সুবিনয় মৌলিক
আজকের মতোই সেই দিনটিও ছিল শনিবার। ২ মার্চ ১৯৮৫। অনেকেরই এখনো মনে আছে সাতসকালে রাজ্যকে কার্যত স্তম্ভিত করে দিয়ে এক সুপ্রসিদ্ধ ইংরেজি দৈনিক খবর করেছিল যাদবপুরের কংগ্রেস সাংসদ নিজেকে যে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রাপ্ত বলে দাবি করেন সেটি আদ্যন্ত ভুয়ো। যে শব্দটি সংবাদ শিরোনামে ব্যবহার করা হয়েছিল তা হলো 'বোগাস'। খবরটির বিস্তারিত বয়ানে লেখা হয়েছিল মার্কিন দেশের যে ইস্ট জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই সাংসদ তাঁর "মুঘল রাষ্ট্র ও নীতির ওপরে হারেমের প্রভাব" বিষয়ক গবেষণার জন্যে পিএইচডি করেছেন বলে দাবি করেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সেটির অস্তিত্ব নেই । এর পরেই দেওয়ালে দেওয়ালে তাঁর নামের আগে বসানো 'ড.' চুনকাম করে সাফ করে দেয় তাঁর নিজের দলেরই বিড়ম্বিত লোকজন।
সেদিন থেকে আজ লাগভাগ চার দশক পার। আদিগঙ্গা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেছে। পরবর্তীকালে সেই সাংসদ যাদবপুরে পরাজিত হয়ে দক্ষিণ কলকাতা থেকে লোকসভায় জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। দিল্লিতে কংগ্রেস ও তার পরে বিজেপি মন্ত্রিসভার মন্ত্রী থেকে বর্তমানে এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তিনি। ভুয়ো পিএইচডি জনিত তাঁর সেই দুর্ভোগও এখন অতীত। এখন তিনি সগর্বে দাবি করতে পারেন তিনি কলকাতার এমন দু’- দুটি খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্মানিক ডিলিট প্রাপ্ত যাদের অস্তিত্ব প্রশ্নাতীত। অতি সম্প্রতি সেন্ট জেভিয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিলিট প্রদান করেছে। কোনও কোনও নিন্দুক অবশ্য বলছে যে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মশাই নাকি কোথায় এটা বলেই ফেলেছেন যে এই সাম্মানিক প্রদান নিউটাউনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৭ একর সরকারি জমি পাওয়ারই নগদ স্বীকৃতি যা ভবিষ্যতে আইন ও ম্যানেজমেন্ট বিভাগ খোলার জন্যে আরও কিছু একর পাওয়ার সম্ভাবনাকে আরও বেশি উজ্জ্বল করবে। সুবুদ্ধিমানরা বলছেন, নিন্দুকদের কথা বাদ দিন। রবীন্দ্রনাথ তো কবেই বলে গেছেন ‘নিন্দুকগুলি খাইতে পায় না বলিয়াই মন্দ কথা বলে’ !
নিন্দুককে পাত্তা দিলে কিন্তু সত্যিই সর্বনাশ। যা তা বলবে। বলবেই বলবে। বলবে যে এই ডিলিট প্রাপ্তির খবর নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে মাতামাতি করা আসলে নিরর্থক টাইম পাস। মিডিয়ার এই সব চটকদার ঝিকিমিকির আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ক্ষেত্রে দগদগে ক্ষতগুলো। উপেক্ষিত, অনালোচিত থেকে যাচ্ছে কী গভীর সঙ্কটে আমাদের রাজ্যের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ। 'থেকে যাচ্ছে' বলাটাও সর্বার্থে নিরামিষ ভাববাচ্য। বলা উচিত, রেখে দেওয়া হচ্ছে , যাতে আমার আপনার চোখে মায়াকাজল পরিয়ে আমাদের বাস্তব দেখা-বোঝা ঠেকানো যায়। একদিকে যেমন একটি নমুনায় দেখলাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি সরকারের অবাধ দাক্ষিণ্য, অপরদিকে নজর দিলেই দেখতে পাবো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার প্রতি পাহাড়প্রমাণ উদাসীনতা।
নিন্দুক আরও বলবে, উচ্চ শিক্ষার টপ টু বটম সরকারি অনাদরের চেহারার সামান্য মালুম পেতে চাইলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকেই তাকানো যেতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীকে সর্বপ্রথম ডিলিট প্রদানকারী। সেই ২০১৮ সালে। বাঙালীর গর্বের সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব চেহারাটা কী? নিন্দুক হাতে কাগজ ধরে বলছে ৯৩টি বিভাগ থেকে সংগৃহীত তথ্য অনুসারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত শিক্ষক পদের ৫০ শতাংশ বেশ কয়েক বছর শূন্য পড়ে আছে। এমন বেশ কয়েকটি বিভাগ আছে যেগুলিতে মাত্র একজন অধ্যাপক গোটা বিভাগ সামলাচ্ছেন। অনেকগুলি বিভাগেই, বিশেষত বিজ্ঞান শাখায়, একাধিক স্পেশালাইজেশন আছে যেগুলির কোনও ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক নেই । বহুক্ষেত্রে টেকনিকাল অ্যাসিস্টেন্ট পদ শূন্য। অধ্যাপককে ল্যাবরেটেরির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ একা হাতে গোটাতে হচ্ছে। চক ডাস্টার ধরা থেকে ঝাড়পোঁছ, সব। নিন্দুকের থেকে জোগাড় করা একটা দুটো নমুনা দিই। কলেজ স্ট্রিট ক্যাম্পাসের বাংলা বিভাগ। এককালে শঙ্খ ঘোষ, পবিত্র সরকাররা পড়েছেন যেখানে। অনুমোদিত শিক্ষক পদ ১৫ , আছেন ৬ জন। আলিপুরে শহীদ ক্ষুদিরাম শিক্ষা প্রাঙ্গণে ইতিহাস বিভাগ।অনুমোদিত পদ ২৫। আছেন সাকুল্যে ১০ জন। বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসে স্ট্যাটিস্টিক্স বিভাগ। ১৯৪১ সালে যখন শুরু হয়েছিল এই বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষা তখন বিভাগীয় প্রধান ছিলেন স্বনামধন্য প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ। এখন ২০২৩ । অনুমোদিত বারোর মধ্যে আছেন মাত্র পাঁচ ।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশন ডিপার্টমেন্ট ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে শিক্ষার প্রাচীনতম বিভাগ। ২০২০-২০২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে তার বিএড পড়ানোর স্বীকৃতি বাতিল করে দিয়েছে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন (এনসিটিই)। তার অন্যতম কারণ শিক্ষক সঙ্কুলান। আস্ত একটা কোর্স উঠে গেল তিন বছর আগে। কারো কোনও হেলদোল? নেই। ১৮টি অনুমোদিত পদের মধ্যে আছেন মাত্র এক তৃতীয়াংশ ৬ জন ।
এখানেই শেষ নয় । নিন্দুক বলছে গত ২০২১ থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় দু’বছর হতে চলল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করেনি রাজ্য । কী না হয়েছে স্রেফ এই উপাচার্য পদ নিয়ে ! দড়ি টানাটানি চলেছে রাজ্য-রাজ্যপালে। আপনি ভেবে দেখুন তো বেআইনি পুনর্নিয়োগের দায়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-কে দু’-তিন মাসের মধ্যে দুই শীর্ষ কোর্টে পরপর দু’বার অপসারিত হতে হো, এত কলঙ্কিত কখনো হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়? কোনও ন্যূনতম মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষাসেবীর পক্ষে এই লজ্জা মেনে নেওয়া যায়? অবশ্য আপনি বলতেই পারেন উত্তর বঙ্গের ভিসি নিয়োগ তো নিয়োগ দুর্নীতিতে জেল খাটছেন, তুলনায় এ আর এমন কী ? সে কথা আলাদা ।
নিন্দুক বলছে এর পরেও কুর্নিশ জানাতে হবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক সমাজকে । নিয়োগ নেই, অর্থ নেই , নেই স্বায়ত্বশাসন, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র , নির্বাচনভিত্তিক প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থা সেনেট সিন্ডিকেট বা ছাত্র সংসদ, নীতি নির্ধারণের কেন্দ্র অচল , তবুও উৎকর্ষের নিরিখে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিক্ষাগত মান রক্ষা করছে তারা। এত সরকারি অবহেলা সত্ত্বেও । কিন্তু প্রশ্ন একটাই। শিক্ষাক্ষেত্রে রুগ্নতার একটা বৈশিষ্ট্য হলো এটি আর্সেনিক বিষপ্রয়োগের ফলের মতো । সময়মত প্রতিষেধক না পড়লে ধীর কিন্তু নিরাময়হীন। এভাবে আর কতদিন ?
প্রায় দেয়ালে পিঠ ঠেকলেও লড়ছে যাদবপুরও। নিয়োগ সমস্যার পাশাপাশি তীব্র অর্থাভাব। কেন্দ্রীয় সরকার তো বটেই, টাকা দিচ্ছে না রাজ্য সরকার। পরিস্থিতি এতটাই সঙ্কটজনক যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবার প্রাক্তনীদের কাছে অর্থ সহায়তার অনুরোধ করেছে। এমনকি, কর্পোরেট সাহায্যের আবেদনও জানানো হয়েছে। এই ‘ইনস্টিটিউট ফর এক্সেলেন্স’ চালাতে প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকা খরচ হয় বছরে। রাজ্য সরকার এখন মেরেকেটে ২০ কোটি টাকা দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য কার্যত শূন্যে এসে ঠেকেছে।আটকে যাচ্ছে গবেষণা প্রকল্প । এর মধ্যেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় মুক্ত চিন্তা ও জ্ঞানের অপার দিগন্তের দিকে এখনো এগোতে পারছে । এই ‘এখনো’ শব্দটাই ভয়ানক দুর্ভাবনার ।
কিন্তু পারছে না প্রেসিডেন্সি । পরিকল্পনাহীনতা ও দিশার অভাব রাজ্যের সেরা ও দেশের প্রথম সারির একটা কলেজ থেকে একক বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে তার নবরূপে আবির্ভাবের এক দশকের মধ্যে একটা গড়পড়তা হৃষ্টপুষ্ট ডিগ্রি প্রদানকারী সংস্থায় পরিণত করেছে । গবেষণা নেই , পেটেন্ট নেই, বহু বিভাগে প্লেসমেন্ট নেই বললেই চলে। প্রেসিডেন্সির প্রাক্তনীরা তো দেশে বিদেশে জ্ঞান- বিজ্ঞান, শিক্ষা। রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, মিডিয়ার শীর্ষস্তরে আছেন। তারা যখন দেখেন ২০২২ সালে উৎকর্ষতার বিচারে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোর যে তালিকা প্রকাশ করেছে ন্যাশন্যাল ইনস্টিটিউট ব়্যাঙ্কিং ফ্রেমওয়ার্ক তাতে চতুর্থ স্থানে রয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, অষ্টম স্থানে রয়েছে কলকাতা , ৮৭তম স্থানে আছে বর্ধমান— কিন্তু প্রথম একশোর মধ্যেই নেই প্রেসিডেন্সি, তাদের কিরকম লাগে? নেই মানে ধারাবাহিকভাবে নেই। প্রেসিডেন্সি প্রাঙ্গণে সরস্বতী পুজো করানোতে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ও তাদের “প্রবীণ” মিত্র ও পৃষ্ঠপোষকদের যতটা আগ্রহ দেখলেন ক’দিন আগে, গরিমার এই স্থির অবনমন সম্পর্কে তাদের কণামাত্র উদ্বেগ কেউ কোনদিন দেখেছেন? দেখার প্রত্যাশা রাখেন?
নিন্দুক কথিত দুরবস্থার উদাহরণের ক্লান্তিকর বৃত্তান্ত থামিয়ে মোদ্দা কথাটি বলে ফেলা যাক। এদের প্রত্যেকটি কিন্তু রাজ্য সরকার চালিত বিশ্ববিদ্যালয়। ‘চালিত’ কথাটি সচেতনভাবেই লিখলাম । স্বাধিকারের ছিটেফোঁটাও আর এ রাজ্যের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নেই । অধুনা বেকার ছেলেমেয়েদের থেকে স্কুলে চাকরির নামে কোটি কোটি কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করার দায়ে জেলবন্দি কিন্তু একদা বাংলার মাননীয় শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সোজাসাপ্টা অমৃতবচন ছিল, “আমরা টাকা দিই, তাই আমরা নাক গলাবো।” ব্যাস । এবং তাঁরা পুরোদস্তুর গলিয়েছেন। যার ফলে কলকাতা তো বটেই জেলার সুলভে উচ্চশিক্ষা প্রত্যাশী হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রীর আশ্রয়স্থল দুরারোগ্য উপশমহীন ক্ষয়রোগে আক্রান্ত । বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিস্টার ভিত্তিক সিবিসিএস ব্যবস্থা শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিষয়কেন্দ্রিক তুমুল চর্চা দাবি করে । লোকবল , অর্থবলে দীর্ণ হলে একাজ কার্যত অসম্ভব।
নিন্দুক বলছে, সরকারপোষিত উৎকর্ষকেন্দ্রগুলিকে এভাবে ‘ডিলিটেড’ হতে দেখলে কার-ই বা ভালো লাগে ? আপনি আমি কী বলব? কবি যা বলে গেছেন তাই বলব?
Comments :0