শান্তনু চক্রবর্তী
কনডেম্ড সেল-এর দরজা থেকে ফাঁসির মঞ্চ অবধি পুরো পথটা যেন হোলির সকালে প্রভাত ফেরি! কয়েদির পোশাক পরা তিন যুবক গাইতে গাইতে চলেছেন — ‘রঙ দে বাসন্তী চোলা, মাহে রঙ দে’! জেলখানায় যেন এক টুকরো বসন্তের হঠাৎ আবির্ভাব! কারা প্রাচীরের অন্তরালের নির্মম, গম্ভীর সাদা কালো হিম হিংস্রতা যেন আচমকাই আবিরের রঙে ভরে ওঠে! বন্দিদের গালে-চুলে, জেলখানার মলিন বেশেও যেন কোন্ অদৃশ্য বাসন্তী রঙের আদুরে ছোঁয়া লাগে! শোক নয়, কান্না নয়, আর্ত হাহাকার নয়— উদ্যাপন! বিপ্লবের জন্য দেশের মানুষের মুক্তির জন্য, জীবন উৎসর্গ করার উৎসব! এই শেষ ভোরে বসন্তের ‘আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে মরণ খেলা’! কিংবা মরণের সঙ্গে জীবনের হোলি খেলা। সাম্রাজ্যবাসী শাসকের দেওয়া যে মৃত্যুদণ্ড, ভগৎ সিং আর তাঁর দুই সাথী সুখদেব আর রাজগুরুর অস্তিত্বটাই দেশের মানুষের স্মৃতি-স্বপ্ন থেকে মুছে দিতে চলেছিল বাস্তবে তার প্রতিক্রিয়াটা দাঁড়াল উলটো। সন্ধেবেলায় ২৩ মার্চ রাতেই ফাঁসির মঞ্চে প্রচুর পাহারা আর কড়া নজরদারিতে শতদ্রু নদীরে তীরে গোপনে তিনজনের শেষকৃত্য সেরে ফেলে, রাষ্ট্র প্রশাসন নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিল। কিন্তু শহীদের দেহাবশেষ নদীতে ভেসে গেলেও পাঞ্জাব তথা উত্তর ভারতের লোকায়ত সংস্কৃতিতে, নাটকে গানে, লোককবির কবিতার ছন্দে চির যৌবনের দূত হয়ে থেকে গেলেন ভগৎ সিং আর তাঁর শহীদ সাথীরা কীভাবে? সেটাই দেখা যাক।
ভগৎ সিংকে নিয়ে বলিউডে বিভিন্ন সময় যতগুলো ছবি হয়েছে, সবগুলোরই শেষ দৃশ্যে এই ‘মেরা রঙ দে বাসন্তী চোলা’ গানটার নানা রকম ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। নানা রকম সুরে, লয়ে। ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরুরা ফাঁসির আগে সত্যিই কি এই গানটা গাইছিলেন? কিংবা ব্রিটিশ সরকারের জেল প্রশাসন আদৌ তাঁদের ওভাবে প্রায় চড়ুইভাতির মেজাজে গান গাইতে গাইতে ফাঁসির মঞ্চে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিলেন? সম্ভবত নয়। প্রত্যক্ষদর্শী সহ-বন্দিদের টুকরো টাকরা বিবৃতি থেকে যতদূর জানা যায়, জেল কর্তৃপক্ষ ভগৎ সিংয়ের স্লোগান দেওয়া ঠেকাতে পারেনি। বিপ্লবকে দীর্ঘজীবী করার তাঁদের সেই অমর আহ্বান ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিতে দিতেই তাঁরা শহীদের মৃত্যুবরণের পথটুকু হেঁটেছিলেন। লাহোর সেন্ট্রাল জেলের অন্দরে বন্দি বিপ্লবীরাও সেই স্লোগানে গলা মিলিয়েছিলেন। এটা তো সেই স্লোগান সংসদ ভবনে নকল বিস্ফোরণ আর ইশ্তেহার বিলির সময় তিনি এবং বটুকেশ্বর দত্ত তুলেছিলেন! এটা সেই স্লোগান যার প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে মডার্ন রিডিয়নের সম্পাদক, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদকীয় কলমে কিছু তির্যক মন্তব্য করলে ভগৎ-বটুকেশ্বরও শালীন সংযত ভাষায় তার তীব্র জবাব দিয়েছিলেন। দুনিয়া পালটে দেওয়ার সেই আন্তর্জাতিক স্লোগান কণ্ঠে নিয়েই, আমর্ম বিপ্লবী, চিরবিদ্রোহী বীর ভগৎ সিং ও তাঁর সাথী কমরেডরা ফাঁসির দড়িকে বরণ করছেন, হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির সদস্যদের সঙ্গে সেই ছবিটাই তো মানানসই। তাহলে সিনেমা সহ আমাদের জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমে ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির সঙ্গে ‘মেরা রঙ দে বাসন্তী চোলা’ গানটা এমন নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেল কী করে? বাণিজ্যের ছক পেরিয়ে বা সরিয়ে এর ব্যাখ্যাটা কী?
