Education

১৮০ থেকে ফি হয়েছে ১২৮৫ টাকা, অথচ কলেজে ক্লাসের দেখা নেই

রাজ্য

প্রতীম দে
 

প্রাণীবিদ্যায় ভর্তি হতে লাগত ৬৫০ টাকা। ২০১০-১১-তে।  এখন? চলতি বছরে সেই দক্ষিণ বারাসত কলেজে প্রাণীবিদ্যায় ভর্তি হতে লাগে ৯৫০০ টাকা। 
ফি বেড়েছে ৮৮৫০ টাকা— অঙ্কের হিসাবে প্রায় ১৪ গুণ।
শুধু প্রাণীবিদ্যা কিংবা উদ্ভিদ বিদ্যাই নয়, প্রতিটি বিষয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে গত বারো বছরে ফি বেড়েছে কলেজে ভর্তির ২০১০ সালে ওই একই কলেজে পাশ কোর্সে একজন ছাত্র কিংবা ছাত্রী ১৮০ টাকা দিয়ে ভর্তি হয়েছে। এখন সেই এলাকার কোনও ছেলে বা মেয়েকে ভর্তি হতে গেলে দিতে হচ্ছে ১২৮৫ টাকা। তফসিলি জাতি কিংবা আদিবাসী হলে দিতে হচ্ছে ১২৪৫ টাকা। আবার কারো যদি ভূগোল বা শারীর শিক্ষা থাকে তাহলে তার ক্ষেত্রে ভর্তির ফি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা।
মূলত জয়নগর, কুলতলি, মথুরাপুরের দুটি ব্লকসহ সংলগ্ন সাত-আটটি ব্লকের ছাত্র-ছাত্রীরা ওই কলেজে পড়েন। সুন্দরবন এলাকা। কাজের অভাব আছে। দারিদ্র আছে। সেই প্রতিকূলতাগুলির মধ্যে ফি বৃদ্ধি আরও দুর্গম করেছে এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চশিক্ষার পথ। ছাত্র, অভিভাববক এবং শিক্ষক, অধ্যাপকদের মতে এই ফি বৃদ্ধি ছাত্র-ছাত্রীদের কলেজে পা রাখতে না চাওয়ার অন্যতম কারণ।


এটা তো গেল ভর্তির টাকার কথা। এবার আছে সেমিস্টার ফি। বছরে দুটো করে সেমিস্টার। এতদিন ছিল তিন বছরে ছ’টা সেমিস্টার। এবার থেকে তা বেড়ে হয়েছে আটটা। আর একটা সেমিস্টার পরীক্ষার জন্য দিতে হবে ৬৫০ থেকে ৮৫০ টাকা। বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে ফি কত হবে।
এসএফআই’র রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্যর কথায়,‘‘একদিকে নয়া শিক্ষা নীতির বিপদ। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের লাগাতার ফি বৃদ্ধি করে চলা। কলেজে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হয় না। ছাত্র-ছাত্রীদের নিজেদের কথা বলার কোনও জায়গা নেই। কলেজে কলেজে রয়েছে তৃণমূলের নেতা, কর্মীদের দৌরাত্ম্য। ক্লাস হয় না। এক ভয়ঙ্কর অবস্থায় আমাদের রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থা।’’  
জয়নগরের মতিলাল পাড়ায় থাকেন রামশঙ্কর বিশ্বাস। তাঁর মেয়ে এবার উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছেন। মেয়েকে কলকাতার একটি নার্সিং কলেজে তিনি ভর্তি করিয়েছেন। তাঁর কথায়, ‘‘মেয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছে। ওর ইচ্ছা ছিল নিউট্রিশন নিয়ে পড়ার। কিন্তু আমি রাজি হইনি। পরে ও নিজেও সরে আসে সেই ভাবনা থেকে। কারণ এখন যা অবস্থা তাতে সাধারণ কোনও বিষয় নিয়ে পড়ে কিছু হবে না।’’
এই পরিস্থিতিতে কী অবস্থা কলেজগুলির? উদাহরণ হতে পারে বুড়ুল কলেজ। চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম সংগঠক শহীদ অনুরূপ চন্দ্র সেনের নামঙ্কিত এই কলেজ গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল কৃষক আন্দোলনের নেতা কমরেড পলাশ প্রামাণিকের। সেই কলেজের হাল কী?


