ICDS worker

প্রাণনাশের হুমকি পেয়ে আত্মঘাতী আইসিডিএস কর্মী

রাজ্য

 ক্রমাগত ফোন করে বলা হয়েছে পাকাবাড়ি কাঁচা দেখাতে হবে, আর কাঁচাবাড়িকে লিখতে হবে পাকা। এমনকি কথা না শুনলে তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলারও হুমকি দেওয়া হয়। ফোন এসেছে রাতের দিকে। বাড়িতে গিয়েও শাসানো হয়েছে। বলা হয়েছে, চলন্ত বাসের চাকার তলায় তাঁকে ফেলে পিষে মারা হবে! এই মারাত্মক হুমকির পরেও রবিবারও রেবা বিশ্বাসকে দেখা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ঘরের তালিকা নিয়ে সততার সঙ্গে গ্রামে সমীক্ষা করতে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তৃণমূলের পঞ্চায়েত সদস্য এবং প্রশাসনিক মহলের অমানবিক চাপে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। পাশে পাননি পুলিশকেও। শেষমেশ আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হলেন স্বরূপনগর ব্লকের শাঁড়াপুল নির্মিত গ্রাম পঞ্চায়েতের ১৮৩ নম্বর সেন্টারের আইসিডিএস কর্মী রেবা বিশ্বাস। এই অভিযোগ করেছেন তাঁর পরিবার এবং স্থানীয়রা। ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি।
মঙ্গলবার উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সিআইটিইউ এবং রাজ্যের সমস্ত শ্রমজীবী মহিলা নেতৃত্বের ডাকে স্বরপনগরের বিডিও অফিসের সামনে বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন কর্মসূচি হবে। এছাড়াও রাজ্যের সমস্ত জেলায় বিডিও, এসডিও, জেলা শাসকের দপ্তরে শ্রমজীবী মহিলা সংগঠন এবং সিআইটিইউ’র পক্ষ থেকে জমায়েত করে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং আশা ও আইসিডিএস কর্মীদের এই কাজ থেকে অবিলম্বে অব্যাহতি দেওয়ার দাবিতে ডেপুটেশন দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
সোমবার সকালে বাড়ির কাছে একটি কাঁঠালগাছে তাঁকে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখেন প্রতিবেশীরা। গাছের গায়ে একটি কাঠের মইকে হেলান দেওয়া অবস্থায় দেখা যায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ যায়। মৃতদেহ উদ্ধার করে বসিরহাট জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয় ময়নাতদন্তের জন্য। এই মৃত্যুর ঘটনায় গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে শাঁড়াপুল বিশ্বাস পাড়ায়। কদিন যাবৎ তাঁর সহকর্মী ও প্রতিবেশীদের একান্তে তিনি জানিয়েছিলেন, তাঁকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে নানাভাবে। বিশ্বাস পাড়ার আরও এক আইসিডিএস কর্মী প্রিয়া বিশ্বাস, সম্পর্কে মৃত রেবা বিশ্বাসের বোন। তাঁর কাছেও ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার হুমকির ফোন এসেছে। তিনি বলেন, ‘রেবা আর আমি। আমাদের কারোর স্বামী নেই। এভাবে হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে কীভাবে কাজ করব? পুলিশ প্রশাসন যদি আমাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে তবে আরও কত আইসিডিএস কর্মীকে আত্মহত্যা করতে হবে তার কোনও ঠিক নেই। রাস্তায় বেরুতে দিচ্ছে না। রাত হলেই হুমকি ফোন আসছে। মেম্বার ফোনে হুমকি দিচ্ছে। পুলিশ প্রশাসন কেউ পাশে থাকছে না। আমাদের সমস্যা আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে জীবন দিয়ে।’