আসলে কারণটা কিছুটা ঐতিহাসিক। অনেকটাই সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, কারণ পাঞ্জাব উত্তর প্রদেশ (তখনকার যুক্তপ্রদেশ) সহ উত্তর ভারতের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামী মহলে এই গানটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। ভগৎ সিং নিজেও গানটি ভীষণ পছন্দ করতেন। ওই গানটি রচনার সঙ্গে কাকোরি মামলার শহীদ বিপ্লবী রামপ্রসাদ বিসমিলের নাম জড়িয়ে ছিল বলেই ভগৎ সিংয়ের পক্ষপাতিত্ব বেশি ছিল কিনা, আমাদের জানা নেই। তবে যতীন্দ্রনাথ সান্যালের লেখা ‘অমর শহীদ ভগৎ সিং’-এ উল্লেখ আছে, ফাঁসির দিন মানে ২৩ মার্চ গোধূলি বেলায় ভগৎ সিংকে নাকি তাঁর জেল কুঠুরিতে বসে খোলা গলায় এই গানটি গাইতে শোনা গিয়েছিল। অন্তত গানের প্রথম দুটি লাইন, বেশ স্পষ্ট শোনা যায়। এই তথ্যসূত্রটিকেই ভগৎ সিংকে নিয়ে বায়োপিকগুলোয় অনেক বেশি নাটকীয়, বীরত্ব ব্যঞ্জক করে তোলা হয়েছে। ফাঁসির মঞ্চ অবধি যাত্রাপথটাই বাসন্তিকার গানে ভরিয়ে তোলা হয়েছে। তবে এই নাটকীয়তা নির্মাণের ব্যাপারটা হয় তো ভগৎ সিংয়ের চরিত্রের সঙ্গে বেমানান নয়। তিনি মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্বপ্নকে জনতার দরবারে নিয়ে যেতে খানিকটা নাটক দরকার। আইনসভায় বোমা ছুঁড়ে, স্লোগান দিয়ে ইশ্তেহার ছড়িয়ে পুলিশের হাতে ধরা দেওয়া থেকে শুরু করে, বিচার চলার সময় আদালত কক্ষে বক্তৃতা, বিপ্লবী স্লোগান, সমবেত স্বদেশী গান-ঔপনিবেশিক বিচার ব্যবস্থার এতদিনকার পোশাকি আচার-সর্বস্বতা আর নিয়মতান্ত্রিকতার বিধির বাঁধনকে প্রতিদিন যেন খানখান করে ভাঙছিল। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বড় সাধের আইনের শাসন আর তার প্রতীক ওই ন্যায়ালয়ের এজলাসকেই ভগৎ সিংয়ের যুবাবাহিনী রাজনৈতিক নাটকের রঙ্গমঞ্চ করে তুলেছিলেন। বিচারের বাণীকে আর নীরবে নিভৃতে চোখের জল ফেলতে হচ্ছিল না। বিচারের প্রহসনকে মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছিলেন ভারতীয় সমাজমুক্তির এই নওজওয়ান ব্রিগেড। বিচারকের রায়দান বা সাজা ঘোষণাকে ঠাট্টা করেই যেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েই গেয়ে ওঠা হচ্ছিল রাজদ্রোহের মন্ত্রসঙ্গীত — ‘সরফরোশি কি তমান্না/ আজ মেরে দিল মে হ্যায়/ দেখ্না হ্যায় জোর কিতনা/ বাজুয়েঁ কাতিল মে হ্যায়!’’ হন্তারক ব্রিটিশ রাজের কবজির জোর দেখতে চাইছে এই ২২-২৪ বছরের নেটিভ ছোকরারা। ক্রুদ্ধ বিচারক আদেশ দিলেন ভগৎ সিংদের মুখ বন্ধ করতে হবে। সরকারকে পুলিশ, আদালত কক্ষেই ভগৎ সিংকে লাঠির আঘাতে প্রায় অচৈতন্য করে ফেলল। তবু গান বন্ধ হল না।
