TEACHER RECRUITMENT SCAM FOLLOW UP

টাকার বিনিময়ে প্রার্থী তালিকা পাঠাতেন যুব তৃণমূল নেতা

রাজ্য জেলা

২০১৬ থেকে ২০২১। এই পাঁচ বছরে টেটে পাস করিয়ে দেওয়া এবং প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে চাকরির ‘গ্যারান্টি’ দিয়ে কয়েক হাজার চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলেছিলেন যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষ। এক্ষেত্রে ব্যাঙের ছাতার মতো রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গজিয়ে ওঠা বিএড, ডিএলএড কলেজের ছাত্ররাই ছিল মূল ‘টার্গেট’। সিংহভাগ কলেজের সঙ্গেই যুক্ত শাসক তৃণমূলের নেতা, বিধায়করা। ফলে একটা ‘চক্র’ হিসাবেই প্রতারণার এই কারবার চলেছিল।


হুগলীর বলাগড়ের বাসিন্দা, মাত্র দুমাস আগেই তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বনে যাওয়া এই প্রতারক যুব নেতাকে আগামী সপ্তাহে সমস্ত নথিপত্র, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য নিয়েই হাজিরা দিতে নির্দেশ দিয়েছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দাবি যেভাবে বিএড কলেজগুলির ছাত্রদের পরীক্ষায় পাস করানো থেকে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার শর্তে টাকা তোলা হয়েছিল এবং যে পদ্ধতিতে তোলা হয়েছিল তাতে স্পষ্ট সংগঠিতভাবেই এই অপরাধ করা হয়েছে। প্রভাবশালী মহলের কাছেও সেই টাকার ভাগ পৌঁছাতো, ইতিমধ্যেই এই তদন্তে নেমে একাধিক সাক্ষীর বয়ানেও উঠে এসেছে সেই তথ্য।


সায়নী ঘোষের ঘনিষ্ঠ হিসাবেই যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক হিসাবে নাম ঘোষণা হয় কুন্তল ঘোষের। তার আগেই যদিও দলীয় স্তরেও টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। টাকার সরবরাহ ছিল বলেই পদ মিলেছে, স্পষ্ট ঘটনাবলিতেই। এমনকি ত্রিপুরা ভোটেও তৃণমূলের প্রচারের বিপুল পরিমাণ টাকা ঢেলেছিল এই প্রতারক যুব নেতা। ত্রিপুরায় তৃণমূলের ভোট প্রচারে ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গেই দেখা গেছে তাঁকে একাধিকবার।


কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি সূত্রে দাবি, তদন্তের গতিপথেই সামনে এসেছে একটি গোপন বৈঠকের প্রসঙ্গ। বাইপাস লাগোয়া একটি অভিজাত আবাসনে সেই বৈঠক হয়েছিল। সেখানেই এই বিপুল পরিমাণ টাকা তোলা এবং অযোগ্যদের তালিকা তৈরি করে যথাস্থানে পাঠানোর বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন প্রতারক যুব নেতা কুন্তল ঘোষও। নিয়োগকাণ্ডেই ধৃত মানিক ভট্টাচার্যও অবহিত ছিলেন এই বৈঠক সম্পর্কে। সেখানেই টাকা তোলার নকশা ঠিক হয়। মানিক ভট্টাচার্যকে সরাসরি অযোগ্যদের তালিকাও পাঠাতেন কুন্তল ঘোষ। তালিকায় নামের সংখ্যার হিসাবে টাকাও পৌছে দেওয়া হত তাঁর কাছে।


ইতিমধ্যে কুন্তল ঘোষকে জেরা করেও সামনে এসেছে আরও কয়েকটি নাম। হুগলীর জেলা পরিষদের এক তৃণমূলী কর্মাধ্যক্ষের নামও এসেছে। সেই নেতাকেও একাধিকবার জেলায় অভিষেক ব্যানার্জির সঙ্গে দেখা গিয়েছিল। 


ইতিমধ্যে সিবিআই’র কাছে এবং সাংবাদিকদের সামনে নিয়োগ দুর্নীতিতেই আরেক অভিযুক্ত শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল অভিযোগ করেছেন, শুধুমাত্র আমার জানার মধ্যেই ৩২৫জনের কাছ থেকে প্রাইমারি, আপার প্রাইমারিতে চাকরি দেওয়ার নাম করে ১৯কোটি ৪৪লক্ষ ৫০ হাজার টাকা তুলেছে কুন্তল ঘোষ। তাপস মণ্ডল আরও জানিয়েছিলেন, বিএড কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকেই টাকা তোলা হতো। তাঁর নিজের কলেজের ছাত্রছাত্রীদের তিনি পাঠিয়েছিলেন কুন্তল ঘোষের কাছে। ৩২৫জন পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রথমে ১লক্ষ টাকা করে নেওয়া হয়েছিল। তারপর চাকরি করে দেবার নাম করে ৫-৬লক্ষ টাকা করে মাথা পিছু নেওয়া হয়েছিল। যদিও সবাই চাকরি পায়নি, সেই টাকাও ফেরত পায়নি। আমি সিবিআই-কে সব নথি দিয়েছি। টাকা নিয়ে রিসিপ্ট কপিও দিত কুন্তল ঘোষ। সব নথি, সই আছে আমার কাছে। এছাড়াও আপার প্রাইমারিতেও চাকরি দেবার নামে টাকা নেওয়া হয়েছে।
অল বেঙ্গল টিচার্স ট্রেনিং অ্যাচিভার্স সংস্থার নামও বারেবারে আসে এই নিয়োগ দুর্নীতিতে।এই সংস্থা মূলত শাসক দলের নিয়ন্ত্রণে। আগে এর সভাপতি ছিল তৃণমূলের বীরভূম জেলা নলহাটি-২নম্বর ব্লকের সভাপতি বিভাস অধিকারী। পরবর্তীতে মানিক ভট্টাচার্য ও পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ হিসাবে তাপস মণ্ডলকে সভাপতি পদে বসানো হয়। গোটা রাজ্যে তাঁর বিএড, ডিএলএড সহ প্রায় কুড়িটি কলেজ, স্কুল রয়েছে। মহিষবাথানে ‘মিনার্ভা এডুকেশনাল অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’ নামে একটি সংস্থা চালান তাপস মণ্ডল। প্রাথমিক নিয়োগ দুর্নীতিতে মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গেই চার্জশিটে তাঁর নামও আছে।  


সিবিআইয়ের একটি সূত্রের দাবি, জেলায় জেলায় এমন চক্র গড়ে তোলা হয়েছিল শাসক দলের মদতেই, তা স্পষ্ট হচ্ছে। এই টাকার একটা বড় অংশ প্রভাবশালী মহলে পৌঁছেছে, সেই রুট জানার চেষ্টা হচ্ছে।
জানা গেছে, সম্ভবত মঙ্গলবার নিজাম প্যালেসে হাজিরা দেবেন কুন্তল ঘোষ। তাঁর গ্রেপ্তারির সম্ভাবনাও ক্রমেই বাড়ছে।

Comments :0

Login to leave a comment