Lalan Fakir

সার্ধদ্বিশতবর্ষে লালন সাঁই ভেদবুদ্ধির বিরুদ্ধে চেতনা জাগানোর কারিগর

বিশেষ বিভাগ

সুব্রত দাশগুপ্ত

‘‘এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে / যেদিন হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খৃষ্টান / জাতি-গোত্র নাহি রবে।’’- আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে বাংলার বুকে জন্ম নেওয়া এক বাউল-সাধকের এই গানে উদ্বেল হয়েছিল বাংলার গ্রামসমাজ। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এসে, আজও সেই ভেদাভেদহীন মানব সমাজ সৃজনের স্বপ্ন বুকে বয়ে পথ হাঁটছে অজস্র সহস্র পদাতিক। সৃষ্টির আদি পর্বে যে বিভেদের অস্তিত্ব  ছিল না, সেই বিভেদের সৃষ্টি তো মু্ষ্টিমেয়র ভেদবু্দ্ধি আর স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্য থেকেই। আবার মনুষ্যসৃষ্ট এই বিভেদের বিরুদ্ধে যুগে যুগে মানুষই সোচ্চার হয়েছে, তর্জনী তুলেছে।
অবিভক্ত বাংলায় যে অগ্রণী মানুষরা তাঁদের সৃষ্টির মাধ্যমে সামাজিক বিভেদবৈষম্যকে রুখে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, তাঁদেরই অন্যতম, উদ্ধৃত গানের রচয়িতা ফকির লালন সাঁই। তাঁর জন্মকাল, জন্মস্থান, গোত্র, সম্প্রদায় নিয়ে গবেষকদের মধ্যে নানা মত রয়েছে। কিন্তু এ'বিষয়ে সকলেই একমত যে, লালন কেবলমাত্র একজন বাউল শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন একজন মানবতাবাদী স্রষ্টা। সমাজের প্রান্তিক মানুষের জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা- হতাশা-অসহায়তা, তাদের উপর ঘটে চলা অবিচার-অত্যাচার, সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসা, এমন কি শোষক-শোষিতের শ্রেণিদ্বন্দ্বকেও পরম মমতায় এবং অত্যাশ্চর্য সংবেদনশীলতায় লালন ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর একের পর এক গানে। জাতি-ধর্ম-সম্প্রদায়গত বিভাজনকে সমূলে উচ্ছেদ করতে সচেষ্ট, শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন কবি ও স্রষ্টা হিসাবে লালন সাঁই মহত্তম শিল্পীর মর্যাদা দাবি করেন। তিনি লোক-কবি এবং অবশ্যই সর্বহারা শ্রেণির প্রতিনিধি। বিষয়বিষবিকারজীর্ণ এই সমাজব্যবস্থায় জাতপাতের ধুয়ো তুলে যারা নিজেদের আখের গুছানোর খেলায় মত্ত তাদের বিরুদ্ধে লালন এক দৃপ্ত প্রতিবাদের প্রতীক।

প্রামাণ্য মত হিসাবে লালনের জন্ম ১৭৭৪ সালে। সেই হিসাবে বর্তমান বছরটি তাঁর জন্মের সার্ধদ্বিশতবর্ষ। তাঁর জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহের হরিশপুর গ্রাম। আর তাঁর জাতি পরিচয়? এ'নিয়ে উত্থাপিত প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলে গেছেন- ‘‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে / লালন বলে জাতের কি রূপ / দেখলাম না তা নজরে’’ | বিশ্বমানবতার জয়গান গেয়ে যে মানুষ জাত-ধর্ম-বর্ণ-গোষ্ঠীর ভেদাভেদকে তুচ্ছজ্ঞান করেছেন, তাঁর জাতবিচার করে কোন কাজী, কোন শাস্ত্রী ? তাঁর দীর্ঘ জীবনের  দৈনিক যাপন ও কর্মের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, তাঁর ধর্ম ছিল ‘মানবতা’, আর জাত ‘মনুষ্যত্ব’।