তাই নিখুঁত ঐতিহাসিক বাস্তবের রূপায়ণ না হলেও ‘রঙ দে বাসন্তী চোলা’ ‘কণ্ঠে নিয়ে, ‘দৃপ্ত পায়ে মৃত্যু-মঞ্চ বা ঘাতকভূমির দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে ভগৎ সিং চরিত্রের ঐতিহাসিক মানবিক স্পিরিটের বিশেষ ঘাটতি হয় না। বরং কীভাবে ভগৎ সিং একজন রক্ত-মাংসের বিপ্লবী শহীদ থেকে ক্রমশ পাঞ্জাবী তথা উত্তর ভারতীয় লোক সংস্কৃতির এক কিংবদন্তী চরিত্র হয়ে ওঠেন, সেই প্রক্রিয়াটা আমরা খানিকটা আন্দাজ করতে পারি। ‘মেরা রঙ দে’ গানটায় বার বার বাসন্তী রঙে রাঙিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই বাসন্তী বা গেরুয়া আজকে সঙ্ঘ পরিবারের সংকীর্ণ হিংস্র সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের ব্র্যান্ড লোগো নয়। ভারতীয় ঐতিহ্যে এই রঙটা বরাবর ত্যাগ আর তপস্যার রঙ কোনো দখলদারি, গাজোয়ারি, আধিপত্য বা আক্রমণের নয়। এই ত্যাগ কোনো স্বপ্ন বা আদর্শের জন্য আত্মবিসর্জনও হতে পারে। ভগৎ সিংও তাঁদের আত্মবলিদানকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যুদ্ধের একটা হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। ফাঁসির আগের দিন, ১৯৩১ সালের ২২ মার্চ, একই জেলের বাসিন্দা দ্বিতীয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের লেখা একটা চিঠিতে তিনি পরিষ্কারই জানাচ্ছেন, তিনি যদি সাহসের সঙ্গে ফাঁসির মঞ্চে উঠে দাঁড়াতে পারেন। হাসিমুখেই ফাঁসির দড়ির সম্পর্কে আপন করে নিতে পারেন (বাঙালি পাঠকের স্মৃতিতে এখানে কিশোর ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির অনুষঙ্গ আসবেই), তাহলে গোটা দেশের যুব সমাজের সামনে যেটা একটা উদাহরণ হয়ে থাকবে, তখন দেশজুড়ে দিকে দিকে যে অবাধ্যতার ঢেউ উঠবে ঔপনিবেশিক শাসকের ‘‘শয়তানি শক্তি’’ তার মোকাবিলা করতে পারবে না।
একই সঙ্গে খালসা-শিখ ঐতিহ্যেও এই গেরুয়া বা বাসন্তী রঙ মতাদর্শের জন্য আত্মবলিদানের প্রতীক। তাই তো খালসা বীরের শরীরে জড়ানো থাকে ওই বাসন্তী রঙের এক বস্ত্রখণ্ড’ শহীদী বনা’! এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে এই ‘শহীদ’ শব্দটি কিন্তু আরবি এবং ইসলামি ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশেষ করে কারবালা প্রান্তরের রক্ত সংগ্রামের সঙ্গে শব্দটি সংপৃক্ত। তবু মুঘল শাসকের সঙ্গে যুদ্ধ চালাতে চালাতেও শিখ ধর্মগুরুরা ইসলামি ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকে উঠে আসা এই শব্দটিকেই তাঁদের কৌম-চেতনার অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলেন। রেল স্টেশন রাস্তাঘাট, শহর, জেলার গ্রাম থেকে মুঘলযুগ, ইসলামি সংস্কৃতির এতটুকু গন্ধ, আরবি-ফার্সি সঙ্ঘের সামান্য স্পর্শটুকুও ধর্মান্ধতার সাবান ঘষে, ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়া আজকের হিন্দুত্ববাদী ভাবনা দিয়ে এই বিদ্রোহী ধর্মীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন পরতগুলো মাপা যাবে না। ইতিহাসের এক বিশেষ সময়ে, অখণ্ড উপমহাদেশের এক বিশেষ অঞ্চলে শিখ, ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের লোকবিশ্বাসগুলো কিভাবে এর ওর গায়ে গায়ে লেগে থাকে সেসব বোঝা যাবে না। তাই সঙ্ঘ পরিবার একদা শিখ ধর্মকে সনাতন ধর্মের অঙ্গ বলে দখল করতে গিয়ে মুখ পুড়িয়েছিল। এখন ২৩ মার্চকে ‘আক্রোশ দিবস’ বলে ঘোষণা করে, ভগৎ সিংয়ের উত্তরাধিকারকে কবজা করার সরকারি মতলবও সফল হবে না।
