রাজ্য পুলিশের ডিজি’র কাছ থেকে ‘শংসাপত্র’ পেয়ে পঞ্চায়েত ভোটের আগে অস্বাভাবিক দ্রুততায় খুন সহ একাধিক অভিযোগে জেলবন্দি এক কুখ্যাত দুষ্কৃতীকে প্যারোলে মুক্তি দিল কারা প্রশাসন।
মঙ্গলবারই প্যারোলে মুক্তি পেয়ে পাঁশকুড়ার বাড়িতে পৌঁছে গেছেন খুনে অভিযুক্ত দুষ্কৃতী। আগামী ৮ জুলাই পঞ্চায়েত ভোট মিটে যাওয়ার পর তাঁর প্যারোলের মেয়াদ শেষ হবে। বিরোধীদের স্পষ্ট অভিযোগ, তৃণমূলের হয়ে ভোট লুটে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যই ৯ জুলাই পর্যন্ত প্যারোলে ছাড়া হয়েছে আনিসুর রহমানকে।
২৪ ঘণ্টা আগেই রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোটের হিংসা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকাকে বাড়াবাড়ি বলে চিহ্নিত করেছিলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি মনোজ মালব্য। গত মঙ্গলবার ডিজি বলেছিলেন, এরাজ্যে ভোটকে কেন্দ্র করে আদৌ কোনও হিংসার ঘটনা ঘটেনি। কার্যত মমতা ব্যানার্জির মতোই তিনি ছোট ছোট দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটার কথা উল্লেখ করে সংবাদ মাধ্যমকে ঘটনাকে বাড়িয়ে দেখানোর জন্য অভিযুক্ত করেছিলেন। এরাজ্যের প্রশাসন কতটা শাসকদল নির্ভর তা এদিন ফের একবার সামনে চলে অভিযুক্তকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার ঘটনায়। পঞ্চায়েত ভোটে এখনই ১৪ জনের মৃত্যুর পর এলাকার আইনশৃঙ্খলার পক্ষে রীতিমতো বিপজ্জনক অভিযুক্তকে কীভাবে পুলিশ ছাড়ার জন্য কারা দপ্তরে সওয়াল করছে তা দেখে বিস্মিত সরকারি আধিকারিকরাই।
সোমবার মায়ের অসুস্থতার কারণে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি আনিসুর রহমান প্যারোলে মুক্তির আবেদন করেন। সেই আবেদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই রাজ্য পুলিশের শীর্ষকর্তার কাছ থেকে চলে আসে মুক্তি দেওয়ার ছাড়পত্র। তারপরই গত মঙ্গলবার ৫ দিনের জন্য প্যারোলে মুক্ত হয়ে যান কুখ্যাত দুষ্কৃতী আনিসুর রহমান।
কারা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবারই দুপুরে কারা দপ্তরে আকস্মিকভাবেই আনিসুর রহমানকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার জন্য ফাইলপত্র তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। দ্রুততার সঙ্গে প্রেসিডেন্সি জেল সুপার কাছ থেকে চলে আসে ৫দিনের প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার অনুমোদন। সূত্র মারফত জানা গেছে, তার আগে রাজ্য পুলিশ থেকে ছাড়পত্র পৌঁছে যায় কারা দপ্তরে। সাধারণভাবে জেলবন্দি কোনও অভিযুক্তকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার কয়েকটি নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। বিশেষ করে পরিবারের কারোর মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে দ্রুত আপৎকালীন প্যারোল মঞ্জুর করার নিয়ম আছে। কারা দপ্তরের এক শীর্ষ আধিকারিকের বক্তব্য,‘‘ পরিবারের মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে শেষকৃত্যের জন্য ছাড় দেওয়া যায়। কিন্তু অসুস্থ হওয়ার পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্যারোলের আবেদন অনুমোদন করাটা রহস্যজনকই। আবার যিনি ছাড়া পাচ্ছেন তাঁর যদি অতীত ইতিহাসে দুষ্কৃতীমূলক কাজে যুক্ত থাকার ঘটনা থাকে তাহলে পুলিশ রিপোর্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’’ কিন্তু খুন সহ ৩৬টি মামলায় অভিযুক্তকে পঞ্চায়েত ভোটের তিন দিন আগে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার পিছনে ভোট লুট করা ছাড়া আর অন্য কোনও কারণ থাকতে পারে না।
