Bangladesh Story

সেতুর পথে স্বপ্ন হাঁটে, খড়গ হাতে সাম্প্রদায়িকতা

ফিচার পাতা

চন্দন দাস
(বাংলাদেশ থেকে ফিরে)

রাতভর জেগে থাকে শহরের হৃদপিণ্ড!
একদিকে বড় স্টেশন। কাছেই বন্দর। সাইনবোর্ডে, মাদ্রাসা, স্কুলের নাম খোদাই করা পাথরে কোথাও চিটাগং। কোথাও লেখা চট্টগ্রাম। মূল শহর ছেড়ে পাহাড়তলির মতো বসবাসের এলাকায় ঢুকলে অনেক সাইনবোর্ডেই লেখা শহরের অহঙ্কার— বীর চট্টল!
সূর্য সেনের শহরে যুব বিদ্রোহের সেই অস্ত্রাগার সযত্নে রক্ষিত। লাল রং করা। এখন সেখানে মালখানা। সবুজ দরজায় বড় তালা। পুলিশের অনুমতি ছাড়া পৌঁছানো যায় না তার সামনে। আমরা পৌঁছেছিলাম। অদূরে পুলিশের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। সেখানে সূর্য সেনের শেষ আহ্বান, কল্পনা দত্ত, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ছবি, পরিচয় রাখা আছে। ইউরোপিয়ান ক্লাবেও প্রীতিলতার স্মৃতিসৌধ। পাহাড়তলির মাঝামাঝি সূর্য সেনের স্নেহের ‘রানী’র আবক্ষ মূর্তি।
রাত পৌনে বারোটায় মনে হয়েছিল একটি ব্যাগ দরকার। কিন্তু এখন কোথায় পাবো? হোটেলের কর্মী সাহাবুদ্দিন বললেন,‘‘বাজারে চলে যান। সামনেই। পেয়ে যাবেন।’’ 
এখন? সকালে যাবো। এখন দোকান খোলা থাকে নাকি?
সাহাবুদ্দিন হেসে বললেন,‘‘চলে যান। পেয়ে যাবেন।’’ আমরা দু’জন পশ্চিমবঙ্গের এবং আরও দু’জন আসামের সাংবাদিক রওনা দিলাম। হোটেলের ওপারে গিয়ে অবাক। 
দোকান প্রায় সব খোলা। সিএনজি (বাংলাদেশে অটো এই নামেই পরিচিত) চলছে। সারি সারি ট্রাক চলছে। রাস্তার ধারে পথচারী। আগুন পোহাচ্ছেন শ্রমিকরা— মূলত ট্রাক থেকে যাঁরা মাল খালাস করেন। বিরানি (বিরিয়ানি)-র সারি সারি দোকানের আলো জ্বলছে। ভিতরে কাঠের চেয়ার-টেবিলে বসে ‘বিরানি’ কিংবা ‘মুরগাভাত’ খাচ্ছে দলে দলে লোক। মুরগাভাত কী? চিকেন বিরিয়ানি! ফুটপাত জুড়ে ফলের দোকান। কমলালেবু, আপেল, ফুটি, তরমুজ, কালো আঙুর, আনারস। আর শুকনো ফল— নানা ধরনের। 
ফুটপাতের আর এক পারে চার পাঁচটি গলির মধ্যে সারি সারি দোকান। ব্যাগ থেকে জামাকাপড়, হলুদ থেকে ফুলকপি। 
সারা রাত রাস্তায় গাড়ি চলছে। তার আওয়াজে রাতের নিস্তব্ধতা চুরমার। ভোরে চায়ের খোঁজে বেরোলাম দু’জন। রাস্তার পাশে দোকান। দোকানদার জিজ্ঞেস করল,‘‘টেম্পোরারি?’’ ভাবলাম এই দেশে থাকি কিনা জানতে চাইছেন। বললাম, ভারত থেকে আসছি। দোকানদার যুবক এবার বললেন,‘‘বুঝেছি বলেই তো জানতে চাইছি। টেম্পোরারি চা?’’ মানে? ছেলেটি কাগজের কাপে দুধ চা এগিয়ে দিয়ে বলল,‘‘এই কাপে চা মানে হইলো গিয়া টেম্পোরারি চা।’’
পার্মানেন্ট কী? কাচের কাপ!
হোটেলে ফিরে লিফটে উঠতে যাবো। আলো ফোটেনি ভালো করে। কানে এল মৃদু স্বরে—‘‘জাগিবে একাকী, তব করুণ আঁখি/ তব চঞ্চল ছায়া মনে রহিবে ঢাকি/ মম দুঃখ বেদন, মম সফল স্বপন/ তুমি ভরিবে সৌরভে...’’। 
কোথায় বাজছে? কে গাইছে? এই ভোরে? মাথায় ফেজ টুপি পরা সাহাবুদ্দিন এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন,‘‘কী খুঁজছেন?’’ বললাম, গান হচ্ছে। সাহাবুদ্দিন মৃদু হেসে বললেন,‘‘রবীন্দ্রনাথের। আপনার মাথার উপর।’’ 
উপরে তাকালাম। দেখলাম ফ্লোরের সিলিংয়ে দুটি স্পিকার। ছোট। সহজে নজরে আসে না। সেখান থেকেই ভেসে আসছেন রাতজাগা শহরে ভোরের আলো— আমাদের ‘প্রাণের আরাম/ মনের আনন্দ/ আত্মার শান্তি!’

