হান্নান মোল্লা
একজন বয়োজ্যেষ্ঠের পক্ষে বয়োকনিষ্ঠ প্রিয়জনকে স্মরণ করার মতো বেদনাদায়ক পরিস্থিতি আর কিছু হতে পারে না। সীতারামকে স্মরণ করতে গিয়ে আমার মানসিক যন্ত্রণাই আমাকে তাড়া করছে। আমরা এক সঙ্গে চার দশক বিভিন্ন গণসংগঠন, গণআন্দোলন ও রাজনৈতিক আন্দোলনে কাজ করেছি— তাঁর বিস্তৃত বর্ণনা দেবার সময় এটা নয় এবং সেটা সম্ভবও নয়। প্রসঙ্গক্রমে সেসব কথা মাঝে মাঝে স্মরণে এলেও মূলত ব্যক্তিগত স্মৃতি চারণাই এই লেখনীর লক্ষ্য।
আমি ১৯৮০ সালে লোকসভায় নির্বাচিত হয়ে দিল্লি এসে প্রথমেই একটা অফিসের সন্ধান করতে ২২নং ভিট্টল ভাই প্যাটেল হাউসে হাজির হয়ে একজন তরুণ কমরেডকে টেবিলের পিছনে বসে লিখতে দেখে এগিয়ে গিয়ে কমরেড সীতারামকেই ডাকি। সেই অমায়িক সদাহাস্যময় ছেলেটিকে আমার খুব ভালো লেগে যায়। ফলে বন্ধুত্ব হতে বেশি সময় লাগে না। সীতারাম তখন তাঁর প্রিয় কাজ স্টুডেন্ড স্ট্রাগল-এর লেখার কাজে ব্যস্ত। প্রায় সারাদিনই সে এসএফআই’র অফিসে এসে সংগঠনের কাজ করত। গেটে একটা চায়ের দোকান ছিল— সেখান থেকে চায়ের সঙ্গে একটা ‘মাট্টি’ খেয়ে, সারাক্ষণ চারমিনার সিগারেট খেত। রোজ দুপুরে সংসদ থেকে ফিরে এসএফআই অফিস হয়ে যাবার সময় জিজ্ঞাসা করতাম— কিছু খেয়েছ। বেশিরভাগ সময়ই ‘না’শুনতাম। তাই আমার একটা কাজ হয়ে উঠেছিল, রোজ ওকে অফিস থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে আমার ঘরে দুপুরের খাবার খাওয়ানো। মাঝে মাঝে ইন্দ্রাণীও খাবার কথা বলতো। আবার সন্ধ্যায় ফিরে গিয়ে এসএফআই অফিসে চলতো আড্ডা। অসংখ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হতো। তখন বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের পরিধিতে মুগ্ধ হতাম।
ইতিমধ্যে পার্টি একটা সর্বভারতীয় যুব সংগঠন গড়ার পরিকল্পনা করায় সেই কাজে আমি যুক্ত হই এবং এসএফআই’র সহযোগী হিসাবে যুব সংগঠন গড়ার কাজে ব্রতী হই। আমি দিল্লিতে নতুন, তাই সেই কাজে সবসময় সীতারামের সাহায্য দরকার ছিল, কিন্তু এতে তাঁর কার্পণ্য ছিল না। পরে ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন তৈরি হলে আমাকে তাঁর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হলো। ফলে যুব-ছাত্র যৌথ কার্যকলাপ শুরু হয়, যাতে কমরেড সীতারামের প্রতিনিয়ত সহযোগিতা আমাদের রাজনৈতিক বন্ধুত্বকে সাংগঠনিক বন্ধুত্বে পরিণত করে। এই প্রক্রিয়ায় সর্বদাই সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকতো এসএফআই’র সম্পাদক কমরেড নেপালদেব ভট্টাচার্য এবং সহ সম্পাদক সৈফুদ্দিন চৌধুরি। কমরেড সীতারাম ছিল এসএফ আই’র সহ সম্পাদক এবং পত্রিকার সম্পাদক। কমরেড এমএ বেবীও এই গ্রুপের নিয়মিত অংশীদার ছিল। আমাদের এই গ্রুপই দেশে ছাত্র-যুব আন্দোলনের নতুন ধারা সৃষ্টির কাজ করেছিল।
এই কাজের অঙ্গ হিসাবে আমরা যৌথ আন্দোলনে অংশ নিতে থাকি। দশটির বেশি ছাত্র-যুব সংগঠন নিয়ে যুক্ত সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলি আমরা। সেই কাজে কমরেড সীতারামের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন যুব-ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক— আমাদের যৌথ আন্দোলন গড়তে সাহায্য করে। আমরা একটা সর্বভারতীয় যুব-ছাত্র সমাবেশের পরিকল্পনা করি। ১৯৮১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ‘সকলের জন্য কাজ ও শিক্ষার’দাবিতে দেশের এ যাবৎকালের বৃহত্তম সমাবেশ দিল্লির বোট ক্লাব ময়দানকে ভরিয়ে দেয়। একাজে কমরেড সীতারাম কঠোর পরিশ্রম করে ঐ ঐতিহাসিক আন্দোলনকে সফল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল।
