Pahalgam terror attack

নিরাপত্তার ত্রুটির দায় কার? এক মাস পরেও জবাব অধরা

জাতীয়

পহেলগামে নৃশংস সন্ত্রাসবাদী হামলার এক মাস হলো। এরমধ্যেই পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সন্ত্রাসবাদী ঘাঁটিতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ অভিযান চালিয়েছে ভারতের সেনাবাহিনী। তার পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হওয়া যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মার্কিন রাষ্ট্রপতি দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ বিরতি ঘোষণা করে দিয়েছেন। এরপরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ঘরে ঢুকে মেরেছি। আবার মারব ইত্যাদি। সেই অনুযায়ী বিজেপি দেশজুড়ে তিরঙ্গা যাত্রা বের করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীও দেশবাসীকে বিজয় উৎসব করতে বলেছেন। সেনাপ্রধান আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সব কিছুর পরে এক মাস বাদে সেই প্রশ্নটি একইরকম রয়ে গেছে, পহেলগামে নিরাপত্তার এমন ত্রুটির দায় কার? যারা জঘন্য হত্যাকাণ্ড চালালো সেই সন্ত্রাসবাদীরা  কোথায়? যারা প্রিয়জনদের হারালেন, তাদের অপূরণীয় ক্ষতির কোনও সমাধান নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে এইধরনের ঘটনা আর ঘটবে না, তা নিশ্চিত হলো কি? সেনা অভিযানকে রাজনৈতিক লাভ তোলার কাজে প্রচার করা যেতেই পারে, কিন্তু সাধারণের নিরাপত্তার প্রশ্নটা এক মাসের ঘটনাবহুল সময়ের পরেও অমীমাংসিত রয়েই গেল। 
বৈসরন উপত্যকায় হতাহতদের পরিজনরা প্রথম দিন থেকেই প্রশ্নটা করেছিলেন কেন সেখানে কোনও নিরাপত্তা বাহিনী ছিল না? যেখানে দেড় থেকে দু’ হাজার লোক ছিল। একই প্রশ্ন পহেলগামের বাসিন্দাদেরও। দেশের প্রধানমন্ত্রী অনেক কথাই বলছেন, কিন্তু এই নিয়ে কোনও কথা বলছেন না। জম্মু-কাশ্মীরের আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা লেফটেন্যান্ট গভর্নরের মাধ্যমে সরাসরি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের হাতে। নিরাপত্তার ত্রুটির দায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ নিলেন না কেন? সেই প্রশ্ন তোলা নিশ্চয়ই অসঙ্গত নয়। 
সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, এক মাস আগেই গোয়েন্দারা পর্যটকদের উপরে সন্ত্রাসবাদী হামলার আশঙ্কার কথা জানিয়েছিল। তারপরেও সেই সতর্কবার্তা কেন উপেক্ষা করা হলো পহেলগামে? প্রধানমন্ত্রীর কথা ছেড়ে দিলেও এর দায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের নয়? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর নয়? কীভাবে পহেলগামের মতো পর্যটকদের ‘স্বর্গরাজ্য’কে সুরক্ষাহীন করে রাখা হলো? চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বৈসরন উপত্যকা থেকে সিআরপিএফ-র ক্যাম্পটিই তুলে নেওয়া হয়েছিল। সন্ত্রাসবাদীরা অবাধে গুলি করে ২৬ জনকে হত্যা করল। দু’টো লাঠিধারী পুলিশও ছিল না সেখানে। সর্বদল বৈঠকে অমিত শাহ দাবি করেছেন, স্থানীয়রা বৈসরন উপত্যকা চালু করে দিয়েছে, কেন্দ্র নাকি জানতো না! নিজের দায় ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার এর থেকে হাস্যকর আর কী থাকতে পারে? এই কথায় প্রমাণ হয়, কাশ্মীরের কোথায় কী হচ্ছে তার তথ্য কেন্দ্রীয় সরকার বা তার সংস্থাগুলির কাছে নেই! যা একেবারেই সত্য নয়। চলতি বছরেই নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে শ্রীনগরে দু’ বার পর্যালোচনা বৈঠক করেছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। দ্বিতীয়টি পহেলগামের ঘটনার কয়েকদিন আগেই। তারপরে এত বড় ঘটনা মন্ত্রকের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তো তোলেই। অতীতে এই ধরনের ঘটনার দায় নিয়ে মন্ত্রীরা ইস্তফা দিতেন। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরে নিরাপত্তার ত্রুটির নৈতিক দায় নিয়ে ইস্তফা দিয়েছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী শিবরাজ পাতিল। মোদীর জমানায় সেই সব প্রথা উঠে গেছে। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে অমিত শাহ ন্যূনতম দায় স্বীকার করলেন না এক মাস পরেও। 
