দুর্নীতি ও কালো টাকা রুখতে ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাত ৮টা নাগাদ নোট বন্দি (Demonetization) ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী(PM Narendra Modi)। তারপরের ইতিহাস কারোরই অজানা নয়। এক সন্ধায় বাতিল হয়ে যায় পুরনো ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট। চরম হয়রানির শিকার হয় সাধারণ মানুষ। ব্যাঙ্ক ও এটিএম’র বাইরে দীর্ঘ লাইন। সমস্ত কাজ বাদ দিয়ে সাধারণ মানুষের তখন কাজ ছিল একটাই ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে টাকা বদলানো। ব্যাঙ্কের লাইনে দাড়িয়ে মৃত্যুও ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন ‘ঘরে ঘরে’ যে টাকা কালো ঢুকে ছিল তা এবার ধরা পড়বে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রীর সে ধারনা ও কথা সম্পূর্ণ মিথ্যে প্রমানিত হয়। সরকারি হিসেব অনুযায়ী ৯৯শতাংশ টাকাই ব্যঙ্কে জমা পড়ে। অর্থাৎ সরকারি সিদ্ধান্ত ডাহা ফেল হয়।
নোট বন্দির সারাসরি বিরোধিতা করেছিল সিপিআই(এম) (CPIM)তাদের দাবি ছিল যারা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তারা বাড়িতে টাকা রাখে না। বরং সম্পত্তি, শেয়ারে, মিউচুয়াল ফান্ড বা সোনায় বিনিয়োগ করেন। নোট বন্দির সিদ্ধান্ত মানুষের হয়রানি বা মানব সম্পদ নষ্ট করা ও সময় নষ্ট করা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেসময় বিরোধিরা দাবি করে মোদীর এই হঠকারি সিদ্ধান্তের ফলে দেশের ছোট ব্যবসায়ীদে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়েছে। বহু মানুষের কাজ চলে গিয়েছে শুধু সরকারের এক হটকারি সিদ্ধান্তের জন্য।
সোমবার নোটবন্দিকে ‘বৈধ’ বলে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে। ‘গ্রাউন্ডস ওফ প্রোপোর্শনালিটির’ (Grounds of Proportionality)ভিত্তিতেই বৈধ বলে স্বীকৃতি দিয়েছ ৪:১ বিচারপতির বেঞ্চে। ওই পাঁচ বিচারপতির মধ্যে চারজন নোটবন্দির পক্ষে ও একজন বিচারপতি বিপক্ষে রায় দেন। বিচারপতি এস এ নাজির, এ এস বোপান্না ও বি আর গাভাই নোটবন্দির সপক্ষে ও বিচারপতি বি ভি নাগরত্ন (B V Nagarathna) নোটবন্দি বিরোধি রায় দেন। নাগরত্নের দাবি কেন্দ্র যে উপায়ে নোটবন্দি করেছে তা অযৌকক্তিক ও অবৈধ। সংসদে আইন পাশ করিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার নোটবন্দির সিদ্ধান্তে আসতে পারত। তাঁর আরও সংযোজন ক্ষমতার ব্যবহার করে মাত্র ২৪ ঘন্টার মধ্যে নোটবন্দির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও আদালতে রিজার্ভ ব্যঙ্কের যে নথি জমা করেছে তাতে বলা হয়েছে ‘কেন্দ্রের ইচ্ছায়’ নোটবন্দি করা হয়েছে অর্থাৎ রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধীন মতামতের ভিত্তিতে হয়নি। রায়দানের সময় এই যুক্তিগুলোই তুলে ধরেন বিচারপতি নাগরত্ন। নোট বন্দির সমপক্ষে যারা রায় দিয়েছেন তাদের দাবি নোটবন্দির ফলে কি হয়েছে বা হয়নি তার ভিত্তিতে প্রক্রিয়াটিকে ভুল বলা যাবে না। এছাড়াও রিজার্ভ ব্যঙ্কের (Indian Reserve Bank) সঙ্গে দীর্ঘ ছয় মাস আলোচনার পর নোটবন্দির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় সুতরাং পদ্ধতিগত ত্রুটির যুক্তিও এক্ষেত্রে খাটে না বলে মত তিন বিচারপতির।
