Editorial 10 jan 2023

গরিবিয়ানার আড়ালে

সম্পাদকীয় বিভাগ

দারিদ্র বা গরিবি নির্ধারণের জন্য অর্থনীতিতে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে ভিন্ন ভিন্ন সূচক বা মাপকাঠি ব্যবহার করা হয়। কখনও সেটা হয় মাথাপিছু দৈনিক খাদ্যগ্রহণ বা ক্যালরি গ্রহণের ভিত্তিতে। আবার কখনও হয় মাথাপিছু দৈনিক আয় অথবা খরচ করার ক্ষমতার ভিত্তিতে। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলের গরিবি মাপার জন্য কোনও সূচক বা মাপকাঠি আছে বলে কারও জানা নেই। তবে অনেক দলই নিজেদের গরিব দল বলে দাবি করে থাকেন। এরাজ্যের শাসক দল তৃণমূলের সর্বাধিনায়িকা প্রায়শই দাবি করে থাকেন তাঁর দল নাকি নিতান্তই গরিব। টাকার অভাবে অনেক কষ্টে নাকি তাঁকে দল চালাতে হয়। এমন কথাও একাধিকবার বলেছেন তিনি নাকি ছবি এঁকে বিক্রি করে এবং নিজের লেখা বই বিক্রি করে দল চালান। একবার এমন কথাও তিনি বলেছিলেন ক্যানভাসে সাঁটাসাঁট তুলির টান দিয়েই ছবি এঁকে ফেলতে পারেন। সেই ছবি নাকি লক্ষ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়। বিক্রির টাকায় দল চলে। অনেক আগে নেত্রীর এমন দাবি অংশত সত্য ছিল। কারণ, তখন ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’ অর্থাৎ সুদীপ্ত সেনরা ছিলেন। তখন নেত্রীর ছবি কেনার জন্য গুণমুগ্ধ স্বার্থ সন্ধানীর অভাব ছিল না। শুধু লক্ষ নয় কোটিতেও দিব্যি বিক্রি হয়ে যেত ছবি। এমন বিপুল অর্থমূল্যে কেনা ছবিগুলির ঠাঁই হয়েছে কোথায় কারও জানা নেই। বিত্তবান ক্রেতাদের ড্রয়িং রুমে তো বটেই, এমনকি তাদের গুদামেও ছবিগুলির জায়গা হয়নি। পরবর্তীকালে তাঁর আঁকা ছবি কে কোথায় কত টাকায় কিনছে তেমন তথ্য তিনি দেননি। গোপনে লুকিয়ে চুরিয়ে ছবি বিক্রি হয় কিনা সেটাও জানার উপায় নেই। তবে সরকারি হুকুমে এবং দলীয় চাপে তাঁর লেখা বই দিব্যি বিক্রি হয়। সরকারি গ্রন্থাগারে তাঁর বইয়ের ছড়াছড়ি। নেত্রীর দাবি দল গরিব। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে আয়-ব্যয়ের যে হিসাব দলের পক্ষ থেকে প্রতিবছর জমা দেওয়া হয় তার থেকে একথা ভুল করে উচ্চারণ করারও সুযোগ নেই যে তৃণমূল গরিব। দলটা এতটাই গরিব যে নেত্রীকে কলকাতা থেকে চন্দননগর যেতেও হেলিকপ্টারে ছাড়া চলে না। আর ভাইপো সাংসদের শিলিগুড়ি যেতে ভাড়া করা বিলাসবহুল চাটার্ড বিমান লাগে। গত চার বছরে গরিব দলের পিসি-ভাইপো মিলে হেলিকপ্টার চড়েই খরচ করে ফেলেছেন ১০৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে গত আর্থিক বছরে খরচ প্রায় ৩৬ কোটি টাকা। একইভাবে দলের আয়-ব্যয়ের সরকারি দাবি থেকে নেত্রীর দাবি মান্যতা পায় না। বরং এটাই প্রমাণিত হয় দলটি আদৌ গরিব নয়। দেশের সবচেয়ে বিত্তশালী দলগুলির মধ্যে অন্যতম। তেমনি এটাও প্রমাণ হয়ে যায় দলের আয় ছবি বা বই বেচে হয় না, দলের টাকার আসল উৎস দেশের বিত্তশালী ও কর্পোরেট সংস্থা। যেমন, ২০২১-২২ সালে দলের মোট আয় ৫৪৫.৭৪ কোটি টাকার মধ্যে ৫১৮ কোটি টাকাই এসেছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কর্পোরেটের কাছ থেকে। বাকিটা সাংসদ-বিধায়কদের কাছ থেকে এবং অনুদান থেকে। মোদী সরকার ২০১৮ সালে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে রাজ‍‌নৈতিক দলগুলির টাকা সংগ্রহের ব্যবস্থা চালু করে। এই ব্যবস্থায় কে কাকে টাকা দিচ্ছে সেটা গোপন থাকে। অর্থাৎ কর্পোরেটের টাকায় দল চালানোর অভিনব ব্যবস্থা এই বন্ড। এখনও পর্যন্ত যে ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বন্ড বিক্রি হয়েছে তার সিংহভাগটাই গেছে বিজেপি’র ঘরে। তারপরেই আছে তৃণমূল। বিজেপি’র পরই কর্পোরেটের পছন্দের দল তৃণমূল। অবশ্য এই বিপুল টাকার সবটাই কর্পোরেট থেকে আসে কিনা সন্দেহ আছে। গুচ্ছ গুচ্ছ দুর্নীতি, ঘুষ, তোলা, লুটের টাকা শত শত‍‌ শিখণ্ডি সংস্থার ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে নির্বাচনী বন্ড রূপে দলের তহবিলে ঢুকছে না তো?
 

Comments :0

Login to leave a comment