প্রতীম দে
শারদোৎসবের কয়েক মাস আগে থেকে রাজ্য জুড়ে বিভিন্ন ব্যানার দেখা যায়। সেখান উল্লেখ থাকে একটা কথা, তা হচ্ছে ‘সর্বজনীন’। অর্থাৎ শারদৎসব সবার।
এখন প্রতিটি পাড়ায় অলিতে গলিতে পুজো হয়। থিমের চাকচিক্য দেখা যায়। কিন্তু এই উৎসবের শুরু কোথা থেকে?
কলকাতার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পুজো সিমলা ব্যায়াম সমিতি দাবি করে যে তারাই প্রথম সার্জনীন পুজো শুরু করে। তাদের ফেসবুক পেজে লেখা রয়েছে ‘Simla Byayam Samity ’ The Pioneer of Sarbojanin Durgotsab"।
তবে একটি সূত্রে বলছে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনকে কেন্দ্র করে প্রথম শুরু হয় সর্বজনীন পুজো।
একটি মত বলছে মালদহ এবং দিনাজপুরের জমিদাররা প্রথম দুর্গাপুজো করতেন। তবে ইতিহাসে উল্লিখিত প্রথম দুর্গাপুজো ছিল মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্বপুরুষ ভবানন্দের তত্ত্বাবধানে ১৬০৬ সালের দিকে নদীয়ায়। পরবর্তীতে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে দুর্গাপূজা উদযাপন বৃহত্তর রূপ ধারণ করে। তার পূর্বপুরুষ রুদ্র রায়ের নির্মিত ভবনে এই উৎসব অনুষ্ঠিত হতো।
কলকাতায় প্রাচীনতম পুজো হলো বড়িশার সাবর্ণ চৌধুরীর পারিবারিক পুজো, যা ১৬১০ সালে শুরু হয়েছিল এবং আজও তা ঐতিহ্য মেনেই হয়। পরবর্তীকালে, কলকাতার নতুন শহুরে ব্যবসায়িক অভিজাতদের মধ্যে দুর্গাপুজোর প্রচলন গড়ে ওঠে। শোভাবাজার রাজের রাজা নবকৃষ্ণ দেব একটি 'পারিবারিক পূজা' প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এই বিশ্বাস করে যে এটি তাঁর ব্যবসায়িক স্বার্থকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।
১৭৫৭ সালে পলাশী জয়ের পর, রবার্ট ক্লাইভ রাজা নবকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে দুর্গাপুজোয় যোগদানের আমন্ত্রণ পান। তিনি শোভাবাজার রাজবাড়িতে এসেছিলেন যেখানে তার জন্য একটি সোনার সিংহাসন রাখা হয়েছিল। রাজা নবকৃষ্ণ দেব দুর্গার ধরন ব্যবসায়ীদের মধ্যে ফ্যাশনের প্রতীক হয়ে ওঠে। পারিবারিক পুজোয় যোগদানকারী সাহেবদের সংখ্যা (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে ইউরোপীয়) প্রতিপত্তির সূচক হয়ে ওঠে।
১৭৬১ সাল পর্যন্ত দুর্গাপুজো প্রধানত পারিবারিক উৎসব হিসেবে পালিত হতো।
কিন্তু হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়ায় একটি পারিবারিক পুজোয় বারোজন যুবককে যেতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। তারপর তাঁরা একটি বারো সদস্যের কমিটি গঠন করে, যারা নিজেরা টাকা জোগাড় করে প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজার আয়োজন করে। তাই এই ধরনের পূজাকে বারোয়ারি (বারো ইয়ারি) বলা হয়।
পরবর্তীতে, যখন ১৯১০ সালে কলকাতায় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়, তখন কলকাতার বলরাম বোস ঘাট রোডে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা একটি দুর্গা পুজোর আয়োজন করেছিলেন। সেই পুজোয় বারোয়ারি শব্দের বদলে ব্যবহার হয় ‘সর্বজনীন’ যার অর্থ সর্বজনীন। সেটি ছিল কলকাতায় প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপুজো।
প্রাচীন বারোয়ারি পুজোর মজা এবং উত্তেজনায় ছিল অন্য মজা। সেই পুজোয় দেশের স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত সংগ্রামীরা লাঠি খেলা দেখাতেন। যা আজও বাগবাজারে হয়। যার নাম বীরাষ্টমী। সেই সময় প্যান্ডেলের আশেপাশের স্টলে স্বদেশি জিনিসপত্রও বিক্রি হতো। জাতীয়তাবাদী অনুভূতি প্রকাশের একটি মঞ্চ এবং মানুষকে একত্রিত করার রাস্তা হিসাবে পুজো উদ্যাপন করা হতো। সেই পুজো থেকেই দেশকে দেবী রূপে দেখে দেশের মুক্তির শপথ নেওয়ার বার্তা প্রচার হতো।
এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ‘সর্বজনীন দুর্গোৎসব’ উদ্যাপন। বিভিন্ন ক্লাব দুর্গাপুজো উদ্যাপন শুরু করে। প্রতিমা তৈরি থেকে শুরু করে প্যান্ডেল তৈরি সব কিছুতেই জাঁকজমকের ছোঁয়া পেতে থাকে। মূর্তি নির্মাণ, প্রতিমা সজ্জা, প্যান্ডেল নির্মাণে পরীক্ষামূলক শিল্পের প্রয়োগ অব্যাহত রয়েছে।
প্রথমে বাঁশের কাঠামো তৈরি করে তারপর খড় দিয়ে ভিত্তি কাঠামো তৈরি করে। এরপর শিল্পী মাটি দিয়ে প্রলেপ দিয়ে মনের মতো প্রতিমা তৈরি করেন।
শুরুতে একচালা মূর্তি নির্মাণ ও পুজো করা হলেও পরবর্তীতে তাতেও নানা ধরনের শিল্পের ছোঁয়া লেগেছে। কখনও সেখানে উঠে আসে সামাজিক বিষয়, কখনও দেশ-বিদেশের লোকশিল্পের ছোঁয়া। যা এখন ‘থিম’ হিসাবে পরিচিত।
প্যান্ডেল তৈরিতে প্রথমে বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী কাঠামো তৈরি করে তারপর শিল্পী মনের মতো করে প্যান্ডেল তৈরি করেন। কখনও একটি প্রাচীন মন্দির, কখনও দেশ বা বিদেশের একটি বিখ্যাত স্থাপত্য বা কখনও একটি পুজো প্যান্ডেল একটি শিল্পীর স্বাধীন ধারণা অনুযায়ী নির্মিত হয়।
কিন্তু যেই জিনিসটা এখন উৎসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তা হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি। কে কত অনুদান দেবে, কার পুজো কে উদ্বোধন করবে, কে আগে উদ্বোধন করবে। আগে নামী তারকারা পুজোর উদ্ধোধন করতেন, কিন্তু এখন তা নেই।
Comments :0