নোটবন্দির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে ৫৮টি পিটিশন দায়ের করা হয়েছিল। আবেদনকারীদের যুক্তি, সরকার সঠিক পরিকল্পনা করে এই সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং অবিলম্বে এই সিদ্ধান্ত বাতিল করা উচিত। সরকারের পাল্টা যুক্তি ছিল, বাস্তবে এই সিদ্ধান্তকে বাতিল করা সম্ভব নয়। নোটবন্দির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হলে ‘সময়ের পিছনে গিয়ে’ বাতিল করতে হবে দাবি করেন কেন্দ্রের আইনজীবী।
১। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানিয়েছিলেন নোটবন্দির প্রধান উদ্দেশ্য তিনটি। এক, কালো টাকা উদ্ধার। দুই, জাল নোট ধরা। মাদক এবং সন্ত্রাসবাদের চক্র ভেঙে দেওয়া। তিন, নগদে লেনদেন বন্ধ করে ‘ক্যাশলেশ’ লেনদেন বাড়ানো। অর্থনীতিতে নগদের আয়তন কমিয়ে দেওয়া।
২। সরকারের বক্তব্য ছিল, বড় নোট, মানে ৫০০ এবং ১০০০, তাতেই কালো টাকা ধরে রাখা আছে। বাতিল ঘোষণার পর নতুন নোটের জন্য পুরনো নোট ব্যাঙ্কে জমা দিতে হবে। সেই টাকা হিসেবের খাতায় চলে আসবে। ফলে কালো টাকার অনেকটা ব্যাঙ্কে জমাই পড়বে না। কেবল নোটবন্দি করেই ৩-৪ লক্ষ কোটি মূল্যের কালো টাকা বরবাদ করা যাবে।
৩। তা হয়নি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য জানাচ্ছে মুদ্রাব্যবস্থায় মানুষের হাতে থাকা টাকার ৯৯ শতাংশেরও বেশি ফের ব্যাঙ্কে জমা পড়েছিল। বড় নোটের মোট অর্থমূল্য ২০১৬’তে ছিল ১৫.৪১ লক্ষ কোটি টাকা। ব্যাঙ্কে ফিরে এসেছিল ১৫.৩১ লক্ষ কোটি টাকা।
৪। অর্থনীতিবিদরা মনে করাচ্ছেন যে কালো টাকার সামান্য অংশই নগদে থাকে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তা জানিয়েছে। কালো টাকা উদ্ধারের চালু পন্থাও রয়েছে। তা ছাড়া, যে দুই নোট বাতিল করা হয়েছিল, ৫০০ এবং ১০০০, তা চালু সব নোটের মোট মূল্যের ছিল প্রায় ৮৬ শতাংশ। বহু সাধারণ মানুষের কাছেও এই নোট ছিল। তাকে বড় মূল্যের নোট ধরাই ঠিক হয়নি। ‘বহুমূল্য’ বলে ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে ২০০০ টাকার নোটই বা আনা হলো কেন।
৫। মানুষের হাতে থাকা নগদের অর্থমূল্য কি কমেছে? আদৌ না। ২০১৬’র ৮ নভেম্বর নগদের মোট মূল্য ছিল ১৭.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২২’র ২১ অক্টোবর তার মূল্য ৩০.৮৮ লক্ষ কোটি টাকা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য জানাচ্ছে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থমূল্যে ৭২ শতাংশ বেড়েছে।
৬। ১৯৪৬ এবং ১৯৭৮ সালেও নোটবন্দি হয়েছিল। তখন ১০ হাজার এবং ৫ হাজার টাকার নোট চালু ছিল। বাতিল হয়েছিল সেই অঙ্কের নোট। একেবারেই সামান্য অংশের হাতে কেবল এই নোট থাকায় অর্থনীতিতে প্রভাব পড়েনি।
৭। প্রশ্ন আছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্বাধিকার নিয়েও। দেশে মুদ্রাব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। নোটবন্দির সময় বোর্ড অব গভর্নর ২১ জনের হলেও ছিলেন মাত্র ১০ জন। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরামর্শ কি নিয়েছিল সরকার, সেই উত্তরও নেই।
৮। অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, নোটবন্দি করে অর্থনীতি বরবাদ হওয়া মোটেই আশ্চর্যের নয়। এই পদক্ষেপ ব্যর্থ হওয়ারই ছিল। ধরা হয়েছিল নগদেই কালো টাকা থাকে। অনুমান একেবারেই ভুল। অসংগঠিত ক্ষেত্রে নগদের বিপুল প্রয়োজন মাথাতেই রাখা হয়নি। তার ওপর এমনভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে সাধারণ মানুষ বা ব্যাঙ্ক কারও কোনও ধারণাই ছিল না।
Comments :0