আবাস যোজনার স্বচ্ছ তালিকার দাবিতে বিডিও’র কাছে ডেপুটেশন দিতে গিয়েছিলেন এই মহিলা। তিনি সরাসরি ফের জানিয়েছেন যে পুরুষ পুলিশকর্মীরা হেফাজতে তাঁর ওপর অত্যাচার চালিয়েছে। প্রায় বিবস্ত্র করে চালানো হয়েছে লাঠি। তিনি জানিয়েছেন, জেলের নিরাপত্তা রক্ষীরাও চমকে উঠেছেন পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন দেখে। সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘‘দায়ী পুলিসকর্মীদের রেহাই দেওয়া হবে না। এর ফল ভুগতে হবে’’।
মঙ্গলবার নন্দকুমার থানার সামনে বিক্ষোভ সভার ডাক দিয়েছিল সিপিআই(এম)। ৪১ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে দীর্ঘক্ষণ ধরে সমাবেশ হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন নিরঞ্জন সিহি, মিহির ব্যানার্জি, অনাদি সাহু প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন সেখ ইব্রাহিম আলি। ঘটনার প্রতিবাদে এদিন সমাবেশেও নেতৃবৃন্দ বলেছেন, সব গরীবকে ঘর দিতে হবে। তৃণমূলের কারচুপি চলবে না। নন্দকুমারের ঘটনায় জড়িত প্রত্যেক পুলিশকর্মীর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
মঙ্গলবারই জামিনে মুক্ত হন আরজুনা বিবি , শেখ আখতার আলি, রফিকুল ইসলাম, নিতাই জানা, গোপাল সামন্ত, কৃষ্ণেন্দু বর্মণ, সেখ সাহাজাহান আলি, জন্মেজয় রাণা, সেখ সাত্তার, আশীষ গুছাইত সহ ১০ পার্টি কর্মী। এদিন জেল থেকে বেরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছিলেন না আরজুনা বিবি। পুলিশ হেফাজতে হওয়া অকথ্য অত্যাচারের চিহ্ন সারা শরীরে প্রকট। সামান্য কথা বলতেই ধরে আসছিল গলা। হতদরিদ্র শ্রমিক পরিবারের বধূর একমাত্র অপরাধ, আবাস যোজনায় তৃণমূলী তোলাবাজির প্রতিবাদে বিডিও অফিসে ডেপুটেশন দিতে এসেছিলেন। শাসকদলকে প্রশ্ন করার ‘সাহস’ কীভবে জোটালেন প্রান্তিক এক মহিলা? সেই আক্রোশেই তাঁকে শিক্ষা দিতে উঠে পড়ে লাগে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশ। যদিও হাজার অত্যাচারের মুখেও শিড়দাঁড়া টানটান আরজুনা বিবির। চোয়ালও শক্ত। আরও একবার লালঝান্ডা হাতে লড়াইয়ের ময়দানে ফিরতে বদ্ধপরিকর আরজুনা বিবি।
ঠিক কী হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর রাত এবং ৩১ ডিসেম্বরের সকালের মধ্যবর্তী সময়ে?