পহেলগামে হত্যাকাণ্ডের পরে পরেই সরকার কী করেছে? ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন সন্দেহভাজন উগ্রপন্থীদের বাড়ি বিস্ফোরণে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। যারা বহুকাল আগেই ঘর-পরিবার ছেড়ে সন্ত্রাসবাদে যোগ দিয়েছে। তাদের বাড়ি ধ্বংস করে পহেলগামের সন্ত্রাসবাদীদের কী করা গেল? উলটে বয়স্ক, মহিলা, শিশুদের ঘরহারা করা হলো। তাদের অপরাধ কী? এরপরে পাকিস্তানের নাগরিকদের ফেরত যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। দেখা গেল দুই পাড়ের নিরীহ মহিলারা চূড়ান্ত হেনস্তার মধ্যে পড়লেন। বিয়ে হয়ে আসা এই মহিলারা পাকিস্তানের নাগরিক, তাঁর স্বামী-সন্তান ভারতের। সন্তান থেকে মা-কে জোর করে বিচ্ছেদ করিয়ে পাকিস্তানে পাঠানো হলো। একই ঘটনা ওপারেও ঘটল। সীমান্ত এক মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী থাকল। নিরীহদের হত্যার দায়ে আরও কিছু নিরীহ মানুষকে শাস্তি দিয়ে কোন লক্ষ্য পূরণ হলো? 
সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে সঙ্গেই দেশের ভেতরে মুসলিম এবং কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো শুরু হয়। ‘জাতি নেহি, ধর্ম পুছা’- স্লোগান দেওয়া জিবলি পোস্টার থেকে শুরু করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলিম এবং কাশ্মীরিদের উপরে শারীরিক নিগ্রহ এমনকি হত্যা পর্যন্ত করা হয়। হিমাংশী নারওয়ালের মতো নিহতদের পরিজনরা যারা মুসলিম বা কাশ্মীরিদের উপরে আক্রমণ বন্ধ করতে আবেদন করেছেন তাদের কুৎসিত আক্রমণ করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। এই ঘটনাগুলির নিন্দায় একটি শব্দও আজ পর্যন্ত বলেননি মোদী-শাহরা। দেশকে যখন ঐক্যবদ্ধ রাখার কথা বলা হচ্ছে, তখনও প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এই ধরনের ঘটনা বন্ধ করতে কোনও আবেদন করেননি। উলটে দলের মন্ত্রী বিজয় শাহ কর্নেল সোফিয়া কুরেশিকে নিয়ে কুরুচিকর সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কথা বলছেন। তাতেও কোনও নিন্দা নেই, ব্যবস্থার তো প্রশ্নই নেই। ঘৃণার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সর্বশেষ উদাহরণ অধ্যাপক আলি খান মাহমুদাবাদ। 
নিরীহ পর্যটকদের নিরাপত্তা দিতে সরকার ব্যর্থ কেন এই প্রশ্ন তোলায় লোকগায়িকা নেহা সিং রাঠোর, অধ্যাপক মাদ্রি কাকোটির বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে। ইউটিউব চ্যানেল ফোর পিএম বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ‘দ্য ওয়ার’ সহ কয়েকটি ওয়েবসাইটের বিরুদ্ধেও। অথচ বিজেপি যখন বিরোধী দলে ছিল, নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে এই প্রশ্নই তারা তুলতেন। 
নিজেদের রাজনৈতিক প্রোপাগ্যান্ডা পূরণের জন্য মোদী-শাহরা লাগাতার প্রচার করেছেন, ৩৭০ ধারা বাতিলের পরে সন্ত্রাসবাদ শেষ হয়ে গেছে। কাশ্মীর এখন ‘স্বাভাবিক’। স্বাভিকত্ব প্রমাণের জন্য বিদেশের প্রতিনিধিদের এনে ঘোরানো হয়েছে। অযোধ্যার রামমন্দির বা কাশী বিশ্বনাথ করিডোরের দেখার মতো করে ‘স্বাভাবিক’ কাশ্মীরে দেখার প্রচার করেছে সরকার আর আইটি সেল। কিন্তু দেশ-বিদেশ থেকে আসা পর্যটকদের নিরাপত্তার দিকে নজর থাকেনি। কাশ্মীর ‘স্বাভাবিক স্বাভাবিক’ প্রচার করতে করতে নিজেরাই সেই আত্মতুষ্টির ফাঁদে পড়েছেন। এর দায়িত্ব কারোকে তো নিতে হবে। পহেলগামের হত্যাকাণ্ডের এক মাস পরেও সেই দায়িত্ব কেউ নিতে নারাজ। ফলে প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, নিরাপত্তার ত্রুটির দায় কার?

Comments :0

Login to leave a comment