 দোতলা বাসের সওয়ারি

‘ইন্ডিয়া’ বলেন কেন? ভারত বলেন না কেন?
জিজ্ঞেস করলাম। রাধারানি দাস হাসলেন। কিন্তু চোখে মুখে কিছুটা অসহায়তা।
‘‘আমি কী জানি তার? সবাই কয়। আমিও কই। ইন্ডিয়া।’’ 
কখনও গেছেন? 
বাংলাদেশের গ্রন্থাগার মন্ত্রকের কর্মী বছর ৫০-র মহিলার পরনে শাড়ি। তাঁর পাশে বসে এক বন্ধু— আমিনা বিবি। আমিনা বিবি বললেন,‘‘আপনার বাস কোথায়? কোন হানে থাকেন?’’ জবাব দিলাম। আমিনা বললেন,‘‘আমাগো আত্মীয় থাকে একটা স্টেশনের কাছে। কী যেন নাম...। হ্যাঁ, কবি সুভাষ। উই স্টেশনের কাছে।’’ বুঝলাম মেট্রো স্টেশনের কথা বলছেন। গড়িয়ার কাছে। আমিনা বলে চললেন,‘‘আমাগোও তো মেট্রো হইতাসে। দেখসেন তো? সরকার কাজ করতাসে প্রচুর। পদ্মা সেতু দেখসেন?’’ সম্মতি জানালাম। এবার রাধারানীর পালা। তিনি বললেন,‘‘আমাগো মন টেকে না ওপারে। আমার মা তো দেশভাগের পরে ওপারে গেসিল। এক মাসও যায় নাই। কান্নাকাটি কইরা চইলা আইলো। বলে, আমার দ্যাশেই থাকুম। আমরা এই খানেই রইয়া গেলাম। দাদা, বোন আসে উপারে। যাই মাঝেসাঝে। উয়ারাও আসে।’’
এখানে থাকতে অসুবিধা হয় না? ভয় লাগে না?
রাধারানি একবার আমিনার দিকে তাকিয়ে বললেন,‘‘ভয় কিসের? আমাগো দ্যাশ। গোলমাল তো সব জায়গাতেই আসে। ইন্ডিয়াতেও আসে। বন্ধুও আসে। আমাগো বাড়ি ছিল বাগেরহাটে। বাবা, মা ওইখানেই থাকতেন। ওপারে মসলন্দপুরের কাছে দাদা বাড়ি করসিল। ভাইপো, ভাইঝিরা থাকে।’’ আপনি? প্রশ্ন করলাম রাধারানিকে। জবাব দিলেন আমিনা। আমিনা বললেন,‘‘উর সোয়ামি তো পুলিশে চাকরি। ও ঢাকাতেই কাজ করে। উরা এহানেই থাকে।’’
বাইরে তখন প্রবল যানজট। বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি’র নেতা, কর্মীরা জমায়েত হচ্ছেন। তাদের অবস্থান কর্মসূচি আছে। তাদের দাবি— সরকার ভেঙে দিতে হবে। নতুন করে নির্বাচন করতে হবে। তার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গড়তে