ভারতের বুকে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা আরএসএস তথা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকের শতবর্ষ ভারতের ৭৯তম স্বাধীনতা দিবসের সঙ্গে একযোগে উদ্যাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এরজন্য তিনি স্বতন্ত্র কোনও মঞ্চ ব্যবহার করেননি, ঐতিহাসিক লালকেল্লায় দেশের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের যে বিশাল সরকারি আয়োজন সেই মঞ্চকেই ব্যবহার করেছেন আরএসএস-কে গৌরবান্বিত করার ও মাহাত্ম্য প্রচারের কাজে। একদা স্বয়ং সেবক এবং সঙ্ঘ প্রচারক মোদী একটি স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আসনে বসেও অগণতান্ত্রিক আধিপত্যবাদী মুসলিম বিদ্বেষী এবং সর্বোপরি হিন্দুত্ববাদী পশ্চাৎপদ চিন্তার উত্তরাধিকারের শৃঙ্খল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি। আত্মস্থ করতে পারেননি সংবিধানের অন্তরাত্মার সুরটিকে। শেষ পর্যন্ত থেকে গেলেন হিন্দুত্ববাদী ধর্মান্ধতার রাজনৈতিক প্রকল্পের কুয়োতেই। বিশ্বমানবতার উদার প্রাণের হাতছানিতে তিনি সাড়া দিতে পারেননি। তাঁর দৌড় যে হিন্দুত্বের ঘুলঘুলিতে আটকে গেছে।
২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার পর স্বাধীনতা দিবসে ১২টি ভাষণ তিনি দিয়েছেন। এই প্রথম এমন ভাষণে তিনি আরএসএস’র প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মুখে কোনও লাগাম না দিয়ে অনর্গল মিথ্যার বেসাতি করে দেশ ও রাষ্ট্র গঠনে আরএসএস’র অবদান স্মরণ করেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম অসরকারি সমাজ সেবার সংগঠন বলেন। অর্থাৎ স্বাধীনতা দিবসের মহাসমারোহের মধ্যে ভারত রাষ্ট্রের সঙ্গে আরএসএস-কে বিশ্রীভাবে জড়িয়ে দিয়েছেন। আর একাজ করতে গিয়ে তিনি ইতিহাসের গুষ্টির তুষ্টি করেছেন। অপমান ও অসম্মান করেছেন ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানকে। স্বাধীনতার সংগ্রামের গৌরবগাথা এবং মহামানবিক ঐক্যের চেতনা কুৎসিতভাবে অস্বীকার করেছেন।
১৯২৫ সালে তৈরি হওয়া আরএসএস ব্রিটিশ বিরোধী উত্তাল স্বাধীনতা সংগ্রামের শরিক ছিল না। সকল ধর্ম-বর্ণ-জাত-গোষ্ঠীর ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ধারা মিলিত হয়েছিল স্বাধীনতার মহাবিদ্রোহ। এই লড়াই থেকে নিজেদের দূরে রেখে সচেতনভাবে ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়েছিল হিন্দু রাষ্ট্রের প্রবক্তারা। আরএসএস নেতা গোলওয়ালকারের কথায় ‘হিন্দুরা তোমরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শক্তি ক্ষয় করো না। তোমাদের শক্তি বাঁচিয়ে রাখো আমাদের অভ্যন্তরীণ শত্রু মুসলিম, খ্রিস্টান এবং কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।’ মোদী যে পতাকা তুলছেন সেই জাতীয় পতাকাকেও অস্বীকার করেছিল আরএসএস। তাদের মুখপত্রে লেখা হয়, ‘বরাত জোরে যেসব লোকেরা ক্ষমতায় এসেছে, তারা আমাদের হাতে তেরঙ্গা ধরিয়ে দিলেও হিন্দুরা কখনোই একে সম্মান করবে না এবং মেনে নেবে না।’
তৎকালীন হিন্দু মহাসভা তথা আরএসএস নেতারা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের বদলে পেছন থেকে ছুরি মারায় বেশি সক্রিয় ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে কয়েকজন অংশ নিলেও ব্রিটিশ পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছিলেন। স্বয়ং সাভারকর বেশ কয়েকবার ব্রিটিশদের গোলামি করার শর্তে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। আরএসএস স্বাধীন গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ ভারত চায়নি। তারা চেয়েছিল শুধু হিন্দুদের জন্য হিন্দু রাষ্ট্র ভারত। আরএসএস’র হিন্দু ভারতে মুসলিম, খ্রিস্টান ও কমিউনিস্টরা থাকবে না। তাই হিন্দু, মুসলিম, কমিউনিস্ট থেকে শুরু করে সব অংশের ভারতীয়দের ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা যোগ দেয়নি। এহেন আরএসএস’র বন্দনা করে মোদী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনাকে কলুষিত করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অসম্মান করেছেন। এটা তিনি করতে পারেন না। স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধীদের মহিমান্বিত করা লজ্জাজনক। গান্ধীকে যারা খুন করেছে সেই খুনিদের গান্ধীর সঙ্গে একাসনে বসানোর হিন্দুত্ববাদী পথেই মোদী হেঁটেছেন। দেশবাসী এটা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করবেন।
 
Editorial
অপাত্রে স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চ
                                    
                                
                                    ×
                                    
                                
                                                        
                                        
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
                                    
Comments :0