সুরঞ্জনা ভট্টাচার্য
শীত শব্দটাই অনেকের কাছে অজস্র মানে নিয়ে আসে। আমার কাছে তো শীত মানেই নলেন গুড়, কড়াপাকের সন্দেশ। আমার এক বান্ধবীর কাছে তার ছেলেবেলার স্মৃতি। শীত বললে তার মনে হয় হিমেল হাওয়ার চাদর মুড়ে গ্রামের ঘুম, সবুজ ঘাসের ওপর মুক্তোর মতো পড়ে থাকা শিশির আর চাষিদের বাঁকে করে খেজুর রস বিক্রির ছবি। এতসব, এতকিছু নিয়ে শীত তার আসর সাজিয়ে বসে। আজও, এখনও কি ভয়ানকভাবে শীত তার সামগ্রী নিয়ে এমন বর্ণময়ভাবে বহমান।
রকমারি শীত পোশাক পরে সকলে যেন কোনও এক অজানা পিকনিকে হাজির। তারপর কী, তারপরেই বা কী জানবার দরকার খুব একটা নেই। তারা সকলেই তো জানে এমন বহমান শীতই সবকথা বলে দেবে। কারণ তীব্র গরম আর থকথকে কাদার পরে শীত এই মন্থর জীবনে ঝকঝকে আনন্দ নিয়ে আসে। তার নাম ‘উৎসব’।
এতক্ষণ তো হলো কথার কথা। আসল কথা এই মরশুমের খাওয়া দাওয়া। ‘সারাজীবন থেকে যেতে ইচ্ছে করে’- শীত তোমার সাথে। কেন ? তাহলে মরশুমের ওলটপালটে আনন্দ পাওয়ার উপায় কী ? থেকে যাও শীত, এসবের মধ্যে স্বাভাবিকতা নেই। নেই নতুনের আবাহন। নতুন গুড়ের সন্দেশ তখনই খাবেন যখন কড়াপাকের কিন্তু নরম অর্থাৎ একেবারে গরম অবস্থায়। সন্দেশের ওই ক্ষণস্থায়ী অবস্থায় খেতে হবে দোকানে বসেই। বাড়িতে আনা চলবে না। কলকাতায় এমন দোকান এখন আর খুব বেশি নেই। কড়াপাকের সন্দেশ কেন! শীতের চাদর আদরে জড়িয়ে সকালটা শুরুই হয় না কেসি দাসের কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুর দম। ময়দা যে মাখা হয় তার মধ্যে যেন একটা সবুজ আভা থেকে যায়। এসব ক্ষেত্রে ময়দা মাখাটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। পরতে পরতে ভালোবাসা দিয়ে রীতিমতো নরম করে এমনভাবেই ময়দা মাখা হয় যে সঠিক পরিমাণে কড়াইশুঁটির পুর দিলে চারপাশ থেকে বেরিয়ে পড়ে না।
শ্যামবাজার বিধান সরণিতে ট্রাম ডিপো থেকে তন্তুজ-এর দোকান পর্যন্ত কোনও একটি জায়গায় এক সময় দ্বারিকের দোকান ছিল। সামনেই একটা ফেস্টুন টানানো থাকত। তার ওপরে লেখা ‘শীতের শন্দেশ ও শুঁটির কচুরি’। পাশে ছবিতে একটি লোক কাঁধে হাঁড়ি ঝুলিয়ে গাছে উঠছে। স্বাভাবিকভাবেই ক্রেতাদের আকর্ষণ করার জন্য। জেনে বা না জেনে হয়তো ক্রেতার চোখ টানতে কাজে লেগেছিল ওই ভুল বানান। এখন অবশ্য দ্বারিকের দোকান ওইখানে নেই। তখন রাধা সিনেমার কাছেও দ্বারিকের একটি দোকান ছিল। তবে এখন আর তা নেই।
এক সময় কারো বাড়ির উঠোনে ধানের শিষে বিনুনি করে সরষে ফুল, মুলো ফুল, গাঁদা ফুল লক্ষ্মীর হাঁড়িতে বেঁধে পৌষপার্বণ শুরু হতো। তারপর নতুন খেজুর গুড়, নতুন চালের গুঁড়ো, নারকেল, দুধ দিয়ে কতরকমের পায়েস, রকমারি চোখধাঁধানো সব পিঠে তৈরির পালা। সেই পিঠেপুলি এখন বাড়ি ছেড়ে আজ এই মেলা তো কাল সেই মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। গ্রাম বাংলার এই উৎসবের মধ্যে এত যে শিল্পের ছোঁওয়া আছে আজ কতজনই বা বোঝে !
