশ করেছিল।
৪। আদিবাসীদের জমিগুলিকে সংরক্ষিত বন হিসাবে মনোনীত করা হয়েছিল এমনসব নিয়ম বহির্ভূতভাবে জা তাদের অধিকারকে সংঘন করে।
৫। তফসিলি উপজাতিদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব হ্রাস করার জন্য রাজ্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণগুলি 'কারচুপি' হয়।
৬। দুর্নীতি এতই প্রবল ছিল যে বেশিরভাগ উপজাতীয় লোকেরা তা মোকাবেলা করতে পারেনি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের প্রবেশাধিকার আরও সীমিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার করা সার্ভে অনুযায়ী মণিপুরে নিকেল, তামা এবং প্লাটিনাম গ্রুপের খনিজ পাওয়া গেছে। এছাড়াও আছে ম্যাগনেটাইট, আ্যজুরাইট এবং ম্যালাকাইট। মণিপুরের ৮৯% জমি পাহাড়ি। মূলত এই সব খনিজ পদার্থ সঞ্চিত আছে ওখানেই। আর এখানেই কয়েক শত বা হাজার বছর ধরে আদিবাসী মানুষরা বাস করছেন। স্বাভাবিকভাবেই এই খনিজের প্রতি লোভ রয়েছে কর্পোরেটদের। আর তাদের তা লুট করতে সাহায্য করছে বিজেপি- যারা মণিপুরে ক্ষমতায়। অন্যদিকে আদিবাসী মানুষরা চোখের সামনে অসহায়ভাবে দেখছে তাদের সম্পদ লুট হয়ে যেতে। লু১ করছে বিশাল মাইনিং কোম্পানিগুলো। এদের পথ প্রশস্ত করছে কেন্দ্র এবং রাজ্য। তাঁরা অঙ্ক কষেই মেইতেই সম্প্রদায়কে (এই সম্প্রদায়ের থেকেই মণিপুরের রাজারা ছিলেন) তফশিলি উপজাতি তকমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন মেইতেইরা উপজাতি হলে, সহজেই তাঁরা পাহাড়ি জমি কিনতে পারবে। এটি উপত্যকার লোকেদের কাছে বাম্পার অফারের মতো। অপরদিকে স্বাভাবিকভাবেই পাহাড়ে বসবাসকারী মূলত আদিবাসী কুকি সম্প্রদায় তা মেনে নিচ্ছে না।
Comments :0