Editorial

শাহর জোটবুদ্ধি

সম্পাদকীয় বিভাগ

প্রবল ছাত্র বিক্ষোভ আর জনরোষের মধ্যে বাংলাদেশের শেখ হাসিনা পরিচালিত সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে অনেকগুলি প্রশ্ন‍‌ চিহ্ন দেখা দিয়েছে। হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ছিল ভারতের অত্যন্ত ঘনিষ্ট বন্ধু। বস্তুত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী দেশ সমূহের মধ্যে ভারতের সঙ্গে সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল বাংলাদেশের। হাসিনার সরকারের পতন স্বাভাবিকভাবেই ভারতের দুশ্চিন্তা অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। নতুন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে এবং সেই সরকারের মাথায় ইউনুসকে বসানোর ক্ষেত্রে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও সেই সরকারের লাগাম কিন্তু চলে গেছে বিএনপি এবং জামাতের হাতে। শেখ হাসিনার দল আওয়ামি লিগকে যেমন ভারতপন্থী বলা হয় তেমনি বিএনপি ভারত বিরোধী বলে পরিচিত। আর জামাত নির্ভেজাল মৌলবাদী শক্তি এবং পাকিস্তানপন্থী। বিএনপি এবং জামাতের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা ঘনিষ্ট। রাজনৈতিকভাবে উভয়ই আওয়ামি লিগের ঘোরতর বিরোধী। বিএনপি-রাজনৈতিক প্রভাব অনেকটা জামাতের সহায়তা নির্ভর।
অতএব ধরে নেওয়া যায় বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক দৃঢ় করতে বি‍‌শেষ আগ্রহী হবে না। আবার বাংলাদেশের অর্থনীতির স্বার্থে ভারত পুরোপুরি অস্বীকার করারও উপায় নেই। এই অবস্থায় দু’দেশের সম্পর্ক যে একটা জটিল বিন্দুতে দোদুল্যমান সেটা সহজেই অনুমেয়। আবার এটাও মনে রাখার ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে কোনও তিক্ততা মোটেই কাম্য নয়। ভারতের নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর না হোক, কিন্তু তিক্ততা যেন কোনও অবস্থাতেই না হয়। মোদী সরকারের কূটনৈতিক দক্ষতা বা সাফল্য নিহিত আছে এই জায়গাতেই।
মোদী জমানায় মোদী ভক্তরা যতই তাঁকে বিশ্বগুরু বলে ঢাক পেটাক না কেন অন্তত প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি এক পা-ও এগতে পারেননি। বরং আগে যে সম্পর্ক ছিল সেটাও নষ্ট করেছেন ঔদ্ধত্য ও দাদাগিরির মনোভাবের কারণে। বামপন্থা তথা কমিউনিস্ট বিরোধিতার আদর্শগত জায়গা থেকে মোদী সরকার চীনের সার্বিক বিরোধিতার অবস্থান নিয়েছে আমেরিকার ঘনিষ্ট হবার বাসনায়। চীনের সঙ্গে এমন বৈরিতার সম্পর্কের জেরে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত চীন দ্বৈরথ তীব্র হতে চলেছে। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্রিয় হয়েছে চীন। আর চীন যত তাদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে ততই প্রতিবেশী দেশে ভারতের প্রভাব শিথিল হয়ে যাচ্ছে। নেপালের মতো দেশের সঙ্গেও ভারতের দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। ভুটানেও পা রাখতে চাইছে চীন। বাংলাদেশে চীনের প্রভাব যথেষ্ট বাড়লেও প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে ভালো সম্পর্ক ছিল বাংলাদেশের। এখন সেটাও হাতছাড়া হতে চলেছে।
এমন এক জটিল সন্ধিক্ষণ যখন কূটনৈতিক বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অত্যন্ত পদক্ষেপ করা প্রয়োজন তখন ভারতের কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিচ্ছে। সম্প্রতি ঝাড়খণ্ডে গিয়ে অমিত শাহ বলেছেন বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীরা ঝাড়খণ্ডে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে যে কয়েক বছর পর আদিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। এই মন্তব্যে তীব্র প্রতিবাদ করেছে বাংলাদেশ। তারা একে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের অসম্মান বলে মনে করছে। অভ্যন্তরীণ হিন্দুবাদী রাজনীতির স্বার্থে অমিত শাহ মুসলিমদের বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী বলেই প্রচার করেন। এবং তাদের দেশ ছাড়া করার হুমকি দেন। এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আখেরে বাংলাদেশের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক গড়ে তুলবে। সেটা ভারতের পক্ষে সুখকর হবে না।

Comments :0

Login to leave a comment