ঈশিতা মুখার্জী
চলে গেলেন গরিব মানুষের রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমিয় বাগচী। ১৯৩৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের এক গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর জন্মস্থানের উল্লেখ এই জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে অধ্যাপক বাগচী আন্তর্জাতিক স্তরের অর্থনীতিবিদ হয়েও নিজেকে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেন। তিনি তো ম্যাট্রিক পাশের পরেই চলে এসেছিলেন কলকাতার প্রেসেডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়তে। কিন্তু কোনোদিন তিনি তাঁর জেলা, তাঁর গ্রামকে ভোলেননি। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শেষ করার পর কিছুদিন সেখানে অধ্যাপনা করে স্বেচ্ছায় চলে আসেন ভারতে এবং পড়াতে শুরু করেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। কিছুদিন পর কলকাতার সমাজবিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সাইন্সেসে তিনি যুক্ত হন। এইখানে থেকেই তিনি রচনা করেন ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের ইতিহাস। তাঁর সবকটি গবেষণাই গরিব দেশের গরিব মানুষের জীবনকে ঘিরে এবং এই দারিদ্রের কারণ, তার প্রকৃতিকে ঘিরে। শুধুমাত্র ভারত নয়, তাঁর চিন্তা ঘিরে ছিল বিশ্বের গরিব দেশগুলি এবং সেই সব দেশের মানুষের জীবনযাত্রা। বর্তমান যুগে দক্ষিণ এশিয়াতে এইভাবে সারা জীবন শুধুমাত্র গরিব দেশগুলি নিয়ে, এই সব দেশে সাম্রাজ্যবাদের থাবা নিয়ে গবেষণা করে এবং গরিব মানুষের পক্ষে জোরের সাথে বলার মতো তিনিই ছিলেন শেষ প্রজন্ম। তাঁর চলে যাওয়া সেই অর্থে যুগের অবসান।
অধ্যাপক বাগচীর জীবনাবসান দক্ষিণ এশিয়াতে চিন্তার জগতে মার্কসবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে গরিব মানুষের শোষণকে ব্যাখ্যার এক লাল দূর্গ ভেঙ্গে পড়ার শামিল। অধ্যাপক বাগচী ভারতে এবং বিশেষ করে কলকাতায় বসে গবেষণা করবেন বলে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে পদত্যাগ করে কলকাতা চলে আসেন। তিনি নয়া ধ্রুপদী অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা শুরু করলেও চলে গিয়েছিলেন গরিব দেশের ইতিহাস ঘাঁটতে এবং এই দেশগুলির অর্থনৈতিক ইতিহাস নিয়ে চর্চা করতে। তিনি উপনিবেশের এই অর্থনৈতিক ইতিহাস চর্চায় মন না দিলে আমাদের কাছে আমাদের দেশের মতো অনেক গরিব দেশের ইতিহাস অজানা রয়ে যেত। দক্ষিণ এশিয়ার তিনিই বোধহয় সর্বশেষ অর্থনৈতিক ইতিহাসের বিজ্ঞজন ছিলেন। তিনি কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন অধ্যাপক গুডউইনের কাছে গবেষণা করেন এবং ১৯৭২ সালে কেম্ব্রিজ থেকে তাঁর পিএইচডি থিসিস বই হয়ে প্রকাশিত হয় “প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট ইন ইন্ডিয়া ১৯০০-১৯৩৯” (ভারতের বেসরকারি বিনিয়োগ)। উপনিবেশ থাকাকালীন ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এই লুটের ইতিহাস জানতে গেলে এখনও পর্যন্ত এই বইটি ছাড়া আর বিশেষ কোনও প্রামাণ্য বই নেই। সেই থেকে গরিব দেশের মানুষ নিয়ে অধ্যাপক বাগচীর যাত্রা শুরু। ১৯৭২ সালে ইকনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলিতে তাঁর বিখ্যাত রচনা প্রকাশিত হয় “সাম ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেসন অব ক্যাপিটালিস্ট গ্রোথ এন্ড আন্ডারডেভেলপমেন্ট” (পুঁজিবাদের বৃদ্ধি এবং অ-উন্নয়নের কিছু আন্তর্জাতিক ভিত্তি)। এই লেখায় গরিব দেশের গরিবিয়ানা যে পুঁজিবাদের উন্নতির কারণ এবং এই প্রক্রিয়া যে সাম্রাজ্যবাদের মূল কৌশল, তিনি স্পষ্ট করে বলেন। এই রচনা আন্তর্জাতিক ভাবে মিশে যায় ভারতের দাদাভাই নওরজি এবং অন্যদের ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের লুট সম্পর্কে লেখা এবং বক্তব্যের সাথে। সাম্রাজ্যবাদের এই লুট বুঝতে গেলে মার্কসবাদের সাহায্যেই তা বোঝা সম্ভব, তিনি আমাদের সেই স্পষ্ট ধারনা দিয়েছিলেন। বিভিন্ন দেশের এই লুট এবং এই কারণেই গরিব দেশের গরিব মানুষের কষ্ট - এই কথা তিনি দেশের ইতিহাস থেকে তথ্য তুলে এনে বুঝিয়ে দিলেন।