পরবর্তীকালে দেশে ছাত্র-যুবদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি সক্রিয় হয়। আসামে ও পাঞ্জাবে ঐসব শক্তি দেশের ঐক্যের বিরুদ্ধে যড়যন্ত্র করে। আমরা ছাত্র-যুবরা এর বিরুদ্ধে ঐক্যের বার্তা নিয়ে রাস্তায় নামি। ঐ সংগ্রামে মতাদর্শগত আলোচনা ও লেখার কাজে সীতারামের লেখনীর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র, জাতীয় ঐক্য এবং সমাজতন্ত্রের বার্তা প্রচারে আমরা মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলাম। সাম্প্রদায়িকতা ও ভাষাগত বিষয়ের বিরুদ্ধে স্টুডেন্ড স্ট্রাগল ও ইউথ স্ট্রিম এই পত্রিকা যে নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েছিল, কমরেড সীতারামের লেখা ঐসব পত্রিকার পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে।
পার্টির ছাত্র-যুব সাব কমিটির নেতৃত্বে সঠিক মতাদর্শের সংগ্রামে আমাদের ভূমিকা ছিল উজ্জ্বল। কমিটির কনভেনর হিসাবে প্রথমে আমি এবং পরে সীতারাম দেশের যুব, ছাত্র আন্দোলনকে সঠিক দিশা দেওয়ার কাজ করে। দ্বাদশ পার্টি কংগ্রেসে কমরেড সীতারামের সঙ্গে আমিও কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হই। পরে কমরেড সীতারাম কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী ও পলিট ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হয়ে ছাত্র-যুব আন্দোলনের সঙ্গে বৃহত্তর গণআন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দেশের রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদী আরএসএস’র সক্রিয়তা যে চ্যালেঞ্জ আনে, তাঁর বিরুদ্ধেও কমরেড সীতারামের সংগ্রাম অবিস্মরণীয়। তাঁর আরএসএস’র বিরুদ্ধে এবং দেশের ঐক্য ও গণতন্ত্রের পক্ষে লেখাগুলি দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সঠিক পথ দেখিয়েছে এবং এই প্রশ্নে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা আজও আমাদের ঐ সংগ্রামের আলোকবর্তিকা। এইসব বিভিন্ন প্রশ্নে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা সর্বদা আমাদের সাহায্য করেছে।
দেশের রাজনীতির বিবর্তনের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ করে কোয়ালিশন যুগের আগমনে যুক্তফ্রন্ট গড়ার প্রচেষ্টা এবং কমরেড সুরজিৎ ও জ্যোতি বসুর কর্মপদ্ধতির থেকে শিক্ষাগ্রহণ, সীতারামকে এই প্রশ্নে অনেক অভিজ্ঞ করে তোলে। তাই দেশে বিভিন্ন কোয়ালিশন সরকার গড়ার কাজে তাঁর সক্রিয়তা খুবই উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে মনমোহন সিংহ সরকারের কার্য পরিচালনায়, ন্যূনতম কর্মসূচি প্রণয়নে এবং বিভিন্ন সমস্যায় তাঁর যথাযথ হস্তক্ষেপ আমরা দেখেছি। এ সময়ে অনেক প্রশ্নে অনেকের ভিন্ন মত হলেও আমি তাঁর কাজকে সবসময় সঠিক বলে মনে করেছি। মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ‘বাস্তবঘটনার বাস্তব বিশ্লেষণে’ সে সব সময় দৃঢ় থেকেছে এবং সঠিক অবস্থানের জন্য সংগ্রাম করেছে।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ওপর তাঁর গভীর জ্ঞান আমাদের পার্টির অর্থনৈতিক নীতির বিশ্লেষণে এবং নব উদারবাদের সঠিক মূল্যায়নে আমাদের প্রভূত সাহায্য করেছে। বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও সমাজবাদী শিবিরের অবসানের সময় পার্টিতে যে চরম নিরাশা, হতাশা ও অবিশ্বাসের বাতাবরণের সৃষ্টি করেছিল, কমরেড সীতারামের গভীর মার্কসবাদী বিশ্লেষণ পার্টি কমরেডদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে।
আন্তর্জাতিক স্তরে বিভিন্ন দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর সঙ্গে আমাদের পার্টির সম্পর্ককে দৃঢ় করা, তাদের বিশ্বাস অর্জন করে আমাদের পার্টির চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে কমরেড সীতারামের ভূমিকা অতুলনীয়। যার ফলে আন্তর্জাতিক স্তরে আমাদের পার্টির মর্যাদা সবসময়ই বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিগত দু’দশকে দেশের কৃষক আন্দোলনে যে নতুন পরিবর্তন এসেছে, যে ক্ষেত্রে আমাদের কৃষকসভার ভূমিকা সর্বাধিক, সেখানে আমাদের কর্মনীতি নির্ধারণে ও তাঁর প্রয়োগে সর্বাধিক সাহায্য পেয়েছি কমরেড সীতারামের কাছ থেকেই। যদিও শুরুতে নতুন ধরনের কৃষক ঐক্যের ধারণাকে অনেকে অপব্যাখ্যা করে বা ভুল বলে দেখানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু পরবর্তীকালে তার সাফল্য সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এই সংগ্রামে প্রতিপদে পরামর্শ দেওয়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন জোগাড় করা এবং প্রতি স্তরে আন্দোলনকে উৎসাহিত করায় সীতারামের ভূমিকা আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যক্ষ করেছি এবং তাঁর বাস্তব বুদ্ধির প্রমাণ দেখেছি।