তিন দিন বাদে রাজ্যে একদফায় পঞ্চায়েত ভোট অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। সেই ভোটে সীমাহীন সন্ত্রাসে নির্বাচনকে কীভাবে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে তার নমুনা দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাতেই ছড়িয়ে আছে। জেলার ক্যানিং মহকুমার ক্যানিং ১ নং ব্লকের বুথের সংখ্যা ২৫৬টি। গোটা ক্যানিং ১ নং ব্লকের কোনও বুথেই ৮ জুলাই ভোট হচ্ছে না। ক্যানিং ২ নং ব্লকের ২০৫টি বুথের মধ্যে ১২৩টি বুথ থাকবে ভোটহীন। একই অবস্থা উত্তর দিনাজপুরের চোপড়া ব্লকেও। গোটা রাজ্যে ১০৪৩টি বুথে কোনও ভোট হবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাসের কবলে পড়ে এই এলাকাগুলির বিরোধী প্রার্থীদের সন্ত্রস্ত করে প্রার্থীপদ জমা পর্যন্ত দিতে দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস। আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে, সন্ত্রাস উপেক্ষা করে, প্রতিরোধ গড়ে বিডিও দপ্তরে প্রার্থীপদ জমা দেওয়ার পরও তা বাতিল হয়েছে।
প্রশাসনের সহযোগিতায় ভাঙড়ের ১৯জন সিপিআই(এম) প্রার্থী ও ৮৫ জন আইএসএফ প্রার্থী মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরও তা পোর্টাল থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। হাওড়ার উলুবেড়িয়াতে এক বিডিও’র বিরুদ্ধে সিপিআই(এম)’র প্রার্থীর মনোনয়ন নথি বিকৃত করার মতো অভিযোগ আদালতে বিচারাধীন।
এখন মনোনয়ন পর্ব থেকে প্রত্যাহার পর্ব মিটে যাওয়ার পর আর তিন দিনের ফারাকে ভোটদান। তার আগে রাজ্য পুলিশ যে তৎপরতার সঙ্গে খুনের অভিযোগে ধৃত দুষ্কৃতীকে ভোটের সময় এলাকায় ফেরার ছাড়পত্র দিয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযুক্ত আনিসুর রহমান পাঁশকুড়া এলাকার তৃণমূল কংগ্রেসর প্রথম সারির নেতা ছিলেন। দলের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য কোরবান আলি শা-কে খুনের অভিযোগে ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। গত বিধানসভা নির্বাচনের আগেও এই কুখ্যাত দুষ্কৃতীকে এলাকায় ফেরাতে চেয়ে তার বিরুদ্ধে সব মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল মমতা ব্যানার্জির সরকার। ২০২১ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজ্য বিজ্ঞপ্তি জারি করে তার বিরুদ্ধে সব মামলা তুলে নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পরে হাইকোর্ট সেই নির্দেশ খারিজ করে।
এদিনও আনিসুর রহমানকে অস্বাভাবিক দ্রুততায় প্যারোলে মুক্তি দেওয়া নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে বিচারপতি জয় সেনগুপ্তের এজলাসে মামলা ওঠে। প্যারোলে মুক্ত হওয়ার আবেদন এবং সঙ্গে সঙ্গেই মুক্তি দেওয়ার ঘটনা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিচারপতিও। আদালত সূত্রে জানা গেছে, প্যারোলে মুক্ত অভিযুক্তকে এদিন সন্ধ্যা থেকে দুই সিআইএসএফ জওয়ানের নজরদারিতে থাকতে হবে। তার প্রতিটি মুহূর্তকে ভিডিওগ্রাফি করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। বৃহস্পতিবার মামলার ফের আদালতে উঠবে। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট যাতে না হয় তার জন্য সরকারের টালবাহানা ছিল চোখে পড়ার মতো। সেই রাজ্য সরকারই ভোটের তিন দিন অস্বাভাবিক দ্রুততায় খুনের অভিযোগে ধৃত এক তৃণমূল নেতাকে মুক্তি দিল প্যারোলে।
Parrol bail
ভোটের জন্য পুলিশেরই চেষ্টায় প্যারোলে মুক্ত দাগী আসামি!
×
Comments :0