সংসদে বিরোধী দলগুলি নির্বাচন কমিশনের তৈরি ভোটার তালিকার গরমিল নিয়ে আলোচনা করার জন্য নোটিস দিয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক বিষয়, বিরোধী দলগুলি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য যে কোনও বিষয়ে আলোচনা করে। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়েই উঠেছে এজন্যই। সংসদেই তো মানুষের সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু শাসক দল তাতে রাজি নয়। কেন? তাহলে কি লুকোবার মতো কিছু আছে? আলোচনা হলে, সরকার বা কমিশনের কোনও কারচুপি দেশের মানুষের সামনে চলে আসার সম্ভাবনা রয়েছে? না হলে সংসদে বিতর্কে ভয় কিসের? মোদী সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত আইন পালটে কমিশন গঠন করায় এই প্রশ্ন আগেই উঠেছিল।
নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ নিয়ে অনেকদিন ধরেই বিতর্ক চলছে। বিরোধী দলগুলো এবং নাগরিক সমাজও এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অভিযোগ, এই নিয়োগ প্রক্রিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় কমিশনের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকা খুব স্বাভাবিক। বর্তমান ব্যবস্থায়, মুখ্য নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিয়োগকর্তা হওয়ায়, সরকার নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের নিয়োগ করে নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করতেই পারে। ফলে, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ভারতের সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদ অনুসারে, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনার জন্য ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি ‘স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান’। শুরুতে, নির্বাচন কমিশন ছিল এক সদস্যের সংস্থা। সেই সময়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারই একমাত্র সদস্য ছিলেন। পরবর্তীতে, ১৯৮৯ সালের নির্বাচন কমিশনার সংশোধনী আইনের পর একজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং দু’জন নির্বাচন কমিশনার নিয়ে মোট ৩ সদস্য বিশিষ্ট এখন নির্বাচন কমিশন। এই পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য ছিল কমিশনের কাজ আরও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা এবং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে আরও নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ করা।
নরেন্দ্র মোদী সরকার ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ সংক্রান্ত আইনের পরিবর্তন করে ২০২৩ সালে। এই আইনটি ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগ, পরিষেবার শর্তাবলী এবং কার্যকাল) বিল ২০২৩’ নামে পরিচিত। এই বিলটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সংসদে পাশ হয় এবং রাষ্ট্রপতির সম্মতি পাওয়ার পর আইনে পরিণত হয়। আগে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এই নিয়োগ কমিটির সদস্য ছিলেন। নতুন আইনে, প্রধান বিচারপতির পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এই কমিটির সদস্য হবেন। ফলে নিয়োগ কমিটিতে এখন প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আছেন, অর্থাৎ পুরোপুরি সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থায় পরিণত করা হয়েছে কমিশনকে। এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়। ২০২৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয়, প্রধানমন্ত্রী, লোকসভার বিরোধী দলনেতা এবং ভারতের প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কমিটি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ করবে। কিন্তু, নরেন্দ্র মোদী সরকার ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার (নিয়োগ, পরিষেবার শর্তাবলী এবং কার্যকাল) বিল ২০২৩’ নামে একটি নতুন আইন পাশ করে সুপ্রিম কোর্টের এই রায়কে পালটে দেয়। বর্তমানে এই নতুন আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে আবার মামলা হয়েছে, যা আদালত গ্রহণও করেছে। শুনানি শুরুর আগেই তড়িঘড়ি অমিত শাহ’র ঘনিষ্ঠ এক আমলাকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার করে, কমিশনের নিরপেক্ষতাকেই বড় প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী নিজেই। এখন সংসদে ভোটার তালিকা প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনায় বাধা দিয়ে, দেশবাসীর সন্দেহকে আরও বাড়াচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী নিজেই। ফলে কথা উঠছে, ‘ডাল মে জরুর কুছ কালা হ্যায়’। এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা এবং স্বাধীন সত্তাকে রক্ষা করতেই হবে, দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হলে।
Comments :0