লালন ফকিরের জন্মের সময়টার দিকে নজর করলেই আমরা বুঝতে পারবো সেই সময়কার বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্কটের কথা। তাঁর জন্মের মাত্র ১৭  বছর আগে, ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার পরাজয় হয়। মীরজাফরদের  বিশ্বাসঘাতকতায় দেশ হলো ইংরেজদের অধীন। একদিকে শুরু হলো ইংরেজ শাসকদের অবাধ লুট, অন্যদিকে দেশীয় জমিদার-সামন্তদের মাত্রাহীন শোষণ। বিপর্যস্ত মানুষ, ধ্বংসের মুখে জীবন-জীবিকা। শাসন-শোষণকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্যই তীব্র হলো জাত-পাত-ধর্মকেন্দ্রিক সামাজিক বিভাজন। এক্ষেত্রে শাসক-শোষকের সঙ্গী হয়ে উঠল মোল্লাতন্ত্র আর পুরোহিততন্ত্র। ধর্মরক্ষার নামে তৈরি হলো নানা বিধান, অনুশাসন। মানুষ অতিষ্ট, কিন্তু অসহায়। এই সামাজিক প্রেক্ষাপটে লালনের বড় হয়ে ওঠা। চলার পথে তিনি হৃদয় দিয়ে অনুভব করলেন যুগের যন্ত্রণা আর সমাজের সঙ্কটকে। গানকে হাতিয়ার করে শুরু হলো ধর্মীয় বিভাজনের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই। বাউল গানে  যুক্ত হলো এক নতুন রচনাশৈলী, এক নতুন আঙ্গিক। বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদকর্তা চণ্ডীদাস যেমন বলেছিলেন— ‘‘সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপর নাই’’- তাকেই যেন জীবনদর্শন হিসাবে গ্রহণ করে লালন বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণের অন্তঃসারশূন্য বিভেদের বিরুদ্ধে।
চৈতন্যদেবের মৃত্যুর পর, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাউল সম্প্রদায়ের উদ্ভব। গানই ছিল তাঁদের সাধনার প্রধান অবলম্বন। কিন্তু দীর্ঘসময় যাবৎ সমাজে বাউলদের খুব বেশি প্রভাব তৈরি হয়নি। লালনের গানের মধ্য দিয়ে সমাজ জীবনের নানা দ্বন্দ্ব ও তার বিচারের পথ প্রদর্শিত হওয়ার কারণে উনিশ শতক থেকে বাউল গান সমধিক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। সেই বিচারে ফকির লালন সাঁইকে আধুনিক বাউল গানের পথিকৃৎ বলা যেতেই পারে।
লালনের পুঁথিগত পড়াশুনো বেশি ছিল না। প্রাথমিক স্তরে কিছু বিদ্যার্জনের সুযোগ তাঁর হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু সেটা তাঁর পরবর্তী জীবনের অনন্যসাধারণ সৃষ্টির নিরিখে খুবই সামান্য। এ’প্রসঙ্গে বাংলাদেশের বিশিষ্ট লালন গবেষক ড. লুৎফর রহমানের উক্তি - ‘তিনি হয়তো যথেষ্ট শিক্ষিত ছিলেন না, কিন্তু যথোপযুক্ত শিক্ষিত ছিলেন।’ তাই সেই মানুষটি যখন মুখে মুখে গান রচনা করতেন, তাতে ফুটে উঠতো সমাজের প্রতিচ্ছবি, যা মানুষকে সহজেই আকৃষ্ট করতো। সমসাময়িক বাউল গানের তুলনায় এখানেই ছিল তাঁর স্বকীয়তা। সহজ-সরল কথার মধ্য দিয়ে তিনি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতেন, আবার রঙ্গরসের ব্যবহারে গভীর তত্ত্বকথাকে সহজ করে দিতেন। জাতের নামে বজ্জাতিকে আক্রমণ করে কত সহজে তিনি বলতে পেরেছেন- ‘‘জাত গেল জাত গেল বলে /একি আজব কারখানা / সত্য কাজে কেউ নয় রাজী / সব দেখি তানা-নানা।’’ আবার মানব সমাজের এক গূঢ় সত্যকে সহজবোধ্য করে বলে দিলেন- ‘‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই মূল হারাবি / মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি।’’