আসলে এখানে লোকসংস্কৃতির অনেকগুলো উপাদান এক জায়গায় মিলে যাচ্ছে। গেরুয়া বা বাসন্তী যেমন শহীদের রঙ, তেমনই দিনবদলেরও। বসন্তের শেষপ্রহরে ঋতুরাজকে বরণ করে নেওয়ার জন্য পাঞ্জাবি লোকসঙ্গীতের যে ধারাটি আছে, সেই ‘বসন্ত’-এর গানেও কিন্তু সমাজবদলের কথা, পৃথিবীকে পালটে দেওয়ার কথা বারবার ঘুরেফিরে আসে। ভগৎ সিংও তো শুধু ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নয়। এই সেকেলে সমাজ ব্যবস্থাটাকেও পালটানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন, সাথীদেরও দেখিয়েছিলেন। বিপ্লব বললে তিনি কী বোঝেন, ভরা আদালতে দাঁড়িয়ে, জজ সাহেবের মুখের ওপর সেকথা শুনিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, শুধু ব্রিটিশকে তাড়িয়েই বিপ্লবের কাজ শেষ হবে না। এই ভূখণ্ড থেকে জাতপাত-শ্রেণি-বর্ণ এবং হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ভৃত্যগুলোকেও তাড়াতে হবে। যৌবনই তো এমন করে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ডাক দিতে পারে। আর বসন্ত তো সেই যৌবনেরই দূত। উপমহাদেশের এই অঞ্চলে যৌবন বারবার আত্মাহুতি দিয়েছে— বিশ্বাসের জন্য, আদর্শের জন্য, অন্যের সুরক্ষার জন্য, পরিবারের জন্য— এমন কী প্রেমের জন্য। বীর রঞ্ঝা, সোনিমাহিওয়ালের অপূর্ণ ভালোবাসার কিস্সা তো এই শহীদ ভূমিতেই রচিত হয়েছে। শহীদের জন্য এখানে শোক নয়, উৎসব হয়। তাদেরকে নিয়ে গান, লোকগাথা, লোক নাটক লেখা হয়। সেখানে অনেক সময়ই ওই শহীদ নায়ক যেন বিয়ের বর। আর মৃত্যু যেন সেজেগুজে থাকা কনে বউটি। বরবেশে শেহরা বা ফুলের টোপর পরে, ঘোড়ায় চড়ে, ‘বারাতি’ বা বরযাত্রীদের শোভাযাত্রা সঙ্গে নিয়ে, তিনি চলেছেন পিয়া-মিলন বা মৃত্যুর সঙ্গে বিবাহের জন্য।
এভাবেই লোক সংস্কৃতিতে শহীদকে হারানোর বেদনা হয়ে ওঠে ভবিষ্যতের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা আর উদ্যাপন। সেই সব লোকায়ত গানে গাথায় শিখ গুরুদের দর্শন, সুফি-ইসলাম আর হিন্দুভক্তি আন্দোলনের ঐতিহ্য প্রায়ই একাকার হয়ে যায়। এই অসাম্প্রদায়িক লোক সংস্কৃতির আবহই শহীদ ভগৎ সিংকেও আপন নায়ক করে নিয়েছিল। তাঁর সাহস বীরত্ব-বিদ্রোহ, চৈত্র-বসন্তকালে তাঁর বলিদান লোককবি-গীতিকারদের কল্পনাকে উদ্ভাষিত করেছিল। তাই তাঁকে নিয়ে লেখা হয় অজস্র ‘বোলি’, ‘ঘোড়ি’, কিস্সা। ভগৎ সিংকে নিয়ে রচিত চার পর্বের ‘মারহি’ বা সমাধি-গীতি তো আস্ত একটা নাটকের