দেবীদাস আঢোড়, মুন্টেগাঁও (নাসিক)
কেউ বলছে আগুন লেগেছে সাড়ে দশটাতেই। আবার কারো দাবি, বয়লারের কাছেই একটা জায়গায় আগুন লেগেছে সাড়ে এগারোটায়। প্রথমে কোম্পানির লোক ভেবেছিল, নিজেরাই নিভিয়ে ফেলবে। কিন্তু দেখতে দেখতে আগুন আরও ছড়িয়েছে। ভয়াবহ আকার নিয়েছে। গেটের মুখটাতেই লেলিহান শিখা জ্বলতে থাকা ভেতারে থাকা মানুষগুলো বের হতে পারছিলেন না। জনা দু-চারেক শেডের মাথায় চড়ে বাইরে ঝাঁপ দিয়েছেন, বাঁচার চেষ্টায়। কিন্তু ভেতরে শ্রমিকদের কী অবস্থা দুপুর দু’টো পর্যন্ত কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছিল না। পরে প্রশাসনিক স্তর থেকে জিন্দালদের এই কেমিক্যাল ফ্যাক্টারিতে বছরের প্রথম দিনের আগুনে মৃত্যুর কথা কবুল করা হলো। প্রথমে মাত্র একজনের মৃত্যুর কথা বলা হলেও রাতে সংখ্যা বাড়িয়ে দুই করা হয়েছে। মুম্বাই-আগ্রা হাইওয়ের উপর মুন্টেগাঁওয়ের এই কারখানায় এদিনের আগুনে যদিও মৃতের সংখ্যা আরও আরও অনেক বলে দাবি করছেন স্থানীয় মানুষজন। কারণ ঘটনার সময় কারখানায় অন্তত একশো শ্রমিক কাজ করছিলেন। তাঁদের অনেকেই হয়তো আর বেঁচে নেই। কোম্পানি আর প্রশাসন উভয়েই চেপে যাচ্ছে, এমনই অভিযোগ এই মুন্টেগাঁওতে। এমনকি ৩০ কিলোমিটার নাসিকের হাসপাতালে আহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বললেও একই কথা শোনা যাচ্ছে। রাতের দিকে সরকারিভাবে জানানো হলো, হাসপাতালে ১৭জন ভর্তি। তার মধ্যে চারজন শ্রমিকের অবস্থা সঙ্কটজনক।
এদিন সকালে সাড়ে এগারোটা নাগাদ এক বিকট জোরালো শব্দে কেঁপে ওঠে গোটা মুন্টেগাঁও গ্রাম আর আশপাশের বেশ কিছু গ্রাম। বাইরে বেরিয়ে দেখা গেল কালো ধোঁয়ায় ঢেকে গেছে জিন্দাল পলি ফিল্ম ফ্যাক্টরির ওপরটা। কাছে গিয়ে দেখা গেল গল গল করে আগুন বেরিয়ে আসছে সেই ধোঁয়ার সঙ্গে। লোকজন বলছে বয়লারটা ফেটে গেছে। কেউ কেউ বলছেন, আগুন অনেক আগেই লেগেছে। কিন্তু দমকল ডাকেনি। এখন খবর দিয়েছে। বাইরে তখন কয়েকশো মানুষের ভিড়। আশপাশের গ্রামের মানুষের সঙ্গে শিফ্ট শেষে অন্য কারখানার শ্রমিকরাও চলে এসেছেন। কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে আগুন আর ধোঁয়া দেখা ছাড়া কেউই কিছু করতে পারছেন না। কারণ কারখার মূল গেটটাই আটকানো। আগুন জ্বলছে সেইখানটাতেই। ভেতরের শ্রমিকদের ওই আগুন পেরিয়ে বেরোনো সম্ভব নয়। কারো পক্ষে ভেতরে ঢোকাও অসম্ভব। কয়েক শ্রমিককে দেখা গেল কারখানার শেডের মাথায় উঠে গেছেন, সেখান থেকে জনা কয়েক লাফও দিচ্ছেন পাশের ঝোপের মধ্যে। এর খানিক পরে দমকল পৌঁছাল। পুলিশ এল। আরও কিছুক্ষণ পর এল বিপর্যব মোকাবিলা বাহিনীও। শুরু হলো আগুন আয়ত্ত্বে এনে আটকে পড়া শ্রমিকদের উদ্ধারের কাজ।