লালনের গানের একটি বৈশিষ্ট্য হলো সেগুলির দ্বিবিধ অর্থ। প্রাথমিকভাবে সব মানুষের কাছে সহজবোদ্ধ একটি অর্থ, আবার চিন্তাশীল মানুষের কাছে আরেকটি গূঢ় অর্থ। পশ্চাৎপদ ধর্মীয় ধ্যানধারণাকে ভিতর থেকে আঘাত করতে গিয়ে লালন তাঁর গান রচনায় আশ্রয় নিয়েছেন বহু রূপক ও হেঁয়ালির। হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের কট্টরপন্থীদের রক্তচক্ষুকে এড়িয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছানোর সহজ রাস্তা হিসাবেই এইসব রূপক ও হেঁয়ালির আশ্রয় নিতে হয়েছে তাঁকে। নিপীড়িত-বঞ্চিত-শোষিত অথচ  অন্ধ বিশ্বাসে বশীভূত হয়ে শোষকের কাছে নতজানু হয়ে থাকা মানুষের চেতনা জাগানো যায় কিভাবে? এই প্রশ্ন লালনকে বারবার বিচলিত করেছে। তার উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি বুঝেছেন—  সাধারণের বোধগম্য  ভাষায়, তাদের নিত্যযাপনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কথকতায়, তাকে আকৃষ্ট করার মতো সহজ ছন্দে-সুরে, সহজ-সরল কথার ছলে, জাগাতে হবে তার চেতনাকে। এই কাজের মধ্যেই রয়েছে একজন লোকশিল্পীর, গণশিল্পীর উদ্দেশ্যের সার্থকতা। কিন্তু সেই  সৃষ্টির কোনও গতবাঁধা ফর্মুলা নেই, তার জন্য সবার আগে চাই মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণাকে অনুভব করার মতো এক মরমী হৃদয়। লালন যখন মেঠো সুরে গেয়ে ওঠেন- ‘‘ছোন্নত দিলে হয় মুসলমান / নারী লোকের কি হয় বিধান / বামন চিনি পৈতে প্রমাণ / বামনী চিনি কিসে রে '’- তখন তা প্রান্তিক মানুষের শুধু কানে প্রবেশ করে না, অন্তরাত্মায় ধাক্কা দেয়, তাদের মনে প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে, ভাবতে শেখায়, জাতপাতের অসারত্ব বুঝতে সাহায্য করে। আবার এইসব গান শুনে যখন মানুষ তাঁর আখড়ায় আসছে, তাঁর কথা শুনতে চাইছে, যখন তিনি বুঝলেন যে এই জীবনদর্শন বহু মানুষের সামনে তুলে ধরার একটা পরিসর প্রস্তুত হয়েছে, তখন লালন তাঁর লক্ষ্যে আরও দৃঢ় হচ্ছেন। জাতের কারবারীদের সরাসরি ব্যাভিচারীর সঙ্গে তুলনা করে তিনি গান বাঁধছেন- ‘‘জাত বিচারী ব্যাভিচারী / জাতির গৌরব  বাড়ী বাড়ী / দেখলাম চেয়ে / লালন বলে হাতে পেলে / ‘জাত’ পোড়াতাম আগুন দিয়ে।’’ মানুষ এই গান শুনে উচ্ছ্বসিত হয়েছে, মুখ থেকে মুখে এই গান ছড়িয়ে পড়েছে এবং তার প্রভাব ব্যপ্ত হয়েছে। আবার এই কারণেই লালনকে কট্টর ধর্মধ্বজাধারীদের হাতে বারবার নিগৃহীত হতে হয়েছে, কিন্তু তিনি তাঁর অভীষ্ট পথ থেকে একমুহুর্তের জন্যও সরে যাননি।
বাংলার সারস্বত সমাজের কাছে এবং বিশ্বমানসে লালনকে পরিচিত করিয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। বাউল গান, বিশেষত লালনের গানের প্রতি তাঁর ছিল অপার বিমুগ্ধতা। লালনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা তা নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। তবে রবীন্দ্রনাথের জ্যোতিদাদা, অর্থাৎ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর শিলাইদহে তাঁদের বজরাতে লালনকে নিয়ে এসেছিলেন এবং ১৮৮৯ সালের ৫ মে সেখানেই লালনের একটা পেন্সিল স্কেচ করেন, যেটি তাঁর একমাত্র প্রামাণ্য প্রতিকৃতি। তবে লালনের সঙ্গে সাক্ষাৎ না হলেও, লালনের শিষ্যদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা-সাক্ষাতের বেশ কিছু ঐতিহাসিক নথি রয়েছে। বাউলদের জীবনযাত্রা এবং তাদের মর্মস্পশী গান রবীন্দ্রনাথকে কতটা প্রভাবিত করেছিল তার পরিচয় পাওয়া যায় ‘রবি-বাউল’-এর সুপরিচিত ছবিটিতে। রবীন্দ্র রচনায় লালনের গানের প্রভাব ব্যাপকভাবে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়, ১৩২২ বঙ্গাব্দের (১৯১৫ সাল) আশ্বিন থেকে মাঘ পর্যন্ত চার কিস্তিতে, লালন ফকিরের কুড়িটি গান প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়াও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ প্রদানের সময় লালনের ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখী’ গানটির ইংরেজি তর্জমা করে বিদেশি শ্রোতাদের কাছে পরিবেশন করেছিলেন। শিলাইদহে থাকাকালীন সময়ে ছেউড়িয়ার আখড়া থেকে লালনের গানের দু’টি খাতা আনিয়ে তার মধ্যের ২৯৮টি গান তিনি কপি করিয়েছিলেন।
