‘নতুন তৃণমূল’-র খোঁজ পাওয়া গেল রবিবার, দলের ঘোষিত প্রতিষ্ঠা দিবসে। কিন্তু দলনেত্রী পাত্তা দিলেন না সেই তৃণমূলকে।
দলের নতুন ভবনের ভূমিপুজো হলো মমতা ব্যানার্জির ভাইপোর হাতে, এদিন। যজ্ঞ হলো। পুরোহিত মন্ত্র পড়ালেন। উত্তর পঞ্চান্ন গ্রামে এই পুজোর আয়োজন ছিল। সেখানেই অভিষেক বললেন, ‘‘আমি গত জুন মাসে জলপাইগুড়িতে একটি সভায় বলেছিলাম নতুন তৃণমূল। সেই নতুন তৃণমূল কী? সবাই জানতে চেয়েছিল। দুর্নীতি প্রমাণিত হলে তৃণমূল বরদাস্ত করবে না। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেব। এটাই নতুন তৃণমূল। দুর্নীতি করে কেউ দলে থাকতে পারবেন না।’’
নতুন বোতলে পুরোনো পানীয়। নারদ স্টিং অপারেশনের পরে মমতা ব্যানার্জি কী বলেছিলেন? অভিযুক্তদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘‘আগে জানলে প্রার্থী করতাম না।’’ পরে সেই ফিরহাদ হাকিম, সুব্রত মুখার্জি, শুভেন্দু অধিকারীর মত সেই অভিযুক্তদেরই মন্ত্রী বানিয়েছিলেন।
এদিন মমতা ব্যানার্জি দুর্নীতি নিয়ে কিছুই বললেননি। তিনি কী বললেন?
এদিন দলের ২৪তম জন্মদিনে মুখ্যমন্ত্রী ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে ‘নতুন-ফতুন’ কোনও শব্দ নেই। মমতা ব্যানার্জি লিখেছেন,‘‘...আজ আমরা তৃণমূল কংগ্রেস পরিবারের প্রতিটি কর্মীর আত্মত্যাগ এবং নিরলস প্রচেষ্টাকে কুর্ণিশ জানাচ্ছি। তাঁরাই দলের সম্পদ।’’ তিনি আরও লিখেছেন,‘‘আমাদের প্রধান লক্ষ্য এই বৃহৎ গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর প্রতি সুবিচার নিশ্চিত করা।’’
অর্থাৎ মমতা ব্যানার্জির দলের জন্মদিন পালনে বার্তা দুটি— প্রথমত, ‘দলের সম্পদ’ যারা দলের হয়ে কাজ করেন সেই প্রতিটি কর্মী। সেখানে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ না সৎ —তার কোনও লক্ষ্মণরেখা টানেননি মমতা ব্যানার্জি। দ্বিতীয়ত, ঘোষিত লক্ষ্য ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর প্রতি সুবিচার।’ নরেন্দ্র মোদীর শাসনে সাম্প্রদায়িক শক্তির আঘাতে দেশ বিপন্ন। সংখ্যালঘুরা আশঙ্কিত। এমন সময়ে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি ‘সুবিচার’-র কোনও লক্ষ্য মমতা ব্যানার্জির নেই। মানে তৃণমূলের নেই।
তবে অভিষেকও বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কোনও ঘোষণা করেননি। পিসির সঙ্গে তাঁর মিল এখানেই।
প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তৃণমূলের কাছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কোনও ইস্যু নয়। গোড়া থেকেই মমতা ব্যানার্জির দল বিজেপি’র মিত্র, আরএসএস’র স্নেহধন্য। ‘বিজেপি অচ্ছুৎ নয়’— দল তৈরির আগে থেকেই বলছিলেন মমতা ব্যানার্জি। আর তৎকালীন বিজেপি’র লৌহপুরুষ লালকৃষ্ণ আদবানি মমতা ব্যানার্জির অবস্থান সম্পর্কে, ১৯৯৭-র ১১ ডিসেম্বর বলেছিলেন,‘‘কেন্দ্রে নিজেদের উপস্থিতির তুলনায় অনেক বেশি শক্তি মার্কসবাদীরা অর্জন করেছে রাজনৈতিক কৌশলের মধ্যে দিয়ে। মার্কসবাদ-বিরোধী লড়াই যিনিই করবেন, বিজেপি তাকে সমর্থন করবে। মমতা ব্যানার্জি বলেছেন বিজেপি অচ্ছুৎ নয়। তার এই অবস্থানকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি।’’
দল তৈরির আগেই আরএসএস তথা বিজেপি’র শীর্ষনেতাদের বরাভয় পেয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। গত ১১ বছরেও সেই বোঝাপড়া দেখা গেছে। সারদা কেলেঙ্কারি, নারদ স্টিং অপারেশনের মতো কোনও তদন্ত চূড়ান্ত চেহারা নেয়নি। তৃণমূল থেকে বিজেপি গিয়ে দুর্নীতিতে অভিযুক্ত অনেকেই নেতা হয়েছেন।
এদিন এই প্রসঙ্গে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী একসময়ে বলেছিলেন তিনি গুন্ডা কন্ট্রোল করেন। এখন গুন্ডারাই তাঁকে কন্ট্রোল করছে। সবই হচ্ছে তৃণমূল আর বিজেপি’র ঝান্ডার নিচেই। সবাই সব জানে। চোরে চোরে সব একাকার হয়ে গেছে। ওরা শিশুদের খাবার চুরি করছে, ছাত্র-ছাত্রীদের মিড ডে মিলের খাবার চুরি করছে। যাদের কাছে টাকা আছে তারা সেই জোরে নিজেদের সর্বোচ্চ ভাবছে। টাকার জোর থাকলে তৃণমূলের বিশাল বিশাল পার্টি অফিস ভবন হবে না কেন?’’
তৃণমূল আসলে কাদের দল— ভালো জানেন মমতা ব্যানার্জিই। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই জানতেন। তাই মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যেই ভবানীপুর থানায় ছুটে গিয়েছিলেন আইনশৃঙ্খলা ভেঙে গ্রেপ্তার হওয়া কর্মীদের ছাড়াতে। আলিপুর থানায় পুলিশ টেবিলের তলায়, ফাইলে মাথা ঢেকে লুকিয়েছিল তৃণমূল কর্মীদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে। রবিবার দলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদ্যাপন করতে গিয়ে রাজ্যের বেশ কয়েকটি জায়গায় হাঙ্গামা করেছে তৃণমূল কর্মীরা। মূলত দলের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষই হয়েছে।
মহম্মদ সেলিম এদিন আরও বলেন, ‘‘মমতা ব্যানার্জি’র তৃণমূল ও নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি তাদের টিআরপি বাড়াচ্ছে। কারণ পঞ্চায়েত নির্বাচন সামনে আছে। নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ’র আনাগোনা বাড়বে। বিজেপি স্বচ্ছ ভারত বানাবে বলেছিল, আর তৃণমূল বলেছিল সোনার বাংলা বানাবে। কি করে সেসব হবে। কিছু বানাতে গেলে তো কিছু পদার্থ লাগে, যাকে ‘র-মেটেরিয়ালস’ বলা হয়। তৃণমূল আর বিজেপি’র মধ্যে সে সব কোথায়। কীভাবে বানাবে তাহলে।’’
Comments :0