অনার্স এবং পাশ কোর্স মিলিয়ে ওই কলেজের মোট আসন সংখ্যা ১৪০০। চলতি বছর এখনও পর্যন্ত ভর্তি হয়েছেন ৫৭১ জন। অর্থাৎ ৫০%-র কম। বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মতো একাধিক বিষয়ে ফাঁকা রয়েছে আসন। কলেজের অধ্যক্ষ গোপালদেব কণ্ঠ বলেন, ‘‘বেশ কয়েক বছর ধরেই গোটা রাজ্যে এই ছবি দেখা যাচ্ছে। আমরা তার থেকে আলাদা নই। আমাদের ধারণা তিন বছরের জায়গায় চার বছরের স্নাতক হওয়ার ফলে অনেকে আর্থিক কারণে পিছিয়ে আসছেন। ছেলেদের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বেশি।’’
তাঁর কথায়, ‘‘জেনারেল বিষয় নিয়ে অনেকে পড়তে চাইছে না। পড়ুয়াদের মধ্যে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ইতিহাস, বাংলা নিয়ে চার বছর পড়ে কিছু হবে না। তার থেকে কারিগরি নিয়ে পড়লে কাজ হবে।’’
ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে এই ধারণা তৈরি হয়েছে নয়া শিক্ষা নীতি ঘোষণার পর। সেই শিক্ষানীতি মেনেই রাজ্যে পড়াশোনা শুরু হচ্ছে। তার উপর স্কুল শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, দীর্ঘদিন কোনও নিয়োগ না হওয়া এই ধারণাকে আরও প্রবল করেছে। 


তবে কলেজগুলিতে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা কমতে শুরু করেছে বেশ কয়েক বছর। যেমন দক্ষিণ বারাসতের ধ্রুবচাঁদ হালদার কলেজ। জয়নগর, সুন্দরবন লাগোয়া অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীরা এই কলেজে। সেখানে গত তিন বছরে গড়ে ১০০০ করে কমেছে পড়ুয়া সংখ্যা। ২০২০ তে মোট ভর্তি হয়েছিল ৩৫৪৫ জন। এই ব্যাচ থেকে তৃতীয় বর্ষে ৬ষ্ঠ সেমিস্টারের পরীক্ষা দিয়েছে ২১০০ জন। ২০২১-এ মোট ভর্তি হয় ৩৮৪০ জন। এর মধ্যে দ্বিতীয় বর্ষে চতুর্থ সেমিস্টার পরীক্ষা দিচ্ছে মোট ২৫০৪। ২০২২-এ মোট ভর্তি হয় ৩৮০০। এদের মধ্যে প্রথম বর্ষে দ্বিতীয় সেমিস্টার দিচ্ছে মোট ২৯০৭ জন। ২০২৩ সালে কতজন ভর্তি হয়েছে বা কত আসন খালি রয়েছে তার কোনও তথ্য এখনও পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি কলেজ কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে। মাত্র তিন দফায় মেধা তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সুন্দরবন মহবিদ্যালয়, পাথরপ্রতিমা মহাবিদ্যালয়, শিবানী মহাবিদ্যালয়, সাগর মহাবিদ্যালয়ের মতো জেলার প্রতিটি কলেজেই এক ছবি। 
এই কলেজের এসএফআই নেতা অভিজিৎ হালদারের কথায়, টাকার অভাবে যেমন কলেজ মাঝ পথে ছাড়ছেন অনেকে, তেমন কলেজে ক্লাস না হওয়ার জন্যও অনেকে হারিয়ে ফেলছে লেখাপড়া করার ইচ্ছা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কলেজের এক ছাত্র বলেন, ‘‘পাশ কোর্সের কোনও ক্লাস হয় না। বাবা মা অনেক কষ্ট করে টাকা জোগাড় করে কলেজে ভর্তি করিয়েছেন। ক্লাস হয় না বলে যাই না।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment