তমোনাশ চৌধুরি
১ অক্টোবরের পড়ন্ত বিকেল। ধর্মতলার মুখে যখন মিছিল পৌঁছালো রাস্তায় পড়ে জলের বোতল, পাউচ হাতে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চা থেকে বুড়ো। ছোট ছোট পায়ে ঐ বাচ্চা মেয়েটি ছুটে ছুটে নিদারুণ উৎসাহে জলের পাউচ দিচ্ছে মিছিলে হাঁটতে থাকা প্রতিবাদীদের।
বরাহনগর থেকে রাত বারোটায় ফোন পেলাম গরম রসগোল্লা তৈরি করেছি, স্বাস্থ্য ভবনে নিয়ে আসছি, কিভাবে দেব যদি জানান ।
সোদপুর থেকে মিছিল চলেছে ধর্মতলা, অটোচালক গাড়ি পাশে রেখে হাঁটা শুরু করল। জানতে চাইলাম আপনার আজকের আয়ের কী হবে? সোজা উত্তর— আজ যদি না হাঁটি এই মিছিলে, তবে আর কবে হাঁটবো?
‘বৃষ্টি হয়েছে। ত্রিপল ফুটো হয়ে আমাদের সব জামা কাপড় ভিজে গেছে। শুকনো জামা কাপড় চাই'— এই একটা মেসেজ। মুহূর্তের মধ্যে শয়ে শয়ে জামা, সালোয়ার, গেঞ্জি, প্যান্ট, জমা হয়ে গেল। সিটি কলেজের সেই ছাত্রীটি যে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্বে তার হিমশিম অবস্থা ।
পাশে অনশন মঞ্চ। বিকেল তিনটার সময় খবর এল হাইকোর্ট সরকার ঘোষিত ১৬৩ ধরার নির্দেশ বাতিল করেছে। মুহূর্তের মধ্যে গর্জন করে উঠলো হাজার হাজার কণ্ঠের স্লোগান । পুলিশ ব্যারিকেড খুলে দিচ্ছে। তবু ধৈর্য বাঁধ মানছে না। কল্পনা করতে পারেন লালবাজারের সামনে পুলিশ ব্যারিকেড খুলে দিচ্ছে আর শিরদাঁড়া উপহার নিচ্ছে। এসবই কয়েকটি টুকরো ছবি এই চলমান প্রতিবাদের।
৯ আগস্টের নৃশংস নির্মম ঘটনার প্রতিবাদে ও ন্যায় বিচারের দাবিতে লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয় আলোড়িত। অভয়ার (আর জি করের ঘটনায় নিহত চিকিৎসক) রক্ত আজ আমাদের শিরায় শিরায় প্রবাহিত। তাঁর চেতনায় আমরা উজ্জীবিত।
একদিকে এই প্রতিবাদের বিভিন্ন কর্মসূচি, কত নতুন ধরনের আঙ্গিক। মেয়েদের রাত দখল, সারা রাত ধরে রাস্তায় রাস্তায় ছবি আঁকা কিংবা ৪৮ ঘণ্টা ধরে গান কবিতা, নাটকে কথায় প্রতিবাদ সভা। মশাল হাতে চল্লিশ কিলোমিটার পথ হাঁটা প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে। কোনো রকম গাড়ি চলাচলে বাধা না দিয়ে ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ জুড়ে মানববন্ধন। মস্তিষ্কের মডেল নিয়ে মিছিল— স্বাস্থ্য ভবন অভিযান। প্রতীকী শিড়দাঁড়া নিয়ে মিছিল হাঁটে লালবাজার। রাসবিহারী মোড়ে সেদিন কমপক্ষে কুড়ি হাজার মহিলা পুরুষ ছাত্র-ছাত্রীর জমায়েত কারো হাতে মশাল কারো কাঁধে প্ল্যাকার্ড। কারা এরা? এরা দক্ষিণ কলকাতার প্রাক্তনী। সারা রাজ্যে এরকম অসংখ্য স্কুল কলেজের প্রাক্তনীরা প্রতিবাদী সংগঠন গড়ে তুলেছে । ১৬ আগস্ট যেদিন ডার্বি বাতিল হলো সেদিন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষেরা একজোট হলো। প্রতিবাদের ভাষায় নতুন স্লোগান শুনল বাংলা— ‘ঘটি-বাঙালের এক স্বর- জাস্টিস ফর আর জি কর’! মোহনবাগান ক্লাবের সমর্থকের কাঁধে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের সমর্থক, পাশে দাঁড়িয়ে পতাকা তুলে ধরে মহমেডান ক্লাবের সমর্থকেরা। আর পরের ডার্বি ম্যাচে যুবভারতী স্টেডিয়াম কাঁপিয়ে স্লোগান উঠে ‘উড়িয়ে দিয়ে হুমকি-ডর/ আজকে জিতুক আর জি কর।' বাংলায় আজ এক ঐতিহাসিক চলমান প্রতিবাদের আন্দোলন।
৯ আগস্ট ঘটনার অব্যবহিত পর থেকেই এটা পরিষ্কার যে, এক পক্ষ ধর্ষক ও খুনিদের আড়াল করতে ব্যস্ত। তথ্য প্রমাণ লোপাটের সাথে যুক্ত আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন ধিক্কৃত অধ্যক্ষ ও টালা থানার ওসি এখন জেল হেপাজতে। প্রাথমিক চার্জশিটে সিবিআই যাকে চিহ্নিত করেছে সে একজন সিভিক ভলান্টিয়ার। এই সিভিক পুলিশ কারা? যারা আনিস খানের খুনের সঙ্গে জড়িত, যারা অতি সাম্প্রতিক কল্যাণীতে বর্বর ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কলকাতা পুলিশের এক উচ্চপদস্থ অফিসার যখন কারো ছবি দেখিয়ে বলেন যে উনি ফিঙ্গার প্রিন্ট বিশেষজ্ঞ কিংবা ৪০ ফুট ১১ ফুটের তত্ত্ব দেন তখন বুঝতে অসুবিধা হয়না যে কারা ধর্যক, খুনিদের পক্ষ নিচ্ছে। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের দুর্নীতির তথ্য প্রমাণ দিয়ে যখন বিভিন্ন দপ্তরে এমনকি মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরেও চিঠি পাঠানোর পর তদন্ত কতদূর হলো জানা যায়না কিন্তু অভিযোগকারীকে বহুদূরে ট্রান্সফার করা হয়। যখন একজন ব্যক্তিকে বারে বারে এই আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অ্যক্ষ পদে রেখে দেওয়া হয় তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই দুর্নীতির মদতদাতা ও সুবিধাভোগী কারা!
এই দুর্নীতি ও দুষ্কৃতীরাজের এক চূড়ান্ত নিদর্শন হলো আর জি করের স্নাতকোত্তর পড়ুয়া এক চিকিৎসকের নৃসংস ধর্ষণ ও খুনের ঘটনা।
শিক্ষা দপ্তরের দুর্নীতি, রেশন চুরি, চাকরি চুরি, কয়লা চুরি, গোরু পাচার, সর্বত্র তোলাবাজি, ঘুষ মানুষকে বিক্ষুব্ধ,অসহিষ্ণু করে তুলছে। আর তাকে চেপে রাখার জন্য ক্ষমতার অশ্লীল আস্ফালন হচ্ছে হুমকিরাজ কায়েম করা। যাকে সাম্প্রতিক কালে সবাই ‘থ্রেট কালচার' বলে অভিহিত করছে। এই ‘থ্রেট কালচার' জনজীবনের সর্বস্তরে প্রসারিত করার প্রয়াস অব্যাহত আছে।
এই পরিবেশে অভয়ার মা বাবা ও পরিবারের সকলের মানসিক শক্তি দৃঢ়তাকে কুর্নিশ জানাতেই হয়। তাঁদের ন্যায় বিচারের দাবি এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে। সাহস সংক্রামিত হয়েছে জনে জনে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়। অসংখ্য প্রতিবাদী সংগঠন গড়ে উঠেছে। যারা বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার ছিল তাঁরা আরও বেশি বেশি করে সোচ্চার হচ্ছেন। তীব্র আন্দোলন শামিল হচ্ছেন, লাগাতার অবস্থান থেকে শুরু করে মহল্লায় মহল্লায় প্রতিবাদের ভাষা জোগাচ্ছেন।
এই প্রতিবাদ কোনও বিশেষ শ্রেণির মানুষের নয়। মহিলা, ছাত্র-যুব, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাকরিজীবি, বেকার, শিক্ষক, রিসার্চ স্কলার থেকে শুরু করে স্কুলছুটদের সবার প্রতিবাদ। অরিজিৎ সিং নতুন গান গেয়েছেন- আর কবে? নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ায়ে শ্রেয়া ঘোষাল তার কনসার্ট শেষ করে দর্শকেরা যখন হাততালিতে ভরিয়ে দেয় তখন বলে ওঠেন— এবার একটা গান গাইবো কিন্তু কেউ হাততালি দেবেন না। গেয়ে ওঠেন প্রতিবদের গান। গান শেষে হাততালি নয়, শ্রোতারা স্লোগানের তালে We want justice, তখন চোখ ভরে আসে জলে। সবার শিরায় বইছে অভয়ার রক্ত, সবার চেতনায় অভয়ার অনুভূতি ।
তাই এই প্রতিবাদকে থামানোর সমস্ত রকম প্রচেষ্টা অব্যাহত। কারণ যখন স্লোগান ওঠে ‘শাসক তোমার কিসের ভয়-ধর্ষক তোমার কে হয় ?' তখন নিরীহ রূপসা মণ্ডলকে টেনে হিঁচড়ে গ্রেপ্তার করে লালবাজারে আটকে রাখা হয়। তখন মিথ্যা অভিযোগে প্রতিবাদী কলতানকে গ্রেপ্তার করা হয়।পুজো প্যান্ডেলে স্লোগান দেবার অপরাধে ন’জন প্রতিবাদীকে গ্রেপ্তার করা হয় ও চূড়ান্ত হয়রান করা হয়। কর্মরত চিকিৎসককে শুধু ‘শিরদাঁড়া বিক্রি নেই’- লেখা গেঞ্জি পরে থাকার অপরাধে থানায় আটক করা হয় ও বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের হয়। এছাড়াও অসংখ্য জায়গায় নৈহাটি, বারাসত, বেহালা, জলপাইগুড়িতে প্রতিবাদীদের মারধর করা হয়। পুলিশ অসংখ্য প্রতিবাদীকে নোটিস পাঠিয়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। এছাড়া প্রতিনিয়ত পরিকল্পিতভাবে কুৎসা, মিথ্যাচার, প্রচারিত হচ্ছে। কুৎসিত ভাষাযয় আক্রমণ করা হচ্ছে, বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা চলছে। প্রতিবাদের গলা চেপে ধরার যতরকমের পদ্ধতি আছে তা প্রয়োগ হচ্ছে। কিন্তু প্রতিবাদকে দমন করা যাচ্ছে না।
এরকম এক আবহে ৩৮৫ ঘণ্টা অনশন (শুধু জল খেয়ে, কারো ১৬ কেজি কারো ১২ কেজি, ১১ কেজি ওজন কমেছে) করার পর অভয়ার মা-বাবার অনুরোধে যখন অনশন প্রত্যাহার করে গুরুতর শারীরিক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হয় তখন শাসকদলের ও রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের তাচ্ছিল্যের মন্তব্যে বুঝতে অসুবিধা হয়না যে, মৌচাকে ঢিল পড়েছে।
জুনিয়র ডাক্তারদের সেই অংশটা যারা মেডিক্যাচল কলেজগুলিতে থ্রেট কালচারের অংশীদার, পরীক্ষায় দুর্নীতি সহ সব ধরনের দুষ্কর্মের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত, যাদের বিরুদ্ধে মেডিক্যাল পড়ুয়া ও জুনিয়র ডাক্তারদের ভূরি ভূরি অভিযোগ তারা নতুন সংগঠন করে নিজেদের পরিচয় চিনিয়ে দেয়।
আর তখনই ৮০টির বেশি সংগঠন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, যারা বিগত ৮২ দিন ধরে রাস্তায়, মহল্লায়, অফিসে, পাড়ায় প্রতিবাদ আন্দোলনে শামিল, তাঁরা একত্রিত হয়ে সময়ের দাবিতে ‘অভয়া মঞ্চের’ জন্ম দেয়। আন্দোলনের নতুন পথ, নতুন আঙ্গিক প্রস্তাবিত হয়, গৃহীত হয়। শপথ নেয় বেঁধে বেঁধে হাতে হাত রেখে মিলিত লড়াইয়ের। কেননা-
‘‘তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয় ।
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে,
বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পতনের শব্দ।...
আমি প্রস্তুত হচ্ছি আমি সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেব...’’
Comments :0