চিন্ময় কর: মেদিনীপুর
বিদ্যাসাগরের মায়ের নামে স্কুল। বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত স্কুল। বিদ্যাসাগর স্বয়ং এই স্কুলের ক্লাসরুম বানানোয় হাত লাগিয়েছিলেন। ঘাটালের বীরসিংহ গ্রামের এই স্কুলের নামে জড়িয়ে আছে বিদ্যাসাগরের মায়ের নাম— বীরসিংহ ভগবতী বিদ্যালয়।
সেই স্কুলে বাংলা পড়ানোর শিক্ষক নেই!
স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির এক তৃণমূল সমর্থক সদস্যর কথায়,‘‘নেই বলবেন না। আছেন, একজন।’’ কতজন দরকার? তাঁর উত্তর,‘‘৩ জন থাকার কথা। কিন্তু পাবো কোথায়? পাঁচ বছর আগে ১জন শিক্ষক শুধু জয়েন করেছেন। তিনি অবশ্য বাংলার নয়। ইকোনমিক্সের।’’ পঞ্চম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয়। এতগুলি ক্লাসে একজন শিক্ষক বাংলা পড়াতে পারেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বললেন,‘‘কী করা যাবে বলুন। অন্য শিক্ষকরাই পড়িয়ে দেন।’’
অর্থাৎ অঙ্ক, জীবন বিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞানের শিক্ষকরা নিজেদের ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন ক্লাসে বাংলা পড়ান।
মমতা ব্যানার্জির স্লোগান ‘জয় বাংলা।’ বিদ্যাসাগরের তৈরি স্কুলে বাংলা শিক্ষার হাল এমনই।
শুধু বাংলা নয়। বিদ্যাসাগরের ভিটের অদূরে এই স্কুলে ৩৭জন শিক্ষক থাকার কথা। আছেন ২২জন। নভেম্বরে সংস্কৃতর একমাত্র শিক্ষক অবসর নেবেন। তার দু’মাস পরে কৃষিবিজ্ঞানের অবস্থাও তাই হবে। নতুন নিয়োগের কোনও সম্ভাবনা নেই। শিক্ষক নেই নিউট্রিশনেরও। এই ক্ষেত্রে একটি যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা হয়েছে স্কুলের। একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র জানালেন,‘‘স্থানীয় এক মহিলাকে আমাদের নিউট্রিশন টিচার হিসাবে এনেছিল স্কুল। মাসে তাঁকে ২০০০টাকা করে দেওয়া হতো। আজকের দিনে ওই টাকাতে কেউ পড়ান? তিনি মাস চারেক আর আসেন না।’’ তাহলে ওই বিষয়ে পড়াশোনা হয় কী করে? তফসিলি জাতিভুক্ত ছাত্রটির কথায়,‘‘বাইরে প্রাইভেট টিউশন দেওয়ার শিক্ষক আছে। সেখানেই যায় বন্ধুরা। আর তো কিছু করার নেই।’’
গত ১২ বছরে এই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা ১১০০ থেকে ৮০০-তে নেমে এসেছে। নতুন কোনও ক্লাসরুম হয়নি। গত ১২ বছরে ১০জন শিক্ষক অবসর নিয়েছেন। নিয়োগ হয়েছে ১। কোন রকমে চলছে পড়াশোনা।
শুধু বীরসিংহেই এমন হাল তা নয়। শিক্ষায় এগিয়ে থাকার গরিমা যে জেলার সম্পদ, সেই পশ্চিম মেদিনীপুরের বেশিরভাগ স্কুলের হাল এমনই।
‘স্কুল বাঁচাও মূল বাঁচাও’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন স্কুলগুলিতে যাচ্ছে। শিক্ষা সংক্রান্ত দাবি এবং স্কুলগুলির সমস্যা সঙ্কটের তথ্য সংগ্রহ করছে। সংগঠনের জেলা সম্পাদক রণিত বেরা বলেন ইতিমধ্যে গত ছ’ দিনে মেদিনীপুর শহর, খড়্গপুর শহর, কেশপুর, ঘাটাল, দাঁতন এমন চারটি ব্লক মিলিয়ে ৪২ টি স্কুলে দাবি সনদ দিয়ে ডেপুটেশন সহ ছাত্র-ছাত্রীদের কাজ থেকে তাদের স্কুলের ও পড়াশোনার সমস্যার তথ্য তুলে আনা হয়েছে। শহরের স্কুলগুলিতে শিক্ষকের অভাব ততটা নেই। রাজ্য সরকারের নীতির কারনে গ্রামের স্কুলগুলি থেকে স্থানান্তরিত হয়ে শিক্ষকরা চলে আসায় সেখানেই শিক্ষক সঙ্কট মারাত্মক। আর শহরের স্কুলগুলিতে নানান কায়দায় ও অজুহাতে সরকার নির্ধারিত ফিজ ২৪০ টাকার জায়গায় বহু গুন বেশী নেওয়া হয় সেই তথ্যও উঠে এসেছে।
কী অবস্থা কেশপুরের গোলাড় সুশীলা বিদ্যাপীঠের?