হবে। দোতলা বাস, রিকশা, সিএনজি সব পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বিস্তীর্ণ এলাকায়। লোকজন যে যেমন পারছেন রাস্তা পার হচ্ছেন। তাঁদের হাঁটাচলায় নির্দিষ্ট কোনও জ্যামিতি নেই। কেউ কোণাকুণি এপার থেকে ওপারে যাচ্ছেন। কেউ সোজাসুজি। রাস্তার ধারে হালিমের ডেকচি, টুপি, পান সিগারেটের গুমটি। বিড়ি মিলবে না। আমিনা বিবি আমার হাতে বিড়ি দেখে অবাক! ‘‘আরে বিড়ি কোথায় পাইলেন। আনসেন বুঝি ইন্ডিয়া থিকা? আমাগো এখানে আর মেলে না।’’ বিড়ির পাতা পাওয়া যায় না। তাই বিড়ি নেই। কী আশ্চর্য এই দেশটার কাঁটাতারের ওপারে কয়েক লক্ষ বিড়ি শ্রমিকের বাস!
রাস্তার ধারে চায়ের দোকান— দুধ চা পাওয়া যায়। বেশিরভাগ পথচারী তাই খান। চাইলে ‘রং চা’ও মিলবে। মানে লাল চা। ভাঁড় পাওয়া যাবে না। কাচের কাপ। বিস্কুট কেক। প্রায় মাথার উপর দিয়ে মেট্রো রেলের নির্মীয়মাণ লাইন এগিয়েছে। মেট্রোর সিমেন্টের পেল্লাই থামের আশপাশে লোহা লক্কর। লোকজন ছুটছেন। তার মাঝেই পারলে একটু চা খেয়ে নিচ্ছেন। দোতলা বাসের জানলায় বিরস মুখ। সুযোগ পেলেই ঘাড়ের উপর এসে পড়ছে সবুজ রঙের একতলা বাস। তার চালককে ধমকাচ্ছে রিকশাচালক —‘‘তোর দেখতাসি বড় তাড়া। হালায় দেখস না রাস্তা নাই। হালা...।’’ বাসের চালকের রা নেই। স্টিয়ারিং ছেড়ে থুতনির দাড়ি চুলকায়। নির্বিকার।
পুরানো পল্টন মোড় তখন অবিন্যস্ত। বেশিরভাগ সময় এমনই থাকে। কিন্তু প্রাণোচ্ছ্বল।
ঢাকা প্রাণের শহর।
সেই পুরানো পল্টন মোড়ের কাছেই বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির অফিস। কিছুটা দূরে গুলিস্তান মোড়। সেখানে আওয়ামি লিগের অফিস। হেঁটে গেলে ৭-৮ মিনিট। রিকশায় গেলে কুড়ি মিনিট, অন্তত। 
সেই বিশাল অফিসে ছিল বাংলাদেশের শাসক দলের নেতাদের সঙ্গে ‘মত বিনিময় সভা।’
সেখানেই এলেন জ্যোতি বসু।  

