নীলোৎপল বসু
কাশ্মীর উপত্যকার পহেলগামে সন্ত্রাসবাদীদের এলোপাথাড়ি গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেলেন ২৬ জন নিরপরাধ মানুষ। সবাই পর্যটক নন। একজন ছিলেন পর্যটকদের টাট্টু ঘোড়ায় চড়িয়ে ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ। সন্ত্রাসবাদীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে তাদের একজনের হাত থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন আদিল। আর মুহূর্তের মধ্যে তাঁর শরীরটাও ঝাঁঝরা হয়ে গেল। জঙ্গল ঘেরা ঐ জায়গাটিতে নিরাপত্তা বাহিনীর কোনও দেখা মেলেনি। এই অবস্থায় আশপাশের স্থানীয় মানুষ যাদের বেশিরভাগটাই কাশ্মীরি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে ছিলেন। তেমনই একজন নাজাকত আহমেদ শাহ। আদিলের খুড়তুতো ভাই গাড়িচালক। তাঁর তৎপরতায় ছত্তিশগড়ের বিজেপি কর্মী অরবিন্দ আগরওয়াল সহ মোট ১১ জনকে নিজের জীবন ঝুঁকির মুখে ঠেলে বাঁচিয়ে দিলেন নাজাকত। সামাজিক মাধ্যমে কোনোটাই ভুয়ো নিউজ নয়। ছত্তিশগড়ে ফিরে নাজাকতের সঙ্গে ছবি তুলে পোস্ট করেছেন অরবিন্দ।
আর তারপর থেকেই তীক্ষ্ণ প্রতিক্রিয়া। উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদীদের ট্রিগারের চাপে রক্তের ঋণ শোধ করার জন্য কোমর বেঁধে নেমেছেন উপত্যকার মানুষ। হাজার হাজার কাশ্মীরি ঐক্যবদ্ধভাবে মিছিল করেছেন শ্রীনগর সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায়। শোক, ক্রোধ, ঘৃণা আর অনুতাপ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কারণ সন্ত্রাসবাদীদের এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিরপরাধ পর্যটকদের যেমন স্তম্ভিত করে দিয়েছে ঠিক তেমনই — যারা পর্যটনের উপরে নির্ভর করে থাকেন তাদের রুটিরুজির উপরেও তীব্র আক্রমণ। অসংখ্য দৃশ্যশ্রাব্য টুকরো ভেসে উঠছে সামাজিক মাধ্যমে। বিলাপ করছেন কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ। কাতর অনুনয় পর্যটকরা যেন চলে না যান। তারা যেন ফিরে আসেন ভূস্বর্গে। বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তাদের নিরাপত্তা ও থাকা খাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন অনেক সাধারণ মানুষ। তাদের উচ্চারণ স্পষ্ট। যে নিরপরাধ মানুষ লুটিয়ে পড়লেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে তারা আমাদের ভাই বন্ধু সহ-নাগরিক। আর হত্যালীলার খলনায়করা তাদের শত্রু।
মানুষের এই প্রত্যাঘাতে জড়িয়ে গেছে গ্রামবাংলাও। নদীয়ার তেহট্টের যুবক ঝন্টু আলি শেখ সন্ত্রাসবাদীদের খোঁজে উধমপুরে কাউন্টার ইনসারজেন্সি অপারেশন চালানো সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের হাবিলদার ঝণ্টু সন্ত্রাসবাদীদের গুলিতে শেষ। খেতমজুর পরিবারের ছেলে ঝণ্টু দেশের নিরাপত্তার জন্য ছিল দায়বদ্ধ। তাঁর বড়ভাই শরিফুল হচ্ছে নিয়ন্ত্রণরেখায় পাহারারত সেনাবাহিনীর জওয়ান। দুই ভাইকে দেখে তেহট্টের প্রত্যন্ত গ্রামের অনেক যুবকই যোগ দিয়েছে সেনাবাহিনীতে। হৃদয় বিদারক কথা শুনিয়েছেন ঝণ্টুর খেতমজুর বাবা সবুর আলি। ছেলের লাশ সামনে রেখে তিনি দৃঢ়ভাবে আক্ষেপ করেছেন — এবার তো প্রমাণ হলো আমরা কার সাথে। আদিলের বাবাও উপত্যকায় দাঁড়িয়ে বলেছেন একই কথা— আমি আমার ছেলের জন্য গর্বিত।