অধ্যাপক বাগচী তাঁর চিন্তায় ঘনিষ্ঠ ছিলেন তাঁর সমসাময়িক মার্কসবাদী তাত্ত্বিক সামির আমিনের সাথে। তিনি তাঁকে কলকাতায় আমন্ত্রণ করেছিলেন বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এরকম ভাবেই তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল প্রগতিশীল অর্থনীতিবিদ নির্মল চন্দ্রের সাথে। পশ্চিমবঙ্গের বাম চিন্তাধারা এইভাবে অধ্যাপক বাগচীর হাত ধরে বিশ্বের বাম চিন্তা মননের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল। ১৯৮২ সালে কেম্ব্রিজ প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত হয় “পলিটিকাল ইকনমি অব আন্ডারডেভেলপমেন্ট” (অব উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি)। তিনি এই বইতে বিশ্বের গরিব দেশগুলিতে সাম্রাজ্যবাদী লুট কিভাবে মানুষের জীবন যন্ত্রণা বৃদ্ধি করেছে, তাঁর বিশ্লেষণ করলেন। গরিব দেশের গরিব মানুষের অর্থনীতি বুঝতে গেলে আজ এত বছর পরেও এই বইটি অবশ্যপাঠ্য। এইভাবে তাঁর সর্বশেষ দলিল “পেরিলাস প্যাসেজ”(ভয়াবহ যাত্রা) প্রকাশিত হয় গরিব দেশে সাম্রাজ্যবাদী লুট নিয়ে।
অধ্যাপক বাগচীর মানুষের জন্য লড়াইয়ের অস্ত্র ছিল তাঁর গবেষণা এবং কলকাতা সহ সারা পৃথিবীতে বহু ছাত্র-ছাত্রীকে এই লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ করা। বেশ কয়েক বছর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আংশিক সময়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। তিনি চীনের অর্থনীতি, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার অর্থনীতি সহ উন্নতশীল দেশগুলি সম্পর্কে পরিচয় করিয়ে দিতেন শ্রেণিকক্ষে। অর্থনীতি বুঝতে গেলে যে দেশ, সমাজ, রাজনীতি, নৃতত্ব সব কিছুই বুঝতে হবে সেকথা তিনি ছাত্র-ছাত্রীদের বারবার মনে করাতেন। পিছিয়ে পড়া দেশ কি দেখে বোঝা যায়? এই প্রশ্ন তাঁর কাছে বার বার আমরা শুনেছি। বারবার শুনেছি তিনি বলেছেন, যে দেশে মহিলারা পিছিয়ে থাকে, যে দেশে পিতৃতন্ত্র চেপে বসে, যে দেশে বিজ্ঞানের প্রয়োগ হয় না, যে দেশে শিশুরা অপুষ্টিতে ভোগে, সেই সব দেশে আসলে সাম্রাজ্যবাদের থাবা বসে আছে প্রজন্মের পর প্রজন্মে। তিনি খুবই জোরের সাথে এই কথা তাঁর বিভিন্ন বই ও লেখায় বলে গেছেন।
অধ্যাপক বাগচী খুব মনোযোগ সহকারে বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের তথ্য নিতেন, আন্দোলনকারীদের সঙ্গে মিশে যেতেন এবং তাঁদের সাথে আলোচনা করতেন। আন্দোলনের সঙ্গে এইভাবে নিজেকে সবসময়ে তিনি যুক্ত করে রেখেছিলেন। বামপন্থী মার্কসবাদী আন্দোলনকারীদের আহ্বানে তিনি সবসময়ে সাড়া দিয়েছেন, বক্তব্য রেখেছেন, আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। যদি কোনও সময়ে কোনও প্রসঙ্গে কেউ বামপন্থার বিরুদ্ধে, গরিব মানুষের শোষণের পক্ষে কোনও বক্তব্য রাখতেন, অধ্যাপক বাগচী স্থান কাল পাত্র নির্বিশেষে ক্ষোভে ফেটে পড়তেন। বামবিরোধী যে কোনও শক্তির বিরুদ্ধে তাঁকে রাগে ফেটে পড়তে আমরা অনেকবার দেখেছি। আলোচনাসভায়, ইকনমিক পলিটিকাল উইকলির লেখায়, সোশাল সাইন্টিস্টের লেখায় বামপন্থা, মার্কসবাদের প্রতি তাঁর মননের প্রতিফলন আমরা দেখেছি।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে রাজ্যে ছিল সক্রিয় পরিকল্পনা দপ্তর। তিনি স্বাভাবিকভাবেই তাঁর অংশ ছিলেন এবং রাজ্য পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কিভাবে রাজ্য অর্থনীতি মজবুত হবে, সেই চিন্তায় তিনি শামিল হয়েছিলেন। সেই চিন্তায় যুক্ত করে নিয়েছিলেন অনেক গবেষককে। ১৯৯৮ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে ইকনমিক এন্ড পলিটিকাল উইকলির পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক এক সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন। দেশের কাছে পশ্চিমবঙ্গে সেই সময়ে যে বিকল্প উন্নয়ন ভাবনার উন্মেষ হয়েছিল, ঐ সংখ্যার বহু রচনায় সেই তথ্য আছে।
