সুজন চক্রবর্তী
সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে রাজ্যবাসী গভীরভাবেই উদ্বিগ্ন। বিভাজনের রাজনীতি, দুর্নীতি, অনৈতিকতা এসব যেন সমাজজীবনে ক্রমশ গেঁড়ে বসেছে।
রাজ্যের শিক্ষা দুর্নীতি ভয়াবহ মাত্রায়। এটা কেবলমাত্র শিক্ষা এবং শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত মানুষের প্রশ্ন নয়, এর অভিঘাত তার চাইতে অনেক গভীর এবং সুদূরপ্রসারী। রাজ্যের গোটা শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমশই কঙ্কালসার করে ফেলা হচ্ছে। শুধুমাত্র শিক্ষক-কর্মচারীই নন, একটা গোটা প্রজন্মকে বিপন্নতার মধ্যে দাঁড় করানো হয়েছে। বিপদের মধ্যে পড়ছেন অসংখ্য মানুষ। রাজ্যের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি কিংবা শিক্ষা-কাজের বিষয়ে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই সর্বনাশের মুখোমুখি বাংলার মানুষ। প্রতিদিন সর্বনাশ হয়ে চলেছে রাজ্যটার। এর থেকে উদ্ধার পাওয়া এই মুহূর্তে জরুরি। রাজ্যের স্বার্থেই তা জরুরি। অবশ্য নিজেরই তৈরি দুর্নীতির বিষাক্ত মাকড়সার জালে জড়িয়ে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী তা পারবেন কিনা জানি না! কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী পারলে বোঝার চেষ্টা করুন এবং বুঝুন। সংবেদনশীলতা নিয়েই আইনানুগভাবে প্রয়োজনীয় এবং নির্দিষ্ট প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করুন, এটা সামগ্রিক ভাবেই জরুরি।
এ কথা সুবিদিত যে, বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে আমাদের রাজ্যের স্কুল সার্ভিস কমিশন অত্যন্ত মর্যাদা নিয়ে স্বচ্ছতার সাথে মেধা এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রতি বছর পরীক্ষা এবং শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে পেরেছে। গ্রাম-শহরের লেখাপড়া জানা পরীক্ষার্থীরা তাতে যেমন আশ্বস্ত বোধ করেছেন, তেমনই শিক্ষার ক্ষেত্রে রাজ্যের অগ্রগতিকেও সুনিশ্চিত করতে পেরেছেন তাঁরাই। তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা ব্যানার্জিও এসব বিষয়ে কখনোই প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, মিছিল এসবের সুযোগ পাননি। রাজ্যের মর্যাদার বিস্তার ঘটিয়েই পথ চলেছে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। পরিবর্তনের পর সবই কি উবে গেল? কাজ, চাকরি, নিয়োগ সবই কি জলাঞ্জলি দেওয়া হলো? স্বচ্ছতার পরিবর্তে রাজ্যজোড়া দুর্নীতির রাজত্ব। শিক্ষা এবং অন্যান্য সরকারি ক্ষেত্র, সব মিলিয়ে রাজ্যে শূন্যপদের সংখ্যা দশ লক্ষের বেশি। নিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। যদিও বা হয়, তাও দুর্নীতিতে ভরা। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, উচ্চশিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রেই শিক্ষক নিয়োগের প্রশ্নে কয়েক বছর ধরেই ভয়াবহ দুর্নীতির চেহারা ধরা পড়ছে, যাতে সমানতালে জড়িয়ে পড়ছেন নেতা-মন্ত্রী সহ অফিসাররাও। এদের সবার মাথায় সংগঠিত দুর্নীতি এবং অপরাধের একটা চক্র। এসব মুখ্যমন্ত্রী অস্বীকার করতে পারবেন নাকি! এর অবসান হওয়াটা জরুরি।