গুলিস্তান মোড়ে জ্যোতি বসু

‘আপনি জ্যোতি বসুর কথা বলছিলেন। আমি জ্যোতি বসুর পার্টির কাগজের সাংবাদিক।’ লম্বা ঘর ভরতি লোক। অনেকে কথা বলছেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে। তাই মুখ নামিয়ে আনলাম মন্ত্রীর কানের কাছে বললাম।
মুহূর্তে ঘাড় ঘোরালেন। মোটা, কালো ফ্রেমের চশমার অদূরে দুটি তারায় স্পষ্ট কৌতূহল, আগ্রহ। আওয়ামি লিগের ‘নম্বর ২’ দেখতে চাইলেন ‘জ্যোতি বসুর পার্টির লোককে।’ তিনি চেয়ারে বসে। আমি দাঁড়িয়ে। তাঁর ডান হাতটি উঠে এল। আমি আমার পাঞ্জা তাঁর করতলে রাখলাম। মৃদু চাপ দিলেন মুক্তিযোদ্ধা, প্রৌঢ় ওবায়দুল কাদের। বললেন, ‘‘ভালো লাগল। ভালো থাকবেন।’’
আবেগ, শ্রদ্ধা সেই স্পর্শে! ‘ইন্ডিয়া’ আর ‘ইন্দিরা ভবনের’ সাবেক বাসিন্দা মানুষটি মিশে আছেন কাদেরের স্মৃতিতে। গণশক্তি একটি পরিচিত নাম বাংলাদেশেও। বিশেষত রাজনৈতিক দলের নেতাদের কাছে। ‘আমি গণশক্তির’ অমুক বললে বুঝতে পারছেন মন্ত্রী, আমলারা— সেই অভিজ্ঞতা হয়েছে আগেই। তবু ‘জ্যোতি বসুর পার্টির কাগজ’ বললে আরও সহজে সংযোগ স্থাপন সম্ভব।
আওয়ামি লিগের সভাপতি শেখ হাসিনা। সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সরকারের যে দপ্তরের উদ্যোগে তিস্তা সেতু হয়েছে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর নিচ দিয়ে টানেল হচ্ছে, সেই সড়ক এবং সেতু মন্ত্রকের মন্ত্রী তিনি।   
তখন সন্ধ্যা। বাইরে যথারীতি যানজটে বিধ্বস্ত, আলোকমালায় উজ্বল শহর। আওয়ামি লিগের বিরাট কার্যালয়। বিরাট মানে বিরাট— বহুতল, লিফ্‌ট বিশিষ্ট। ঝকঝকে। বাড়ির মধ্যে অনেক ঘর। হলুদ দেওয়াল, কাচের জানলা, মোটা পর্দা। বাড়ির নিচে বড় বড় গাড়ি দাঁড়ানো। বাড়ির বাইরে সব সময়েই শ’ খানেক যুবক দাঁড়িয়ে থাকেন— বাইকসহ। সেই বাড়িতে আওয়ামি লিগের নেতৃত্ব ‘মত বিনিময়’ বৈঠকে ডেকেছিলেন আমাদের— পশ্চিমবঙ্গ, আসাম থেকে যাওয়া সাংবাদিকদের। ছিলেন দলের অনেক শীর্ষ নেতাই। মূল আলাপচারী ছিলেন ওবায়দুল কাদের।  
কূপমণ্ডুক আমি। নিজের আশপাশের জগৎ ছাড়া কীই বা জানি নিজের দেশ, পড়শি দেশ সম্পর্কে? কেন ভারত, বাংলাদেশের রাজনীতির কিছু ক্ষেত্রে আশ্চর্য মিল, কেন দুই দেশেই কমিউনিস্টদের বারবার পরীক্ষা দিতে হয়েছে, হচ্ছে, কেন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দেশের জন্য কমিউনিস্টদের অবদান সোনার নয়, পারলে প্ল্যাটিনামের অক্ষরে লিখতে হবে, কেন পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস বাড়লে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তি উজ্জীবিত হয়— তার কিছুই আমার মতো সাধারণের অনুপুঙ্খ বোঝার কথা নয়। বাংলাদেশ কয়েক দিনে কিছুটা বুঝিয়েছে। বাংলাদেশকে এই ক’দিন দেখতে দেখতে কেবলই মনে হয়েছে এই উপমহাদেশের নিজস্ব একটি চরিত্র আছে। সংসদীয় গণতন্ত্র, তার কৌশল ব্যবহারের প্রশ্নটি কাঁটাতারের বেড়ায় সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তা আরও কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। 
ওবায়দুল কাদের কী বলেছিলেন মত বিনিময় সভায়?
ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে বলছিলেন তিনি। বললেন,‘‘ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার মতো বিশ্বস্ত বন্ধুও ভারতের আর নেই। অনেক মিল দু’ দেশের।’’ 
দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চলে। দুই দেশেরই অনেক ব্যবসায়ীর ব্যবসা নির্ভরশীল দুই দেশের পারস্পরিক সু সম্পর্কের উপর। চিকিৎসার জন্য অনেক বাংলাদেশের মানুষ ভারতে আসেন। যেমন চট্টগ্রামে বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রকের এক কর্মী জনি (পুরো নাম মনে নেই, বেশ খটোমটো, শুধু নামের শেষে জনিটাই মনে আছে) বললেন,‘‘আমার দাদার পায়ের সমস্যা। কিছুতেই সারছিল না। আপনাগো দ্যাশে নিয়ে যাওয়ান হইলো। দুই মাস ছিল। এক্কেবারে ভালো হইয়া গ্যাসে।’’ গুলিস্তান মোড়ের কাছে বঙ্গ বাজার। বাজারের ব্যবসায়ী ফকিররুদ্দিন। কথায় কথায় বললেন,‘‘আপনি থাহেন কই? যাদবপুরে? ও। আমাগো তো গড়িয়াহাট পর্যন্ত যাতায়াত আসে। বড়বাজার তো হামেশাই যাই।’’
‘ইন্ডিয়া’র যে কোনও ঘটনার প্রভাব বাংলাদেশে পড়ে। ভারতে দাঙ্গা, মসজিদে হামলাকে যেমন সেখানকার সাম্প্রদায়িক শক্তি কাজে লাগানোর চেষ্টা করে, তেমনই ভারতের অর্থনীতির প্রভাবও সে দেশে আছে। তাই ওবায়দুল কাদেরের মতো মন্ত্রীর কথায় ইন্দিরা গান্ধী তো আসেনই। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধীই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এখন আসেন নরেন্দ্র মোদীও— কাদেরদের কথায় ‘ইন্ডিয়া’র ‘দক্ষ’ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে।  
জ্যোতি বসু? প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না। দু’ দেশের পারস্পরিক আলোচনা প্রসঙ্গে তবু ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের, পশ্চিমবঙ্গের সম্পর্ক খুবই দৃঢ়। আপনাদের রাজ্য সরকারের অনুমোদন না থাকলে তো অনেক কিছুই সম্ভব নয়। তিস্তা জল চুক্তি যেমন। এর আগে তো জল চুক্তি হয়েছে। জ্যোতি বসুর মতো লিজেন্ড নেতা তখন ছিলেন। সেই চুক্তি তাই হয়েছিল। ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ পারস্পরিক সম্পর্কে সেই চুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।’’
তিস্তা চুক্তি থমকে— মনে পড়ে গেল। কেন? নবান্ন জানে!
জ্যোতি বসু ‘লিজেন্ড’— এই বিষয়ে কাদেরের মতো দুই দেশের অনেকেরই কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এখানে জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী নন— ‘ইন্ডিয়া।’ দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কের পোক্ত সেতু। কাদের না বললে কী হতো? কিছুই না। তবু তিনি বললেন— জ্যোতি বসু যে! কাঁটাতার মুছে সব বুকের বাঁ দিকে যত্নে থাকেন।
বাংলাদেশে যারা সাম্প্রদায়িক শক্তি তারা মূলত ভারত-বিদ্বেষী এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ, ইতিহাস বিরোধী। এবং অবশ্যই কমিউনিস্ট বিরোধী। ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির সঙ্গে তাদের স্বাভাবিক মিল। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যে কোনও আদানপ্রদান মূলক কর্মসূচি ভেস্তে গেলে উৎসাহিত হয় তারাই। চাপে পড়ে কিছুটা হলেও দুই দেশের অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি।