আলোচনা প্রসঙ্গেই এসে যায় শিলাইদহের আর এক প্রখ্যাত বাউল, লালন-শিষ্য গগন হরকরা (গগন দাস)-র নাম। তিনি ছিলেন শিলাইদহ পোস্ট অফিসের ডাক হরকরা (পিওন)। লালনের প্রয়াণ বর্ষ, অর্থাৎ ১৮৯০ সালের শেষ পর্বে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানের প্রতি আকৃষ্ট হন। গগনের রচিত ও সুরারোপিত গান ‘কোথায় পাবো তারে / আমার মনের মানুষ যে রে’ শুনে রবীন্দ্রনাথ এতটাই মুগ্ধ হন যে নিজের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা / আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটিতে গগনের উক্ত গানের সুরে সুর সংযোজন করেন। এই গানটিই পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশ-এর জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে গৃহীত হয়। এছাড়া রবীন্দ্রনাথের ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’ গানটির সুরও গগন হরকরার ‘ও মন অসাড় মায়ায় ভুলে রবে’ গানটির সুর ভেঙে তৈরি হয়েছিল। এই আলোচনায় উল্লেখ করতেই  হয় উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা লোকসংস্কৃতির অন্যতম পুরোধা এবং বাউল সঙ্গীতের অন্যতম অগ্রপুরুষ, আরও একজন লালন-অনুরাগীর কথা। তিনি হরিনাথ মজুমদার, ‘কাঙাল হরিনাথ’ নামেই যিনি সাধারণ্যে পরিচিত ছিলেন। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে অধুনা বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করা এই মানুষটি সাংবাদিকতাকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করে তৎকালীন গ্রাম বাংলার শোষিত-নিপীড়িত কৃষিজীবী মানুষকে অত্যাচারী শাষক, জমিদারদের হাত থেকে রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছিলেন । ইংরেজ-জমিদার-মহাজন-কুঠিয়ালদের অত্যাচার আর শোষণের জাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানুষকে জাগিয়ে তুলতে তিনি তাঁর ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করেন। লালন-গবেষক আবুল আহসান চৌধুরির বক্তব্য থেকে জানা যায় যে শিলাইদহের জমিদাররা প্রজাদের উপর অত্যাচার শুরু করলে হরিনাথ ঐ পত্রিকায় তার প্রতিবাদ করে লেখা প্রকাশ করেন। জমিদাররা কাঙাল হরিনাথকে শায়েস্তা করতে লেঠেল পাঠালে লালন ফকির তাঁর  শিষ্যদের নিয়ে জমিদারের বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। হরিনাথ পরবর্তী জীবনে অন্য কাজ ছেড়ে বাউল সাধকের জীবন বেছে নেন এবং ফকির চাঁদ বাউল নামে পরিচিত হন। নিজের লেখা বহুজন সমাদৃত গানগুলির পাশাপাশি লালনের গানের বহুল প্রচারের ব্যবস্থাও করেন। সমাজে শিক্ষার বিস্তার এবং সাধারণের শোষণের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ কাঙাল হরিনাথ তথা ফকির চাঁদ বাউলকে স্মরণীয় করে রেখেছে। এভাবেই লালন সাঁই, ফকির চাঁদ বাউল, গগন হরকরারা তাঁদের সৃষ্টিকে ব্যবহার করেছেন সমাজ সংস্কারের কাজে, মানবতাবাদের পতাকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে। তাঁদের গান মানুষকে আকৃষ্ট করেছে, আবিষ্ট করেছে, আবার জাগরণের মন্ত্র শুনিয়েছে, তাই কালজয়ী হয়েছে। সমাজের প্রতি শিল্পীর দায়বদ্ধতার অতুলন প্রকাশ এই ক্ষণজন্মা মানুষদের জীবন ও সৃষ্টিতে। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী’ নির্বাচনের জন্য একটি শ্রোতা-জরিপ করেছিল। প্রায় এক মাস যাবৎ চলা এই জরিপে শ্রোতাদের দ্বারা নির্বাচিত শীর্ষ কুড়িজন বাঙালির তালিকায় দ্বাদশ স্থানে ছিলেন লালন ফকির।
