Cooch Behar Rape

কোচবিহারে নির্যাতিতা ছাত্রীর মৃত্যু

রাজ্য

Cooch Behar Rape

 


জয়ন্ত সাহা ও অমিতকুমার দেব: কোচবিহার

৯দিনের লড়াই শেষ। বুধবার সকাল ৯ টায় চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে মারা গেল কোচবিহারে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নবম শ্রেণির সেই ছাত্রী। কিশোরীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই তাঁর গ্রামে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে এসেছেন শয়ে শয়ে মহিলা, কিশোর, কিশোরী। শুরু হয় পথ অবরোধ। রাজেন তেপথী থেকে নাটাবাড়ি যাবার রাস্তা এবং ধলপলের রাস্তা বন্ধ করে দেয় উত্তেজিত গ্রামবাসীরা। গোটা গ্রামেই এদিন ছিল অরন্ধন।
এদিকে, এই ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে জেলাজুড়ে বৃহস্পতিবার ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এসএফআই কোচবিহার জেলা কমিটি। অন্যদিকে, শোকের আবহের মধ্যেই ছাত্রীর মরদেহ নিয়ে এদিন রাজ্য ও কেন্দ্রের দুই শাসক দলের রেষারেষির নিষ্কৃষ্ট ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন কোচবিহারের মানুষ। এই চরম শোকের মুহূর্তে এই আচরণে দুই দলের প্রতিই ঘৃণায় মুখ ফেরাচ্ছেন জেলার মানুষ। 

ছাত্রীকে শেষবারের মতো দেখতে কোচবিহার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে হাজির হয়েছিল ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগীরা। সেখানে তৃণমূলের জেলা সভাপতি ও বিজেপি জেলা সভাপতি তাঁদের অনুগামীদের নিয়ে উপস্থিত হন। প্রথমে মনে করা হয়েছিল দু’দলের নেতারা তাঁদের অনুগামীদের নিয়ে বুঝি মৃতা কিশোরীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন। কিশোরীর মৃতদেহ হাসপাতাল থেকে বের করে মর্গে নিয়ে যাবার সময় মৃতদেহ ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল। অন্যদিকে, কিশোরীর বাবা তখন বিজেপি’র ঘেরাটোপে রয়েছেন। তিনি বুঝতেই পারলেন না তাঁর মেয়ের দেহ তাঁর কাছে না এসে চলে গেছে তৃণমূলের নেতাদের কবজায়। এরপরেই বাবাকে নিয়ে শুরু হয় বিজেপি ও তৃণমূলের প্রকাশ্য রাস্তায় টানাহেঁচড়া। হতবাক বাবার দু’হাত ধরে টানাটানি চলছে দু’দলের নেতাদের। একসময়ে কিশোরীর বাবাকেও ছিনতাই করে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় তৃণমূল। বিজেপি তখন রাস্তা অবরোধ করে বসে পড়েছে। 
আর যে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক, শিক্ষানুরাগীরা এসেছিলেন শেষ শ্রদ্ধা জানাতে, তাঁরা শোক জানাতে এসে দুই শাসক দলের এই আচরণে তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়ে ফিরে গেলেন।