মত। সেখানে স্বাধীনতা উত্তরকালে শতদ্রু নদীতীরে ভগৎ সিংয়ের জীর্ণ মলিন সমাধির পাশে সাদা শাড়ি বিধ্বস্ত খোলা চুলে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েন ‘স্বাধীনতার বধূ’ বা ‘আজাদি দি লরি’। ‘বিপন্ন’ স্বাধীনতাকে রক্ষা করার শহীদ ‘স্বামী’র কাছে প্রার্থনা করেন। তখন সেই ভাঙাচোরা অবহেলায় পড়ে থাকা শহীদবেদীর ভিতর জেগে ওঠে শহীদের সত্তা। তীব্র আবেগময় ভাষণে দেশবাসীকে নতুন করে সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করেন। প্রমাণ হয় শহীদের শারীরিক মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু তাঁর সংগ্রামী প্রেরণা উত্তরাধিকার শাশ্বত জাগ্রত।
এভাবেই ভগৎ সিংয়ের ব্যাপারে রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠানের উপেক্ষা বা উপহারের তোয়াক্কা না করেই, পাঞ্জাবের দেশপ্রেমিক আত্মত্যাগের মাটি সেই মাটি থেকে উঠে আসা সংস্কৃতি, মায়ের মতই আগলে রেখেছে ভগৎ সিংয়ের ঐতিহ্যকে। নানারকম বিভেদ আর বিচ্ছিন্নতার শক্তিগুলো চেষ্টা করেও সেই উত্তরাধিকারের নাগাল পায়নি। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় পাঞ্জাবে খালিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন খালিস্তানীদের প্রোপাগান্ডা সেল, আমৃত্যু নিরীশ্বরবাদী, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের অনুগামী ভগৎ সিংকে শিখ ধর্মের আইকন হিসেবে প্রচার করতে চেয়েছিল। হলুদ পাগড়ি পরা, পিস্তলধারী ভগৎ সিংয়ের পোস্টার ছড়িয়ে গিয়েছিল পাঞ্জাবের শহরে শহরে। কিন্তু ভগৎ সিংকে খালিস্তানের তাত্ত্বিক নেতা বানানো যায়নি। ২০০৭ সালে ভগৎ সিংয়ের জন্মশতবর্ষে আরএসএস-এর মুখপত্র ‘পাঞ্চজন্য’-য় তাঁকে ‘ভারতমাতার’ পরম ভক্ত প্রায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী বলে তকমা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল এমনকি এটাও প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল, ‘কেন আমি নাস্তিক’ বইটা নাকি আদৌ ভগৎ সিংয়ের লেখাই নয়। সে চেষ্টা অবশ্যই সফল হয়নি। আসলে সঙ্ঘ পরিবার বুঝে গেছে, ভগৎ সিংয়ের দেশপ্রেম, এমনকি তাঁর ‘ভারতমাতা’কেও কবজা করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ তাদের হিন্দুরাষ্ট্রের ধারণা থেকে ভগৎ সিংয়ের শ্রেণিহীন যথার্থ ধর্ম নিরপেক্ষ স্বপ্নের ভারতের দূরত্ব বহু যোজন। তাই হয়তো মনোহরলাল খট্টরের হরিয়ানা সরকার চণ্ডীগড় আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নাম ভগৎ সিংয়ের জনৈক স্বয়ংসেবক প্রচারক মঙ্গল সাইনির নামে দিতে চেয়েছিল। মূলত বামপন্থীদের নেতৃত্বে সংসদের ভেতরে বাইরে প্রবল বিরোধিতায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তবে ভগৎ সিংকে ব্যবহার করার ইতিউতি অপচেষ্টা চলবেই। তাই সর্তক থাকতে হবে।
Comments :0