এটাই দেশ। ভারত। সাদামাটা সাধারণ মানুষ জীবনের অভিজ্ঞতায় তারা বুঝছেন সন্ত্রাস, হিংসা, হত্যা যতই ধর্মের দোহাই দিয়ে করা হোক না কেন— তা কোনও সম্প্রদায়ের মানুষকেই নিরাপত্তা, স্বস্তি, বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে পারে না। এই মূল সুর ধ্বনিত হয়েছে ইউসুফ তারিগামির মুখে। এই রক্তের স্রোত, এই নিরপরাধ মানুষের নির্মম হত্যা এটা কাশ্মীরিদের ঐতিহ্য নয়। কাশ্মীরিয়ৎ এই শব্দটি উল্লেখ না করেই ইউসুফ বলেছেন কাশ্মীরি মানুষ অতিথিপরায়ণ। যে সন্ত্রাসবাদীরা এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করল তারা এই ঐতিহ্যকে শেষ করতে চায়। ইউসুফ কোনও উটকো নেতা নয়। তিনি কখনো সন্ত্রাস বিদীর্ণ উপত্যকা থেকে পালিয়ে যাননি নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে।
সর্বদলীয় বৈঠক — রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিক্রিয়া
২৪ এপ্রিল সরকারের ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকের আগেই বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দল দ্ব্যর্থহীনভাবেই পহেলগামের নৃশংস রক্তস্রোতের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ও নিন্দা ধ্বনিত করেছিলেন। ২৪ তারিখের ঐ বৈঠকেও এর অন্যথা হয়নি। কোনও দলই এই মূল সুরের বাইরে কোনও কথা বলেননি। কিন্তু তারা নিশ্চয়ই সরকারের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
এনিয়ে তো দ্বিধার কোনও জায়গা নেই যে নাগরিকদের-পর্যটকদের নিরাপত্তার চূড়ান্ত দায়িত্ব সরকারেরই। আর সরকার মানেই এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার, কারণ ৩৭০ ধারা বিলুপ্ত করে দেওয়ার পরে জম্মু-কাশ্মীর প্রশাসনিকভাবে আলাদা রাজ্য নয়— ইউনিয়ন টেরিটরি। আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা সবই উপরাজ্যপালের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে। গত ২-৩ বছর ধরে দেশের মানুষকে প্রচারের ঝটিকা অভিযানে বোঝানো হচ্ছিল যে কাশ্মীর উপত্যকা শান্ত স্বাভাবিক। কোনও ধরনের কোনও বিঘ্ন ঘটার সম্ভাবনা নেই।
সুতরাং স্বায়ত্তশাসনে যে অধিকারগুলি যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধানে রাজ্য সরকারগুলির হাতে থাকে জম্মু কাশ্মীর বিধানসভায় বিরোধীদের সংখ্যাধিক্য থাকা সত্ত্বেও এক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাকে পর্যুদস্ত করেই এই শান্তি এসেছে। পহেলগাম ঠিক এর উলটোটাই প্রতিষ্ঠিত করল। এই বাস্তবতার শক্তি এতটাই যে খোদ আরএসএস বা প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতিতেও দেশের কোন সহ-নাগরিককে অপরাধীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার কোনও চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়নি। ঠিক এই বাস্তবিকতার সামনে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় সরকারকেও স্বীকার করে নিতে হয়েছে যে নিঃসন্দেহে কিছু ত্রুটি হয়েছিল।
কীভাবে এই ত্রুটি ঘটলো তার পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনার কোনও সুযোগ এই মুহূর্তে নেই। অনেক কিছুই তদন্তসাপেক্ষ। সর্বদলীয় বৈঠকে বিরোধীরা এই কথাই বলেছেন যে অপরাধীদের চিহ্নিত করে তাদের আইনের মুখোমুখি হতে বাধ্য করতে হবে। আর এটিও চিহ্নিত করতে হবে। ৩৭০-র অবলুপ্তি আর কোনও আড়াল রাখছে না। ১২ ফেব্রুয়ারি গার্ডিয়ান পত্রিকায় একটি রিপোর্টে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে পাকিস্তানের সীমানায় একটি পুনর্নবীকরণ জন্য নির্মিত রিনিউয়েবল এনার্জি পার্ক নির্মাণ করতে গিয়ে দেশের নিরাপত্তার প্রোটোকলকে শিথিল করেছে সরকার। উল্লেখযোগ্য এই প্রকল্পটির মালিক গৌতম আদানি। একথাও বলার সময় আসেনি যে সরকারের ঐ পদক্ষেপের সঙ্গে পহেলগামের ঘটনার কোনও যোগাযোগ আছে কি না। কিন্তু অতীতে এই ঘটনা ঘটলে নিঃসন্দেহে কেন্দ্রীয় সরকার তার দায় চাপাতো বিরোধী সরকারের উপরেই।