আরজুনা বিবির কথায়, আমরা বিডিও অফিসের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমরা আবাস তালিকায় কাদের কাদের নাম উঠল সেই তালিকা দেখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিডিও আমাদের সঙ্গে দেখা করেনি। উল্টে দিনের আলো নিভে আসতেই আমাদের উপর পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক ম্যাডাম (পড়ুন মহিলা পুলিশকর্মী) আমাকে আক্রমণ করেন। কিন্তু উনি পুলিশের পোষাকে ছিলেন না। আমাকে মারতে এলে আমি নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি।
‘নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা’! স্রেফ এইটুকুই ছিল আরজুনা বিবির অপরাধ। কেন তিনি পড়ে পড়ে তৃণমূলের স্তাবকে পরিণত হওয়া পুলিশ বাহিনীর মার হজম করেন নি? পালটা প্রতিরোধের সাহস কোথা থেকে পেলেন তিনি? এই ছিল তাঁর বিরুদ্ধে নন্দকুমার থানার পুলিশের মূল আক্রোশ। সেই আক্রোশেই বিডিও অফিসের সামনে থেকে চুলের মুঠি ধরে, কার্যত বিবস্ত্র করে, টেনে হিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে তোলা হয় তাঁকে। আরজুনা বিবির সম্মান রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার যুব আন্দোলনের নেতা পরিতোষ পট্টনায়েক। জেল থেকে বেরিয়ে তাঁকে বাঁচাতে চাওয়া পরিতোষ পট্টনায়েকের খোঁজও নিয়েছেন আরজুনা।
আরজুনা বিবির কথায়, থানায় নিয়ে গিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করা হয়, পার্টি কত টাকা দিয়েছে, যে তুই ম্যাডামের গায়ে হাত তোলার সাহস পেয়েছিস? চিনিস তুই ম্যাডামকে? এই বলে লকআপের মধ্যে তাঁর গালে ধেয়ে আসতে থাকে একের পর এক থাপ্পড়। পুলিশ হেফাজতে মহিলার ওপর এমন নির্যাতনের আইনি অধিকার নেই পুলিশের। আবাস যোজনার সঙ্গত দাবি জানাতে গিয়ে তেমনই নির্যাতনের শিকার আরজুনা বিবি।
আরজুনা বিবির ভাষ্যে, সেই মহিলা পুলিশ কর্মী লকআপের মধ্যে আরও দুই পুরুষ পুলিশকর্মীকে ডেকে আনেন। তারপর তাঁর শাড়ি প্রায় কোমড়ের কাছে তুলে শুরু হয় ‘ডাং’ দিয়ে মার। একসময় তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসে আরজুনা বিবির। পানীয় জল চাইলে তাঁকে প্রস্রাব পান করতে বলে পুলিশকর্মীরা। থানার লকআপের মেঝেতে ফেলে তাঁর গলায় বুট দিয়ে ‘রগড়ে’ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
রাতের অত্যাচার শেষে পরদিন, অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর সকালে আদালতে ‘চালান’ করা হয় আরজুনা বিবি সহ ১০ সিপিআই(এম) কর্মী সমর্থককে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হয় ৩০৭, ৩৩৩’র মতো গুরুতর ধারায় মামলা।
আরজুনা বিবি আরও জানিয়েছেন, জেলের নিরাপত্তা রক্ষীরাও তাঁর উপর হওয়া অত্যাচারের নমুনা দেখে এবং বিবরণ শুনে শিউরে উঠেছেন। তাঁদের প্রশ্ন, তুমি কী এমন করেছে যে এইভাবে থানার ভিতরে মারল?
জেল থেকে বেরোনোর পরে আরজুনা বিবির অবস্থা দেখে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ। শেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, সেই প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে।
আরজুনা বিবিকে সহ ১০ বামকর্মী জেল থেকে বেরোনোর পরে তাঁদের সংবর্ধনা দেন সুজন চক্রবর্তী, অনাদি সাহু, নিরঞ্জন সিহি সহ সিপিআই(এম)’র শীর্ষ নেতৃত্ব। সুজন চক্রবর্তীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ চালচুলো নেই এমন হতদরিদ্র পরিবারের একটা মেয়েকে রাস্তায় ফেলে এবং হেফাজতে নিয়ে পুলিশ মেরেছে। সেই অত্যাচারের বর্ণনা শুনলে স্থির থাকা কঠিন। এই ঘটনা শুধু অশ্লীলই নয়, পাশবিকও বটে। এরকম ভাবে নিরস্ত্র এক গৃহবধূর উপর পুলিশ অত্যাচার চালাতে পারে, এই কথা ভাবাও কঠিন। মেয়েটা স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছিল না। কথা বলতে খারাপ লাগছিল। আমরা ওঁকে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করেছি। যেই পুলিশকর্মীরা ভাবছেন, এই সমস্ত করে পার পাবেন, তাঁদের আমরা যতদূর সম্ভব দৌড় করাবো। এই গোটাটার বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছি আমরা’’।
আইন আদালতের ঝক্কি সামলে আরজুনা বিবিকে ফিরতে হবে সেই ছিটে বেড়ার ঘরেই। ফি বছর এক কামড়ার যেই ঘরের চাল ভেদ করে অঝোর ধারায় বর্ষা নেমে আসে। মমতা ব্যানার্জির বাংলায় এই মানুষগুলির পাকা ছাদের দাবি জানানো অন্যায়।
Comments :0