দীপশুভ্র সান্যাল, জলপাইগুড়ি
সিকিমে তিস্তার বিপর্যয় দেখে শঙ্কিত ডুয়ার্সও। হিমালয়ান রেঞ্জের ভঙ্গুর ভুটান পাহাড় থেকে নেমে আসা ডজন খানেকেরও বেশি বড় নদী এবং সেই সঙ্গে অসংখ্য ঝোরা এখানেও যে কোন সময় রূদ্র রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। যার ছোটখাটো সংস্করণ এখন মাঝে মাঝেই চা বলয়ের নানা স্থানে দেখা যায়।
নদী বিশেষজ্ঞরা দু’টি কারণের কথা বলছেন। প্রথমত পাহাড়ে ব্যাপক হারে গাছ কেটে কংক্রিটের জঙ্গল নির্মাণ। দ্বিতীয়ত জলবায়ুর আমূল পরিবর্তনের কারণে অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া প্রচুর বৃষ্টিপাত। প্রকৃতিগত কারণেই গতিপ্রবাহের পথে পলি থিতিয়ে থাকায় পাহাড়ি নদী সেই অস্বাভাবিক পরিমান জল বহন করতে না পেরে ভাসিয়ে দিতে পারে বিস্তীর্ণ এলাকাকে। জলবিদ্যুত তৈরির জন্য একের পর এক ড্যাম তৈরি হওয়ার পর রুদ্ধ তিস্তা যখন প্রতিশোধ নিচ্ছে। ভুটানের ভেতরে নির্মীয়মান বেশ কিছু জলবিদ্যুত প্রকল্প অচিরেই ডুয়ার্সের কাছে বড়সড় বিপদ হবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্নও তুলছেন অনেকেই।
এখনও ভারত-ভুটান যৌথ নদী কমিশন তৈরি না হওয়ার বিষয়টিও আলোচনার টেবিলে বারবার ঘুরে আসতে শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট নানা মহল থেকে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রূপক কুমার পাল বলেন, ‘‘ডুয়ার্সের একেকটি নদীর প্রকৃতি একেক ধরনের। ছোট নদীগুলি হড়পা বান প্রবণ। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গা সহ সিকিমে মোট বৃষ্টিপাত গড়পড়তা একই থাকলেও অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টির প্রবণতা তৈরি হয়ে বছরের বিভিন্ন সময়। দ্বিতীয়ত যে পাহাড়ি জঙ্গল বৃষ্টির জলকে মাটিতে ধারন করতে সহযোগিতা করত তা ক্রমেই বিলুপ্ত। ফলে ওই সমস্ত নদী ফুলে ফেঁপে উঠছে প্রতিনিয়ত। এহেন পরিস্থিতিতে ডুয়ার্সে আগামীতে হড়পা বান বাড়বে বই যে কমবে না সেকথা বলাই যায়।’’
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন জলঢাকা, মূর্তি, মালনদী, গাঠিয়া, ডায়না, রেতি, সুকৃতি, ডিমডিমা, বিরবিটি, পাগলি, পানা, বাসরা, রায়ডাক, সংকোশ, কালজানি, তোর্ষার মতো অসংখ্য নদী পাহাড় থেকেই নেমে এসেছে। বছরের অন্য সময় শীর্ণকায়া হয়ে প্রবাহিত এই সব নদীই বর্ষায় বানভাসী পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এরপর যদি কখনো কোথাও মেঘভাঙা বৃষ্টি জাতীয় কিছু ঘটে তবে তা যে প্রলয়ে পরিণত হতে এক মিনিট সময়ও নেবে না।
আরও একটি বড় কারণ হিসেবে উঠে আসছে মাটির আর্দ্রতা বেড়ে গিয়ে লাগাতার ধস নামার বিষয়টি। ওই ধস নদীর বুকে যে ড্যাম তৈরি করা হয়েছে অগোচরেই জমা হচ্ছে সেখানে। ফলে ড্যামের তলদেশ ক্রমেই বুঁজে যাচ্ছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। ভরা নদী এর জেরে আরো বেশি উত্তাল হয়ে উঠছে। তিস্তা ও এর উপনদী মিলিয়ে ৪৭ টিরও বেশী নির্মিত ও নির্মীয়মান ড্যামের উদাহরণ টেনে নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গবেষণাধর্মী কাজ চালিয়ে যাওয়া বানারহাট হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুকল্যাণ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ভারতের সহযোগিতায় ভুটানেও বেশ কিছু জলবিদ্যুত প্রকল্পের কাজ চলছে। সিকিমে তিস্তায় যা হলো এখানেও যে এর ফলে তা হবে না সেই নিশ্চয়তা কে দিতে পারে।’’
সুকল্যান ভট্টাচার্যের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গত ১০০ বছর ধরে চা বাগানগুলিতে যে পরিমান রাসায়নিক সার দেওয়া হয়েছে যার জেরে ডুয়ার্সের মাটির উপরিভাগ বা টপ সয়েল এখন ঝুরঝুরে। ফলে জল আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভাসতে শুরু করেছে নানা এলাকা। দ্রুত এসব নিয়ে চিন্তাভাবনা না করা হলে পরিণাম আরো ভয়ঙ্কর হতে পারে বলেই ধারনা তাঁর।
উত্তরবঙ্গের নদী আন্দোলনের অন্যতম ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ তথা প্রাক্তন সাংসদ দেবপ্রসাদ রায় বলেন, ‘‘আজ পর্যন্ত ভারত-ভুটান যৌথ নদী কমিশন তৈরি হল না। যেটা রয়েছে সেটা হল জয়েন্ট টিম অফ টেকনিক্যাল এক্সপার্ট। সবার অগোচরে উঠে গেছে উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশনও। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন পর্ষদের অনুরোধে ২০০২ সালে এখানকার নদী ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় জল সম্পদ মন্ত্রকের আওতাধীন ওয়াটার অ্যান্ড পাওয়ার কনসালটেন্সি সার্ভিসেস (ওয়াপকস) যে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেছিল তা হিমঘরেই পড়ে রইলো। এক কথায় পরিষ্কার কোন নদী নীতিই নেই এদেশের। এর ফল হচ্ছে মারাত্মক।’’
(যে কোনও সময় ভয়ঙ্কর হতে পারে ডুয়ার্সের নদী। ছবি প্রবীর দাশগুপ্ত)
Comments :0