তিনি প্রায় দু’হাজার গান রচনা করেছিলেন। যদিও এর একটি গানও তিনি নিজে লিপিবদ্ধ করেননি, যতটুকু যা লেখা আছে সেটা দুদ্দু শাহ সহ লালনের শিষ্যদের প্রচেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। এইসব গানের মধ্য দিয়ে লালন নিজেকে উন্মোচিত করেছেন মানবতাবাদী, সমাজ সংস্কারক, দার্শনিক হিসাবে। তাঁর গানে বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া এবং সুফিবাদের সংমিশ্রণ ঘটেছিল। তিনি বাউল সাধক ছিলেন কিন্তু বাউলের দেহতত্ব নির্ভরতাকে ছাড়িয়ে তাঁর উড়ান হয়েছিল মানবতাবাদের মুক্ত আকাশে।
কিন্তু, এইসব মহান মানবাত্মার গর্বিত উত্তরাধিকার মিশে রয়েছে যে দেশের মাটিতে সেই ভারতবর্ষের আজকের অবস্থা কি? বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে সারা পৃথিবী যখন এগচ্ছে, যখন বিশ্বমানবের কর্মধারা বিকশিত হচ্ছে অজস্রসহস্রবিধ চরিতার্থতায়, তখন, এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও আমাদের দেশে জাতপাতের আলোচনা হয়, প্রাদেশিকতার জিগির তোলা হয়, এমনকি ধর্মীয় পরিচিতির কারণে মানুষকে খুন হতে হয়! যে ভারত একদিন তার মাটি থেকেই বিশ্বকে ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ (সারা পৃথিবী আমার আত্মীয়)-র ঘোষণা শুনিয়ে নন্দিত করেছিল, আজ সেই দেশের অভ্যন্তরে ধর্মীয় বিভাজনের কারণে সৃষ্ট সংঘাত সারা বিশ্বের দ্বারা নিন্দিত হয়। এবং এই সমস্ত অপকর্মের পিছনে থাকে রাষ্ট্রপরিচালকদের সক্রিয় মদত। দেশের কোটি কোটি গরিব, এমনকি সহায়-সম্বলহীন মানুষকেও ধর্মের বিষাক্ত সুরা পান করিয়ে অবৈজ্ঞানিক, ভিত্তিহীন, কল্পকাহিনিতে বিশ্বাস স্থাপন করানো হচ্ছে, তাদের মনে বিভেদের বীজ পুঁতে দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রমুখ্য নিজেই এই কাজের হোতা। তাঁদের এই অবিমৃষ্যকারিতার সুযোগ নিচ্ছে এ'দেশের প্রধান দুই ধর্মের মৌলবাদীরা। তারা স্ব স্ব ধর্মের মানুষের মধ্যে নিজেদের আধিপত্য কায়েম রাখতে পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলছে। মানুষের মনকে এই পশ্চাৎপদ ভাবধারা থেকে মুক্ত করে যুক্তিবাদে ফিরিয়ে আনতে গেলে, শুধুমাত্র বিভেদপন্থী মৌলবাদী ভাবধারাকে আক্রমণ করাই  যথেষ্ট নয়। এমনকি কেবলমাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতা দিয়েও একে রোখা যায় না। তার জন্য প্রগতিমনস্ক, মানবতাবাদী গণসংস্কৃতি-লোকসংস্কৃতির প্রয়োজন, যার মাধ্যমে প্রগতিবিরোধী পশ্চাৎপদ ধারণাগুলির একটি 'কাউন্টার ন্যারেটিভ' বা বিরুদ্ধ- ভাষ্য তৈরি করা সম্ভব। ফকির লালন সাইঁরা সেই পথ আমাদের দেখিয়েছেন। সেই পথে আলো জ্বেলে সে পথেই, ভেদবুদ্ধিকে পরাজিত করে, সমাজের ক্রমমুক্তি হোক। বিশাল সংখ্যক প্রান্তিক মানুষের কাছে লালনকে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টা প্রবহমান থাকুক, বৃদ্ধি পাক লোকসংস্কৃতির চর্চা, তাকে ব্যাপ্ত করার উদ্যোগ।
 

Comments :0

Login to leave a comment