মিডিয়া মিথ্যাচারের ধূম্রজাল
আসলে নতুন যে অভিযান শুরু হয়েছে তার বর্ষাফলক কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমের হাতেই। আর তার সঙ্গে রয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিময়ে তৈরি করে সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা তৈরির পরিকাঠামো। কাজেই সর্বদলীয় বৈঠকেও উঠে এসেছিল সেই অভিযোগ যে ঘৃণার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। ধর্মীয় পরিচিতি ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে বিভাজন এবং পারস্পরিক আস্থাহীনতার কুটিল পরিবেশ।
অস্ত্র শানানো হয়েছে যে কোনও ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন শিরোনামে কখনো লাভ জিহাদ, কখনো গো মাংস, কখনো বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নিধন এমনকি গাজায় প্যালেস্তিনীয়দের গণহত্যার সপক্ষে। বিষবৃক্ষ এখন ফল দিচ্ছে। কাজেই আরএসএস বা প্রধানমন্ত্রী যাই বলুন না কেন সোশাল মিডিয়ায় মিথ্যার চাষ। কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা বোঝারও উপায় নেই। বেশ কিছুদিন আগে একটি আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল ভুয়ো খবর উৎপাদনের আন্তর্জাতিক বাজারে স্নায়ুকেন্দ্র ভারত। দেশের কোন বিপর্যয় মোকাবিলা করবার ক্ষেত্রে একটি গণতান্ত্রিক সমাজের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার অবিকৃত তথ্য পরিবেশন এবং দেশের মানুষের ঐক্য। আর এই ক্ষেত্রটাই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো সত্ত্বেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় দীর্ণ। অবস্থাটা এতটাই ভয়াবহ যে সংবাদে প্রকাশিত একজন সাংবাদিক মৃদুস্বরে সরকারের নিরাপত্তার ত্রুটি নিয়ে প্রশ্ন তোলায় বিজেপি’র কর্মীরা তাকে পিটিয়ে দিয়েছিল।
রক্তস্রোতকে এই ঘৃণার স্রোতে মোকাবিলা করা যাবে না
সরকারকে কঠোর হতে হবে। কঠোর হওয়াটাই নরেন্দ্র মোদীর প্রধান অর্জন। এটাই প্রচার। এই প্রচারের যদি বিন্দুমাত্র সত্যতা থাকে তাহলে এটাই সেই দাবি প্রতিষ্ঠিত করবার সঠিক সময়। বিরোধীরা সাথেই আছে। কিন্তু সেই বিশ্বাসের মর্যাদা সরকারকেই দিতে হবে সত্য উদ্ঘাটিত করে। সন্ত্রাসবাদীদের হত্যাকাণ্ড শুধু নয় তার পটভূমিকেও উন্মোচিত করতে হবে। তারজন্য যদি দেশের বাইরে কোথাও ষড়যন্ত্র রচিত হয়ে থাকে সে সত্যও সামনে আনা যেতে পারে। কিন্তু একইসঙ্গে দেশের সরকারের দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতাও স্বীকার করে নিতে হবে।
দেশের সাধারণ মানুষকেও বিশ্বাস করতে হবে হিংসা দিয়ে, ঘৃণা দিয়ে, তা যেন কোন ধর্মের নাম করেই হোক না কেন তা কোন ধর্মের মানুষকেই নিরাপত্তা দিতে পারে না। জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তাও দিতে পারে না, গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ জাগ্রত শুভবুদ্ধি দেশের এই সঙ্কটকালে অন্ধকারের মধ্যে আলোর রেখা হয়ে উঠতে পারে।
Comments :0