স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুরেশ রঞ্জন পড়ুয়ার কাছে এসএফআই ডেপুটেশন দিতে গিয়ে এবিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, তাদের স্কুলে মাত্র ৩০ জনকে হস্টেল স্টাইপেন্ড অনুমোদন দিয়েছে শিক্ষা দপ্তর। আগে ১০০ অধিক পড়ুয়া হস্টেলে থাকতো। সেই বাবদ টাকা স্কুলে আসতো। এখন সরাসরি পড়ুয়াদের অ্যাকাউন্টে প্রতি মাসে ১০০০ টাকা করে হিসাবে ১০ মাসের টাকা দেয় সরকার। হস্টেল চালাতে গেলে রাঁধুনি সহ দেখভাল করার হস্টেল সুপারদের জন্য আগের মতো বরাদ্দ হয় না টাকা। ফলে স্কুলগুলি হস্টেল চালাবে কী করে? ওই ১০০০ টাকায় সারা মাস খাওয়া, বিদ্যুতের বিল হয় না। রাধুনী খরচ সহ আনুষাঙ্গিক খরচ স্কুলের উপর চাপিয়ে দিয়েছে সরকার।
স্কুলটিতে ১১০৯ জন পড়ুয়া। ২৫ জন শিক্ষকের জায়গায় রয়েছেন ১৮ জন। ১২বছর জীবন বিজ্ঞান শিক্ষক নেই। ইতিহাস পড়ানোর জন্য কোন শিক্ষক নেই। আমরা ৩৫ মিনিটের ক্লাসকে বাড়িয়ে ৪৫-৫০ মিনিট করে নিয়ে সামাল দেই। তিনি বলেন স্কুলে ৩২৯ জন তফসিলি জাতি ও উপজাতি পড়ুয়া রয়েছেন। বেশির ভাগই দিনমজুর পরিবারের। এই পড়ুয়ারা হস্টেলে থাকার সুযোগ পেলে ভালো লাগতো। আমাদের হাত পা বাঁধা।
এই কেশপুর ব্লকের উঁচাহার হাই স্কুল। হাজারের অধিক পড়ুয়া। ফলে ১৪ জন শিক্ষক নিয়ে স্কুল চালানো হয় বলে জানান প্রধান শিক্ষক খোকন দাস। স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী পিয়ালী মণ্ডল বলেন,‘‘আমাদের অঙ্ক যিনি পড়ান তিনিই আবার পদার্থ বিজ্ঞান পড়ান। পিওর সায়েন্স বিভাগে কোনেও শিক্ষক নেই। একাদশ দ্বাদশ শ্রেণিতে নিউট্রিশন, কম্পিউটার সায়েন্স চালু হলেও আজ ১০ বছর কোনও শিক্ষক নেই।
Comments :0