রেবা বিশ্বাসের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় যাতে অভিযোগ না করা হয় তার জন্য তৎপর স্থানীয় তৃণমূলের নেতারা। রেবা বিশ্বাসের মৃত্যুর প্রসঙ্গে এদিন সংবাদমাধ্যমকে এমনই জানান সিপিআই(এম) নেতা হামাল উদ্দিন আহমেদ। পঞ্চায়েত সদস্য সাহেব উদ্দিন গাজি বারবার ফোন করে একাধিকবার মৃত আইসিডিএস কর্মীকে হুমকি দিয়েছেন। রবিবার রাতে এই পঞ্চায়েত সদস্য দুষ্কৃতীদের সঙ্গে নিয়ে রেবা বিশ্বাসের বাড়িতে যান এবং তাঁকে কাঁচা ঘর পাকা এবং পাকা ঘর কাঁচা দেখানোর চাপ দেন। প্রতিবেশীদের বক্তব্য, এই ধরনের পরিস্থিতির চাপে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।
গত ৯ ডিসেম্বর সন্দেশখালি ২নম্বর ব্লকের বেড়মজুর ২নম্বর পঞ্চায়েতের ১৭১ নম্বর সেন্টারের আইসিডিএস কর্মী শম্পা বোস মজুমদার তাঁদের আইসিডিএস কর্মী সহায়িকাদের গ্রুপে দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে লেখেন তাঁর উপর হামলার ঘটনা। ওই একই দিনে সন্দেশখালি-১নম্বর ব্লকের সেহারা রাধানগর পঞ্চায়েতে দীর্ঘক্ষণ আইসিডিএস কর্মীদের আটকে রাখা হয়েছিল বলে জানা গেছে।
প্রতিটি ঘটনায় উঠে এসেছে আবাস যোজনার সমীক্ষায় পাকা বাড়ি কাঁচা আর কাঁচা বাড়ি পাকা দেখানোর মানসিক চাপের কথা। যার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা গেল স্বরূপনগরে শাঁড়াপুল বিশ্বাস পাড়ার ১৩৮ নম্বর বুথের বাসিন্দা রেবা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে। এবার অভিযোগ না জানানোর জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে পরিবারকে। এলাকাবাসীদের বক্তব্য, বিডিও ও সিডিপিও কী ভূমিকা পালন করেন তা দেখার আছে। এখানেও কী স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মামলা রুজু করে ঘটনার তদন্ত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা থাকবে? উঠছে এমনই প্রশ্ন। 
স্বরূপনগরের আইসিডিএস কর্মী রেবা বিশ্বাসের দুঃখজনক আত্মহত্যার ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে সিআইটিইউ রাজ্য কমিটির সভাপতি সুভাষ মুখার্জি এবং অনাদি সাহু সোমবার এক প্রেস বিবৃতিতে বলেন, ঘটনাটি মর্মান্তিক। রাজ্য সরকার স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নির্দিষ্ট কাজের বাইরেও এই কর্মীদের অন্যান্য কাজ করাতে বাধ্য করে। এবার প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার ২০১৮সালে তৈরির তালিকা অনুসন্ধান করার নির্দেশ মানতে গিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলী নেতাদের হুমকির মুখে পড়তে হচ্ছে এই কর্মীদের। স্বরূপনগরে সমীক্ষায় ওই কর্মী পাকা দোতলা বাড়ির মালিকও আবাস যোজনার টাকা পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন। তারই ফলে তৃণমূল কর্মীরা তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন রেবা বিশ্বাস। এই ঘটনায় দোষীদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে অবিলম্বে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী সহায়িকা এবং আশা কর্মীদের দিয়ে এখনই এই কাজ করানো বন্ধ করতে হবে। এদিন পশ্চিমবঙ্গ শ্রমজীবী মহিলা কো-অর্ডিনেশন কমিটি’র আহ্বায়ক মধুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুর্নীতিবাজদের শাস্তির দাবি করে রেবা বিশ্বাসের শোকস্তব্ধ পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।    

ছবি: মৃত আইসিডিএস কর্মী রেবা বিশ্বাস।

Comments :0

Login to leave a comment