আপনার সরকারের ১৪ বছরের সময়কালে প্রতি বছর দূরে থাক, শিক্ষক নিয়োগ প্রায় হয়নি বললেই চলে। ২০১৬ সালে যখন সরকার টেট এবং এসএসসিতে নিয়োগের ঘোষণা করল, তখন থেকেই চাকরি প্রার্থীরা একের পর এক অসঙ্গতি এবং দুর্নীতির নানা তথ্য সামনে নিয়ে এসেছেন। মেধা এবং যোগ্যতার পরিবর্তে দুর্নীতিকেই সরকার গুরুত্ব দিয়েছে। সাদা খাতা, টাকার খেলা, খুশিমত পাশ-ফেল করানো, নেতা মন্ত্রীদের কারচুপির বহুবিধ অভিযোগ এসেছে। এই পরীক্ষায় কুড়ি-বাইশ লাখ প্রার্থী। তাদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যারা বেশি স্কোর থাকা সত্ত্বেও ডাক পাননি, অথচ সাদা খাতা জমা দিয়ে টাকার বিনিময়ে চাকরি করছেন দুর্নীতিগ্রস্তরা— এমন বিস্তর অভিযোগ। চরম অন্যায় এবং দুর্নীতিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে তালিকায়। বেশি নম্বরের অনেক প্রার্থীই ডাক পাননি। তাদের অপমান এবং চোখের জলের হিসাবকে রাখে? দুর্নীতি করে যারা চাকরি পেয়েছে, যারা অযোগ্য অথবা সুপ্রিম কোর্টের ভাষায় যারা চিহ্নিত ‘Tainted’ বিশেষণে, তাদের পরিবর্তে তো এদের অনেকেরই তালিকায় যথার্থভাবে জায়গা পাবার কথা ছিল। এরা বহুবার কাতরভাবে এদের সাথে ঘটে চলা অন্যায়ের কথা বলেই চলেছেন। সরকার, এসএসসি, নেতা, মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীরা এদের কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাড়িয়ে দিয়েছেন, পুলিশ লেলিয়ে আক্রমণ করিয়েছেন, লক-আপে ঢুকিয়েছেন। নির্মমতা করেছেন। মেধা ভিত্তিক স্বচ্ছ নিয়োগ ব্যবস্থাকে বানচাল করতে সংগঠিতভাবেই দুর্নীতির পথ বেছে নিয়েছে প্রশাসন, একথা সর্বজনবিদিত। দুর্নীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্তদের পাশে দাঁড়িয়ে শিক্ষা এবং মেধা ভিত্তিক শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকার যে ছিনিমিনি খেলেছে, এটা আজ স্পষ্টভাবে আইনের কাছে এবং জনসমক্ষে ধরা পড়ে গেছে।
২০১৬ সালে নিয়োগের এই প্রক্রিয়া যখন শুরু হয় তখনই পরীক্ষার্থীরা দুর্নীতির তথ্য সামনে নিয়ে আসেন। নিয়োগের বিস্তৃত তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার দাবি জানান। সরকার তখন থেকেই তথ্য গোপন, বিকৃতি এবং নষ্ট করার বেআইনি কাজ চালু করে দেয়। বিধানসভার বাইরে যেমন, ভিতরেও তেমনই বাম-কংগ্রেস বিধায়করা স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে সরব হয়। সরকারকে জানানো হয় যে টেট, এসএসসি'র এই নিয়োগে ব্যাপক দুর্নীতি হচ্ছে। তথ্য প্রমাণ দেওয়া হয়। চালের সাথে যেমন কাঁকর, তেমনই স্বচ্ছ যোগ্যদের সাথে দুর্নীতির সাথে প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ‘Tainted’ এবং অযোগ্যদের মিশিয়ে দেবার মতো করেই সংগঠিত প্রশাসনিক দুর্নীতি করা হয়েছে। বিধানসভার অভ্যন্তরে অন্তত ১২ বার এই বিষয়টি উত্থাপন করা হয়, মুলতবি প্রস্তাবও আনেন বিরোধীরা। কখনই সে বিষয়ে আলোচনারও সুযোগ দেওয়া হয়নি। বিধানসভায় এই বিষয়ে আলোচনার দাবি করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও বারেবারে আবেদন করা হয়েছে। দফায় দফায় সরকারকে চিঠি দিয়ে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। কিন্তু রাজ্য সরকার সবটাই সচেতনভাবে এড়িয়ে গেছে। দুর্নীতির পাশে থেকেছে। বাধ্য হয়ে প্রতিবাদে বিধানসভা থেকে একাধিকবার ওয়াক-আউট করতে বাধ্য হয় বাম-কংগ্রেস বিধায়করা। তখন সরকারকে আড়াল করতে আপনার হয়ে বিধানসভায় সবচেয়ে বেশি গলা চড়িয়েছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। এখন অবশ্য আপনি বলছেন তৎকালীন আপনার মন্ত্রীসভার সদস্য, বর্তমান বিজেপি’র এই নেতাটি সবচেয়ে বেশি চাকরি চুরি করেছে। কিন্তু কখনো কোনোদিন কোনও ব্যবস্থা নেননি। সময় সারণি ঘাঁটতে গেলে দেখা যাচ্ছে, সেই সময়ে আরও বেশ কয়েকজন সমানতালেই গলা চড়াতেন। তারা যে প্রত্যক্ষ ভাবে এসব দুর্নীতির সরাসরি অংশীদার, তা আপনার চাইতে বেশি কে জানে! তখন আপনারই বিশ্বস্ত সঙ্গী পার্থ চ্যাটার্জি শিক্ষা মন্ত্রী। আপাতত তাঁর ঠিকানা জেলের কুঠুরি। যাঁর বান্ধবীর দু’টি ফ্ল্যাট থেকেই উদ্ধার হয়েছে টাকার পাহাড়। মানুষের স্মৃতিতেও সেই সব ছবি টাটকা।