রাস্তার দশজন পথচারীকে ডেকে জিজ্ঞাসা করুন শীত মানে কোন খাবারের কথা মনে পড়ছে। অন্তত ছয়জন উত্তর দেবেন নতুন গুড়ের পিঠে, পায়েস। আবার নতুন জেনারেশনের কেউ হয়তো কাবাব বা চাইনিজও বলতে পারেন। তবে এখনও সিংহভাগ মানুষই যে পিঠে, পায়েসের কথা বলবেন তা একরকম নিশ্চিত। বাংলা জুড়ে পৌষ মাসের শেষ দিনে এখনও বিভিন্ন বাড়িতে পায়েস, পিঠে তৈরি হয়। যারা পারেন না তাঁদের জন্য তো পাড়ায় পাড়ায় পিঠের দোকান।
বাংলার কাব্যে, গানে, আখ্যানে, লোকগল্পে, ছড়ায়, কবিতায় – কোথায় নেই পিঠে ! গপ্প আছে না, দাসীর দুষ্টু বুদ্ধির কাছে হেরে গিয়ে রানি পাটরানি হলেন চন্দ্রপুলি, মোহনবাঁশি, ক্ষীরমুরলী, চন্দনপাতা এসব পিঠে বানিয়ে। মাঘ মাসে পিঠে খাওয়া শুরু, ফাল্গুনে শেষ। চৈত্রেও পিঠের লোভ ছাড়তে পারেন না অনেকে। কিন্তু সেটা তেমন জমে না।
সম্ভবত নতুন ধান থেকে তৈরি চালে যে সুঘ্রাণ আর আর্দ্রতা থাকে, পিঠে বানানোর আটা তৈরিতে সেই চাল আদর্শ। ধান যত পুরানো হয় আর্দ্রতা হারাতে থাকে। ফলে সেই চালের আটায় তৈরি পিঠে আর সুস্বাদু থাকে না। হেমন্তে নতুন ধান উঠলে মেয়েরা ঢেঁকিতে পিঠের জন্য চালের গুঁড়ো বানাতেন। এখন আর ঢেঁকির প্রচলন খুব একটা নেই। এখন ‘কল’ থেকে চালের গুঁড়ো আনা হয়।
নতুন গুড়ের রস যারা চেখে দেখেছেন তারা নমস্য ব্যক্তি। আর পিঠে ! ক্ষীরপুলি, চন্দ্রপুলি, পোয়া পিঠে, ভাপা পিঠে, ছাঁচ পিঠে, ছিটকা পিঠে, আস্কে পিঠে, চাঁদ পাকন পিঠে, সুন্দরী পাকন, সর ভাজা, পুলি পিঠে, পাতা পিঠে, পাটিসাপটা, মুঠি পিঠে, আন্দশা, লবঙ্গ লতিকা, নকশি পিঠে ইত্যাদি কত যে পিঠের সম্ভার রয়েছে তা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। চৈতন্যচরিতামৃতে রয়েছে, পঞ্চাশ ব্যঞ্জনের সঙ্গে তৈরি হচ্ছে ‘ক্ষীর পুলি, নারকেল পুলি ইত্যাদি।’ কিন্তু পিঠেকে প্রজন্মান্তরে জনপ্রিয় রাখার কৃতিত্ব সম্পূর্ণ নারীদের। সে কারণে পিঠের স্বাদের গুপ্ত বিদ্যার সন্ধান পাওয়া যায় গৃহিণী ও দিদিমা-ঠাকুমাদের অভিধানেই। তবে এই গতিময় যুগে বাড়িতে এসব বানানোর সময় কোথায়! অগত্যা দোকানই ভরসা। ওই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো।
কম যায় না জয়নগরের মোয়াও। শীতের বাজারে সেও সংসার গুছিয়ে রয়েছে। বিদেশেও পাড়ি দিচ্ছে। নানা বাক্সে নানা জায়গায় জয়নগরের মোয়া বিক্রি হয় বটে, তবে জয়নগরের স্বাদ আদৌ সব মোয়ায় মেলে না।
আর, বাজার ভরা অজস্র রঙ-বেরঙের শাক-সবজি! অনেকেই বলবেন এখন সব ধরনের সবজি বছরভর পাওয়া যায়। মানছি তো পাওয়া যায়। কিন্তু শীতের রং, স্বাদ, গন্ধ, টাটকা অনুভূতি এ সবই পাওয়া যাবে এই শীতকালেই।
ম্যাকডোনাল্ড আর কেএফসি-এর যুগেও যে পিঠে-পায়েস এখনও টিকে রয়েছে সেটাই একটা নতুন ‘যুদ্ধ’ নয় কি?
Comments :0