দেশে মোদী সরকার যখন অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করছিল না, দেশের রাশিবিজ্ঞানের প্রশাসনিক প্রধান ক্ষোভে পদত্যাগ করেন, অধ্যাপক বাগচী সহ অনেকে বিবৃতি প্রকাশ করেন, কিভাবে আসলে এই পরিসংখ্যান প্রকাশ না করা একটি চক্রান্ত এবং অবিলম্বে পরিসংখ্যান প্রকাশ করার দাবি জানান। এইভাবেই অযোধ্যার রায়ের পর তিনি কলম ধরেছিলেন। প্রতিবাদে, প্রতিরোধে সবসময়ে তিনি কলম ধরেছেন। আন্তর্জাতিক স্তরের সমাজবিজ্ঞানী ছিলেন তিনি, বিশ্বের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ছিল অবাধ যাতায়াত। বিশ্বের বহু বামপন্থী প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদ, সমাজতাত্ব্বিক ছিলেন তাঁর সহযোগী; কিন্তু তিনি বাংলাতেও লিখেছেন নানা পত্রিকায়, বক্তৃতা দিয়েছেন নানা সভায়। কিন্তু সর্বত্রই তাঁর বিষয়বস্তু ছিল গরিব দেশকে কিভাবে সাম্রাজ্যবাদী শোষণের সম্মুখীন হতে হয় এবং সেই সব দেশ কিভাবে তা প্রতিরোধ করে থাকে। তাঁর সাথে বহু গবেষক একান্ত আলোচনা করেছেন, বহু ছাত্র-ছাত্রী, আন্দোলন সংগ্রামের মানুষজনও তাঁর সাথে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। তাঁর সাথে ব্যক্তিগত এই সব আলোচনায় সম্বৃদ্ধ হয়েছে বাম আন্দোলন বারে বারে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন দিন বদলের আর সেই স্বপ্ন দেখিয়ে গেলেন অনেক অনেক মানুষকে।
দিন বদলের লড়াইয়ের অংশ হিসেবে, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ইতিহাসকে এক ছাদের তলায় এনে গরিব দেশের অর্থনীতি বুঝবার জন্য প্রয়োজন ছিল প্রতিষ্ঠানের। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সহায়তায় অধ্যাপক বাগচী তৈরি করেন সেই প্রতিষ্ঠান, ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা। প্রাথমিক স্তরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত হয়ে পরে তার নিজস্ব ভবন তৈরি হয়। বারে বারেই তিনি এই ধরণের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। বিশ্বের দরবারে থেকেও তিনি কলকাতাকেই তাঁর গবেষণার স্থান হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। তিনি কোনোদিন পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যেতে চাননি। বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি মাঝেই মাঝেই গেলেও ফিরে আসতেন কলকাতার মাটিতে। গরিব মানুষের প্রতিদিনের রুটিরুজির লড়াইয়ের ধারা যে সব গরিব দেশে একই রকম, এক ধরণের পন্থায় শ্রমকে শোষণ করছে পুঁজি, কিন্তু এই শোষণ মুক্তির সংগ্রামের বার্তা যে বিশ্বের বহু দেশ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, অতীতেও পাওয়া গেছে; তিনি আমাদের স্মরণ করিয়েছেন তাঁর বহু রচনা এবং বইতে। গরিব মানুষের রুটিরুজি জীবন জীবিকা ভালোভাবে বেঁচে থাকা লুট হয়ে যাচ্ছে, এই সত্যকে অধ্যাপক বাগচী কোনোদিন বরদাস্ত করেননি।
বেঁচে থাকার শেষদিন পর্যন্ত তিনি আমাদের এই সব কথা মনে করিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রানুরাগী। তাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেন্টার অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ। সাহিত্য, সমাজনীতি, ইতিহাসের নিরিখে অর্থনীতির বিশ্লেষণ করতে হবে, তবেই মানুষের জীবনের কথা জানা যাবে, বোঝা যাবে তাঁর জীবন সংগ্রামের কথা। এই কথা আমাদের কাছে বলার মানুষকে আমরা হারালাম। দক্ষিণ এশিয়া হারালো এক মার্কসবাদী তাত্ত্বিককে, উন্নতশীল দেশগুলি হারালো তাদের দরদি অর্থনীতিবিদকে।
Comments :0