কোচবিহার শহরে যখন মৃতদেহ ও মৃতার বাবাকে নিয়ে বিজেপি ও তৃণমূলের নোংরা রাজনীতিতে জেলার সর্বত্র নিন্দার ঝড় উঠেছে, তখন কিশোরীর গ্রামে অন্য ছবি। গ্রামের মানুষ সবাই এককাট্টা। দলমত নির্বিশেষে একটাই দাবি, দোষীদের আড়াল করা চলবে না। সেই সঙ্গে মূল অভিযুক্ত বাপ্পা বর্মণের মা’কেও গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি তুলেছেন গ্রামবাসীরা। অভিযোগ, মূল অভিযুক্তের মা, মিথ্যে পরিচয় দিয়ে বেসরকারি নার্সিংহোমে কিশোরীকে ভর্তি করে। নিজেকে মেয়েটির মা বলে ওই নার্সিংহোমে পরিচয় দিয়েছিল অভিযুক্তের মা।
এদিকে, ধৃত দুই ধর্ষক বাপ্পা বর্মণ ও সুশান্ত দাসের বাড়ি পাহারার জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে। সকাল থেকে বেশ কয়েকবার পুলিশ কিশোরীর বাড়ির এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করলে মারমুখী মহিলাদের তাড়া খেয়ে তাদের পিছু হটতে হয়। পরে বেলা ১টা নাগাদ গ্রামবাসীরা ধর্ষকদের বাড়ি চড়াও হয়। বাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছুঁড়তে থাকেন গ্রামবাসীরা। পুলিশ গ্রামে আসার আগেই ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা তিন অভিযুক্তের বাড়ি ভাঙচুর করে। গ্রামবাসীরা দাবি তোলেন, মূল অভিযুক্তের বাড়িতেই শ্মশান বানিয়ে শেষকৃত্য করতে হবে কিশোরীর। ঘটনার খবর পেয়ে সেখানে গেলে কোচবিহারের ডিএসপি (সদর) চন্দন দাস বিক্ষোভের মুখে পড়েন। উল্লেখ্য, এই ডিএসপি (সদর) চন্দন দাসই গত মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠক করে দাবি করেছিলেন, মূল অভিযুক্তকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, সে নিজেই কিশোরীর ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়েছিল। পুলিশ আধিকারিকের দাবি ছিল, এখনও দলবদ্ধ ধর্ষণের কোনও প্রমাণ মেলেনি। মঙ্গলবার পুলিশের এই বিবৃতিতেই গ্রামে ক্ষোভের আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল। কিশোরীর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই গ্রামবাসীদের বদ্ধমূল ধারণা, পুলিশ দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইছে। গ্রামবাসীরা পুলিশকর্তাদের সামনে ‘পুলিশমন্ত্রী হায়! হায়!’ স্লোগান দিতে থাকেন। মহিলাদের বিক্ষোভ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর নামেও ধিক্কার স্লোগান ওঠে। গ্রামে বিরাট পুলিশবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীও।

মৃত কিশোরীর স্কুলের বন্ধুদের বক্তব্য, যে ৫জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি, সেই ৫জনের একজনকেও পুলিশ নিজে থেকে গ্রেপ্তার করেনি। গ্রামের মানুষই মূল আসামী বাপ্পা বর্মণ ও তার দুষ্কর্মের সহযোগী সত্য সরকার, মৃণাল সরকার, সুমন সরকার ও সুশান্ত সরকারকে ধরে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। গ্রামবাসীদের দাবি, পুলিশ সরকারের ভাবমূর্তি মেরামত করতেই দলবদ্ধ ধর্ষণকে আড়াল করে যৌন নির্যাতন বলে চালাতে চাইছে।
গ্রামবাসীদের অভিযোগ, গত ১৮জুলাই অপহরণের পর টানা দুদিন ওই কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর সে সংজ্ঞাহীন হয়ে কোমায় চলে যায়। পরিবারের দাবি, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন দলবদ্ধ ধর্ষণ হয়েছিল। পুলিশ মিথ্যে বলছে। সাংবাদিকদের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুষ নিয়ে মামলা লঘু করার অভিযোগ তোলেন গ্রামবাসীরা।
হাসপাতাল থেকে কিশোরীর মৃতদেহ ও তাঁর বাবাকে নিয়ে তৃণমূল ও বিজেপি’র লজ্জাজনক টানাহেঁচড়া শহরবাসী প্রত্যক্ষ করলেও কিশোরীর গ্রামের সম্মিলিত ক্ষোভের সামনে এদিন দুপুর থেকে সন্ধ্যে অবধি দুই শাসক দলের কোনও নেতাকেই চোখে পড়েনি।

সিপিআই(এম) কোচবিহার জেলা সম্পাদক অনন্ত রায় এদিন বিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, এক ধর্ষিতা কিশোরীর মৃতদেহের দখল ও তাঁর বাবাকে নিজেদের হেপাজতে নেবার জন্য তৃণমূল ও বিজেপি’র জেলা সভাপতিরা প্রকাশ্য দিবালোকে যেভাবে টানাহেঁচড়া করলেন, সেটা বাংলার সংস্কৃতি নয়। আমরা চাই, পুলিশ যেন দলবদ্ধ ধর্ষণকে শ্লীলতাহানি বলে চালানোর চেষ্টা না করে। কিশোরীর পরিবার পুলিশের ওপর ভরসা রেখেছে, পুলিশ দলদাস না হয়ে তার মর্যাদা রক্ষা করুক।
এদিকে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা অবধি পথ অবরোধের পর গ্রামবাসীরা অবরোধ তুলে নিয়ে কিশোরীর মৃতদেহ তাঁর বাড়িতে নিয়ে যেতে পুলিশকে রাস্তা করে দেয়। এদিন রাতেই কিশোরীর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। গ্রামে উত্তেজনা প্রশমিত না হওয়ায় পুলিশ পিকেট ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল চলছে।


 

Comments :0

Login to leave a comment