বিশেষ করে যখন ফ্যাসিবাদী ঝোঁকের বৃদ্ধি এবং সরকারি যন্ত্রকে আরএসএস’র কুক্ষিগত করা এবং কর্পোরেটের হাতে দেশকে তুলে দেবার ষড়যন্ত্রের চেষ্টা এবং সাম্প্রদায়িকতা দেশের মূলমন্ত্রে পরিণত হওয়ার বিপদ দেখা দিয়েছে, তখন আমাদের সংবিধান, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষায় কমরেড সীতারামের সাহসী ভূমিকাকে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হিসাবে দেশের মানুষ মনে রাখবে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে চিন্তার সমতা সৃষ্টির যে প্রয়াস সীতারাম করেছে তা অতুলনীয়। তাঁর ঐকান্তিক ও কঠোর প্রচেষ্টা যে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ মোর্চা গঠনে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা আজ সর্বজন স্বীকৃত। সাথে সাথে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টায় নানা অসুবিধা সত্ত্বেও সীতারামের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস ছিল। আজ তাঁর অনুপস্থিতি ঐ গণতান্ত্রিক ঐক্য ও বামপন্থী ঐক্যের ক্ষেত্রে এক গুরুতর সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে— আমার এ আশঙ্কা রয়েছে।
সেইসঙ্গে সংগঠনই কমিউনিস্টদের প্রধান অস্ত্র— এই বিশ্বাসকে রূপায়িত করতে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে সীতারাম কঠোর প্রয়াস চালিয়েছিল। পার্টির মধ্যে রাজনৈতিক ও নীতিগত ঐক্য ও সাংগঠনিক ঐক্য সৃষ্টির নিরলস প্রয়াস তিনি চালিয়েছেন। এই প্রশ্নে আমরা বহু আলোচনা করতাম এবং তাঁর বেদনার আমি সাক্ষী। গণপার্টি থেকে গণবিপ্লবী পার্টি গড়ায় তাঁর প্রচেষ্টা ছিল নিরলস। কিন্তু সাফল্যের ধীর গতিতে তাঁর মানসিক যন্ত্রণাও দেখেছি। তাঁর মধ্যে কমিউনিস্টসুলভ অনেক গুণই ছিল। কমরেডদের প্রতি ভালোবাসা, সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার, মতভেদকে মনোভেদ হিসাবে না দেখা, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলা— এইসব গুণের প্রতিফলন তাঁর ব্যবহারে ও কাজে সবাই প্রত্যক্ষ করেছেন, সন্দেহ নেই। মতভেদ সত্ত্বেও বিভিন্ন দলের কাছে ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা একজন রাজনৈতিক নেতার গুরুত্বপূর্ণ গুণ হিসাবেই বিচার্য। মতাদর্শের প্রতি অবিচল থেকেও যে বাস্তবতাকে উপেক্ষা করা উচিত নয় এবং সেই বাস্তবতার বাস্তব বিশ্লেষণ করেই তাকে প্রয়োগ করা উচিত, তাঁর এই বোধ আমি ওর সঙ্গে থেকে বারেবারেই উপলব্ধি করেছি।
জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে তাঁর জ্ঞানের ব্যাপক গভীরতা ও উপলব্ধি তাঁকে একজন মহৎ মানুষ, জনপ্রিয় নেতা এবং আদর্শ কমিউনিস্ট হিসাবে গড়ে উঠতে সাহায্য করেছিল। জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাঁর সাফল্যই এর প্রমাণ। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ নেতা, সহৃদয় মানুষ। সর্বক্ষেত্রে প্রতিভাবান চিন্তাবিদ, আদর্শ কমরেড ও বন্ধু— তাই তাঁর অনুপস্থিতি একটা বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করেছে, যা কোনও একজন বা একদল নেতা সহজে পূরণ করতে পারবে কিনা সন্দেহ। তবে এটাই জীবনের নিয়ম— যিনি চলে গেলেন, তিনি তাঁর পথের নিশানা রেখে গেছেন। আমাদের তাকে অনুসরণ করে তাঁর স্বপ্নকে সফল করার চেষ্টা চালাতে হবে। কমরেড সীতারাম লাল সেলাম।
Comments :0