বেলা দু’টো নাগাদ এক মহিলা শ্রমিকের দগ্ধ দেহ নিয়ে যেতে দেখা গেল। মাঝে মধ্যেই স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জখমদের। ঘন ঘন অ্যাম্বুলেন্স আসছে আর বেরিয়ে চলে যাচ্ছে নাসিকের দিকে। বিকেলের দিকে জানা গেল, আহতদের সকলকেই নাসিকের হাসপাতালগুলিতে ভর্তি করা হয়েছে। নাসিক জেলার ইগতপুরী তালুকের ওই ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে ডিভিসনাল রেভিনিউ কমিশনার রাধাকৃষ্ণ গামে সাংবাদিকদের জানালেন, ‘বিস্ফোরণ থেকে আগুন লেগেছিল। ঘটনায় একজন মহিলা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। ১৪জন জখম শ্রমিককে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে চারজনের অবস্থা গুরুতর।’ সন্ধ্যার দিকে খবর মিলল, নাসিকের সুযশ হাসপাতালে ভর্তি আরেক মহিলারও মৃত্যু হয়েছে। মৃতের সংখ্যা তাতে বেড়ে দুই হলো। গামের দাবি, রবিবার আর বছরের প্রথম দিন বলে আজ কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কম ছিল। এমনিতে জনা ২০-২৫ শ্রমিক থাকে। কিন্তু আজ অনেক কম ছিল। কারখানা চত্বরে লম্বা লম্বা ঘাস আর চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন বড় আকার নিয়েছে। আমাদের মূল লক্ষ্যই হলো আগুনটা আগে নেভানো। সেটা করা গেলে আগুন লাগার কারণ জানা যাবে। তার জন্য সময় লাগবে।’
প্রথম দিকে শোনা যাচ্ছিল, আগুন ছড়াতে ছড়াতে বয়লারে চলে আসায় বিস্ফোরণ হয়েছে। রাতের দিকে প্রশাসনের এক উচ্চ পদস্থ আধিকারিক সেই সম্ভাবনা প্রায় উড়িয়ে দিয়েছেন। স্টিম বয়লার ডিরেকটরেটের অধিকর্তা দাভল অন্তপুরকারের দাবি, ‘ইগতপুরীতে জিন্দালদের ওই কারখানায় পাঁচটার মধ্যে তিনটি ওয়েস্ট হিট রিকভারি ব্যবস্থা রয়েছে। থার্মাল ফ্লুইডে চলে। এটা স্টিম তৈরির জন্য কোনো দাহ্য উপকরণ লাগে না।’ তাই তাঁর মনে হয়, ওই বয়লারে বিস্ফোরণ হয়নি।
বয়লার ফাটুক না ফাটুক, আগুনে লেগেছে, মানুষ মারা গেছে। মৃত দুই মহিলা শ্রমিক। এরা দু’জনেই অন্য রাজ্য থেকে আসা শ্রমিক। নাসিকের হাসপাতালে ভর্তিদেরও বেশিরভাগই তাই। এরই মধ্যে মৃতের সংখ্যা আরও বেশি বলেই স্থানীয় স্তরের অভিযোগ।
এই অভিযোগ, আর পালটা সাফাইয়ের মধ্যে এদিন সন্ধ্যায় ঘটনাস্থলে এলেন মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে। সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ভারতী পাওয়ার। আশ্বাস দিলেন, ‘উদ্ধার কাজের জন্য যা প্রয়োজন সরকার তা করে দেবে। কোনও ঘাটতি হবে না। আমাদের অফিসাররা, জেলাশাসক, পুলিশ সুপার সবাই রয়েছে। ওরাই সব দেখবেন। এমনিতে অটোমেটিক প্ল্যান্ট। তাই বিস্ফোরণের সময় শ্রমিক সেখানে কম ছিল।’
আর মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভারতী পাওবার তখন সংবাদ মাধ্যমকে বাইট দিচ্ছেন, স্টেট ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এসডিআরএফ) ও ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্সকে ঘটনার কথা জানানো হয়েছে। এসডিআরএফ-র টিম ঘটনাস্থলে এসে গেছে। বললেন, ‘বিভিন্ন হাসপাতাল ও নাসিক জেলা হাসপাতাল মিলিয়ে অন্তত ১০০ বেডি তৈরি রাখা হয়েছে।’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কথাতেই হতাহতের সংখ্যা নিয়ে যথেষ্টই ধোঁয়া রয়ে গেল। প্রশ্ন উঠছে আহত যদি জনা সতেরোই হবে, তাহলে হাসপাতালের ১০০ বেড কেন তৈরি রাখা হচ্ছে!
Comments :0