সরকার এবং কমিউনিস্টরা

ভাতা আছে? 
জানা গেল — আছে। বয়স্ক, বিধবা, স্বামী পরিত্যক্ত, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাতা চালু আছে বাংলাদেশে। আছে ছাত্রদের নানা ধরনের ভাতা। এছাড়াও আরও কিছু ক্ষেত্রে ভাতা দেওয়া হয়। 
বাসস্থান তৈরিতে সরকারি সহায়তার প্রকল্প? তাও আছে। এমনকি বাসস্থানের জন্য ভূমিহীনদের জমির ব্যবস্থাও করা হয়। যেমনটি বামফ্রন্ট সরকার চালু করেছিল পশ্চিমবঙ্গে।
শেখ হাসিনার বক্তব্য তাঁর আমলে,‘‘দারিদ্র ৪০% থেকে ২০%-এ নেমে এসেছে। মাথাপিছু আয় ৫৪৩ ডলার থেকে ২৮২৪ ডলারে উঠেছে। সাক্ষরতার হার ৪৫% থেকে হয়েছে ৭৫%।’’
সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প আছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে শেখ হাসিনার সরকারের মূল লক্ষ্য পরিকাঠামো উন্নয়ন, ব্যবসার উন্নতি, মাথাপিছু আয় বাড়ানো।
তাই যে সরকার করোনার সময় বিনামূল্যে ৩৪ কোটি টিকা দিয়েছে, শহর এবং গ্রামের গরিবদের জন্য ঘরে ঘরে খাদ্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে, তারাই শিল্পে উৎপাদন জারি রাখতে, ব্যবসা চালু রাখতে ২৮টি প্যাকেজ চালু করেছিল। সেই প্যাকেজের টাকার পরিমাণ ১,৮৭,৬৭৯ কোটি টাকা। ৫০ লক্ষ মানুষকে দুই দফায় ৫০০০ টাকা দেওয়া হয়েছে। 
শেখ হাসিনা সংসদে গত ১৬ ডিসেম্বর ঘোষণা করেছেন, ‘‘আমরা ২০৪১-র মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-স্মার্ট বাংলাদেশ হিসাবে গড়ে তুলব।’’ 
সেক্ষেত্রে জোর মূলত কিসে? চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা— নজর দিলেই বোঝা যাচ্ছে পরিকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক জোর দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে। পরিকাঠামো উন্নয়ন ছাড়া যে কর্মসংস্থান, স্বনির্ভরতা প্রকল্পের বিকাশ, স্থায়ী সম্পদ সৃষ্টি সম্ভব নয়— আওয়ামি লিগের সরকার তা বুঝেছে। এপার বাংলায় যখন পরিকাঠামো খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমানো হচ্ছে, ওপারে তখন তাতে বিপুল টাকা বরাদ্দ।
গত জুনে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে রাজধানী ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সড়কপথে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে উদ্বোধন হয়েছে পায়রা সেতুর। গত অক্টোবরে। নভেম্বরে দেশের ২৫টি জেলার ১০০টি সেতুতে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। যা সবচেয়ে নজরকাড়া তা হলো চট্টগ্রামে কর্ণফুলি নদীর নিচ দিয়ে টানেল। তার কাজ চলছে দ্রুত গতিতে। ৯.৩৯ কিমি দীর্ঘ এই টানেল তৈরিতে খরচ হবে ১০,৩৭৪ নকোটি ৪২লক্ষ টাকা। তার মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪৪৬১ কোটির বেশি টাকা। চীন সরকার দিয়েছে ৫৯১৩ কোটির কিছু বেশি টাকা। চলতি বছরেই এই টানেল তৈরির কাজ শেষ হওয়ার কথা। 
কিন্তু জমি কোথা থেকে আসছে?
চীনের সহায়তায় এই টানেল তৈরির জন্য ৩৮২.০৮২১ একর জমির প্রয়োজন হয়েছে। টানেলের দু পাড়ে আনোয়ারা এবং পতেঙ্গা। দু’দিকেই কৃষক ছিলেন। সেই ২৭৭৯জন কৃষক জমি দিয়েছেন। সরকার তাঁদের জমির জন্য দিয়েছে ৩৪১ কোটি ৪৬লক্ষ টাকা। গড়ে একেকজন কৃষক প্রায় ১২লক্ষ ২৯ হাজার করে টাকা পেয়েছেন। 
বাংলাদেশ দ্রুত এগচ্ছে। 
কিন্তু সমস্যা? আছে। সাম্প্রদায়িক শক্তি সেখানেও বড় বিপদ। আর সেই সূত্রেই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষার লড়াই। আর সেই সংগ্রামে অতন্দ্র কমিউনিস্টরা— বরাবরের মতো।
কেমন? 
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি, সাংসদ রাশেদ খান মেননের কথায়,‘‘মূল্যবৃদ্ধি বড় সমস্যা। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকারের সব কাজকে এই সমস্যাই খেয়ে ফেলতে পারে। তাছাড়া বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের নামে নতুন ফন্দি আঁটছে। ১ কোটি মানুষ ভিন দেশে কাজ করেন। তাঁদের একাংশ আরব দুনিয়ায় আছেন। সেখান থেকে তাঁরা কিছু প্র্যাকটিস নিয়ে আসছেন। যা অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার উপযোগী নয়। তাছাড়াও সঙ্কটকালে যেভাবে সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথা তোলে তাও দেখা যাচ্ছে। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমাজে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। আমরা মনে করি ১৯৭২-র সংবিধানে ফিরে যাওয়া জরুরি।’’
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কমিউনিস্টরা মনে করছেন, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ রক্ষায় তাদের শক্তির বিকাশ জরুরি। সেই লক্ষ্যেই এগচ্ছেন তারা— সংসদের মধ্যে এবং ভিতরে।

Comments :0

Login to leave a comment