স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ দুর্নীতিতে রাজ্য সরকারকে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট যথেষ্ট সময় এবং সুযোগ দেওয়া সত্ত্বেও রাজ্যের তরফ থেকে যথাযথ এবং যুক্তিসঙ্গত পদক্ষেপ কখনো নেওয়া হয়নি। বরং লেখাপড়া জানা যোগ্য ছেলেমেয়েদের কলুষিত করতে তাদের সঙ্গে চাকরি চুরি করা অযোগ্য এবং ‘Tainted’ দের জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে তাঁদের নাম। আপনার সরকার এবং আপনি, চাল-কাঁকড় আলাদা করতে চাননি। আলাদা করেননি বলেই তাঁদেরও সামগ্রিকভাবে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। বেশ কয়েক বছর চাকরি করার পর আপনার অপরাধে চাকরিচ্যুত হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে অজস্র যোগ্য এবং মেধাসম্পন্ন শিক্ষককে। এটা কখনো মেনে নেওয়া যায় না।
মানুষের দাবি অত্যন্ত স্পষ্ট।
১) স্বচ্ছ এবং যোগ্য শিক্ষকদের কাজে বহাল রাখতে হবে। স্বচ্ছ-যোগ্য এবং দুর্নীতিযুক্ত-অযোগ্য ফারাক নির্দিষ্ট করতে হবে। এদের তালিকা সরকারকে জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। অযোগ্যদের রক্ষা করতে গিয়ে সরকার যোগ্য শিক্ষকদেরকে বলি করছেন, এটা চলতে পারে না।
২) সমগ্র পরীক্ষার্থীদের OMR sheet প্রকাশ করার যে দাবি উঠেছে তা যথার্থ। সরকার ব্যবস্থা নিক। তা না পাওয়া গেলে তার জন্য দায়ী কে বা কারা, তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি বিধান করা হোক। সেক্ষেত্রে OMR এর scan copy, mirror image জনসমক্ষে অবিলম্বে প্রকাশ করতে হবে।
৩) নিয়োগ দুর্নীতিতে নিজেদের অপরাধ স্পষ্ট করে সরকারকে স্বীকার করতে হবে। শিক্ষা দুর্নীতি, নিয়োগ দুর্নীতি, চাকরি চুরি এই প্রসঙ্গে যে বা যারা যুক্ত আছে তাদের প্রত্যেককে তিন মাসের মধ্যে শাস্তি দেওয়া হবে— এই মর্মে সরকার হলফনামা দিয়ে জানাক।
৪) কোর্টের নির্দেশে Tainted বা অযোগ্যদের প্রাপ্ত টাকা ফেরত দিতে হবে। এদের পাশে দাঁড়ানোর অছিলায় যোগ্যদের বিড়ম্বনায় ফেলা যাবে না।
৫) এই আট-দশ হাজার Tainted বা অযোগ্য, যারা নথিপত্রে ইতিমধ্যেই ধরা পড়ে গেছে তাদের বাদ দিলে বাকি যারা থাকে, ধরে নিতে হবে এরকম ষোলো-আঠারো হাজার শিক্ষক তারা Tainted নন, তারা যোগ্য। এই মর্মে সরকার কোর্টে হলফনামা দিয়ে ঘোষণা করুক। এদের চাকরি যাতে বহাল থাকে, তার জন্য সরকার নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে, আইনানুগভাবে রিভিউ পিটিশন বা কিউরেটিভ পিটিশন দাখিল করে আবেদন করুক।
৬) হলফনামায় সরকার জানিয়ে দিক যে, এঁদের মধ্যে কেউ Tainted থাকলে বা দুর্নীতিযুক্ত ধরা পড়লে, সে দায়িত্ব সরকার নেবে। তাঁর চাকরি খারিজ এবং যে আধিকারিক অথবা মন্ত্রীর অপরাধের জন্য এই ঘটনা তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নেবে— তা জানাক।
এই মর্মে ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার দ্রুত উদ্যোগ নিক, যাতে আমাদের মেধাসম্পন্ন যোগ্য শিক্ষকদের সরকারের অপরাধের বলি হতে না হয়।
রাজ্যবাসী চায়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজের দলীয় স্বার্থের উপরে উঠে বিষয়টি খতিয়ে দেখুন। যা কিছু অনিয়ম এবং দুর্নীতিতন্ত্র চালু করা হয়েছে তা মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতিতেই হয়েছে। তাই মুখ্যমন্ত্রীকেই আজ দায়িত্ব নিয়ে, হলফনামা দিয়ে, মেধাসম্পন্ন যে যোগ্য শিক্ষক যারা আপনার অপরাধে বিপন্ন হচ্ছেন, তাদের হকের চাকরি ফিরিয়ে দেবার সঠিক ব্যবস্থা করে দিতে হবে।।
SSC SCAM
মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণাতেই দুর্নীতি যোগ্যদের চাকরি ফেরাবার দায়িত্ব তাঁরই

×
Comments :0