Editorial

জাপানে পালা বদল ?

সম্পাদকীয় বিভাগ

 

আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আশা-নিরাশার দোলাচলে আছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ। আসলে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি ও সবচেয়ে শক্তিশালী দে‍‌শের নীতিগত অবস্থানের প্রভাব কমবেশি সব দেশের ওপরই পড়া স্বাভাবিক। যেসব দেশ যত বেশি আমেরিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে তা সে বন্ধু দেশ হোক বা শত্রু, সে সব দেশ চিন্তায় আছে আমেরিকার নতুন সরকার কোন দিকে কতটা রাশ টানবে বা ছাড়বে এই ভেবে। অর্থনীতি, রাজনীতি, ভূরাজনৈতিক বা ভূঅর্থনীতির এই দোলাচলের মধ্যে অনেকটা নীরবে কয়েকদিন আগে হয়ে গেছে জাপানের সংসদীয় নির্বাচন। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের আন্তর্জাতিক প্রভাব আমেরিকার মতো না হলেও এশিয়ায় প্রভাব অস্বীকার করার উপায় নেই। জি-৭ গোষ্ঠীর সদস্য জাপান ভারত সহ বহু দেশের অর্থনীতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। ইদানীং এশি‌য়া প্রশান্তসাগরীয় অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আটকাতে আমেরিকার নেতৃত্বে যে চতুর্দেশীয় জোট গঠন হয়েছে তার অন্যতম খুঁটি জাপান। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে নিজস্ব পরিকাঠামো না গড়ে আমেরিকার ওপর নির্ভরশীল ছিল। চীনের উত্থান ঠেকাতে একা আমেরিকা অক্ষম হয়ে পড়ায় মার্কিন পরামর্শেই জাপান নতুন করে সামরিক শক্তিধর দেশ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। নিকটতম প্রতিবেশী চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়াকে বিপদ হিসেবেই দেখে আমেরিকার বিশ্বস্ত সহযোগী এই দেশ। সম্প্রতি কোয়াড ছাড়িয়ে এশিয়ার ন্যাটো গঠনে উৎসাহ দেখাচ্ছে জাপান।

এমন একটি দেশের সংসদীয় ভোট হয়ে গেলেও তার ফলাফল নিয়ে বেশি ভাবার ফুরসত মেলেনি অনেকেরই। কিন্তু এই নির্বাচনে জাপানের বুকে রাজনৈতিক পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী। প্রায় ছ’দশক ধরে বেশিরভাগ সময় যে দল জাপানের শাসন ক্ষমতায় দাপটের সঙ্গে বিরাজ করেছিল সেই লিবারাল ডেমোক্রেটিক দলের (এলডিপি) বড়সড় বিপর্যয় ঘটেছে যা তারা ভাবতেই পারেনি। সংসদের মোট ৪৬৫ আসনের মধ্যে তাদের ছিল ২৫৬। সেটা এক ধাক্কায় নেমে গেছে ১৯১-এ। ১ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নিয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে সংসদের আগাম নির্বাচন ঘোষণা করে দেন সিগেরু ইসিবা। ভেবেছিলেন চমক দেখাবেন। কিন্তু ফল হলো উলটো। ক্রমাগত বয়স্ক জনসংখ্যার ভারে ন্যুব্জ জাপানের অর্থনীতি সবদিক থেকেই সঙ্কট জর্জরিত। তাই এই সরকারে প্রতি আস্থা অনেকদিন ধরেই টাল খাচ্ছে। ২০২০ সালে নানা দুর্নীতি ও বিতর্কের আবহে পদত্যাগে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে। দু’বছর পর আততায়ীর গুলিতে তিনি খুন হয়ে যান। পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিসিদাও নানা অভিযোগে দলের মধ্যেই কোণঠাসা হয়ে পদ ছাড়তে বাধ্য হন। শেষে ইসিবারও বিদায়ের পালা।

সংসদে শাসক দল সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারিয়েছে। দলের মধ্যে যেমন চাপানউতর চলছে তেমনি সঙ্গী দলও দোষারোপ শুরু করেছে। বিপরীতে মধ্যবাম দল সিডিপি আসন সংখ্যা ৯৮ থেকে বাড়িয়ে ১৪৮ করতে সক্ষম হয়েছে। এখন তারা অন্যান্য ছোট দল ও নির্দলদের নিয়ে সরকার গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। যদি তারা সরকার গড়তে সক্ষম হয় তাহলে অর্থনীতি ও ‍‌বিদেশ নীতিতে গুরুতর কোনও পরিবর্তন না হলেও ভারত সহ বিভিন্ন দেশে নির্মীয়মাণ ও প্রস্তাবিত যৌথ প্রকল্প, জাপানী বিনিয়োগ, বাণিজ্য আপাতভাবে থমকে যেতে পারে। সিনজো আবের আমলে মোদী সরকারের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ভারতে জাপানী বিনিয়োগ আসে। মোদীর সাধের বুলেট ট্রেনের অর্থও জোগাচ্ছে জাপান। তেমনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চক্রের শরিক হয়ে চীনের বিরুদ্ধে খড়্গ হবার ক্ষেত্রেও আবের বড় ভূমিকা ছিল। আবে জমানার অবসানের পর বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে ভারতে জাপানী সহায়তা থমকে যেতে পারে। সামনের মাসে মোদীর জাপান সফরও সম্ভবত পিছিয়ে যাবে।

Comments :0

Login to leave a comment