অলকেশ দাস
প্রথমে টানাপোড়েনে ঋদ্ধ ছিল বাঙালির উপলব্ধির জগৎ। একটা দম বন্ধ কান্না ছিল। ছিল এক আত্মিক বেদনাবোধ। ছিল অভিমান। একের প্রতি অন্যের। কেন তিলোত্তমা কাণ্ডের বিচারের জন্য প্রতিবাদের পথ দেখাচ্ছ না তুমি? 'ঘরেও নহে, পারেও নহে, যে জন আছে মাঝখানে-সন্ধ্যাবেলা কে ডেকে নেয় তারে'। তারপরেই ডাক এসেছে। বানের মতো। একটি মশাল ঘুরতে ঘুরতে জ্বালিয়ে দিয়েছে সহস্রকে। কে কবে শেষ দেখেছে রিকশা চালকেরা জোট বেঁধে রাস্তায়, এরকম বিচারের দাবিতে। কেউ দেখতে যায়নি প্রথমে, বিচার করতে চায়নি কেন এমন হলো। কাপট্যের মুখোশকে খুলে দিতে চেয়েছে। আন্দোলনের চরিত্র ছিল গ্রহীষ্ণু। পতাকা বা ঝান্ডা আসেনি। আবার শুধু নাগরিকদের আন্দোলনে রূপ নেয়নি, নারীবাদী বেশও ধারণ করেনি। আন্দোলনের সাহস, জেদ যেমন ছিল তেমনি ধৈর্যও ছিল। ভিন্নমতগুলোকে বিচারের দাবিতে একমুখী করার মুনশিয়ানা ছিল। সকল দ্বন্দ্ব বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো/ সেই তো তোমার ভালো। এটাই হয়ে উঠল আন্দোলন। এক অভিনেত্রী আন্দোলনকে কটাক্ষ করা তার এক বন্ধু অভিনেতাকে দেখলাম পরামর্শ দিয়েছেন-"অনুপ্রেরণার লকারে চোখ ,কান, মাথা, মনুষ্যত্ব, বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা, শিক্ষা সব ঢুকিয়ে রেখে চাবিটা হারিয়ে ফেলেছিস মনে হয়..."। এরাজ্যের ভয়ংকর অন্ধকারের মধ্যে এগুলো উৎসারিত আলো। কারা যেন বলেছিল— মেয়েদের নিজেদের কোনও ঘর নেই? কারা বলেছিল— বালানাং ক্রন্দনং বলম? রাতের দখল প্রথমেই নিয়েছিল মেয়েরা। এবারে বিসর্জনের সিঁদুর খেলেছে মুখে বিচারের স্লোগান সচল রেখে।
দ্রোহের চত্বর যেন গোটা রাজ্যই
সোদপুরের নাটাগড়ের সেই বাড়িতে তার বাবা-মা প্রদীপ জ্বেলে বিচার চেয়েছেন। তারা প্রত্যক্ষ করেছেন শোকের এই পরিবেশে মুখ্যমন্ত্রীর 'এনজয়'র কুৎসিত দম্ভের কার্নিভাল। কথায় তাদের আক্ষেপ ঝরেছে-বিচারে মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছার অভাব আছে। এবারের বিসর্জনে যেমন দ্রোহকালের প্রতিবাদ আছে তেমনি মন ভালো নেই বলে মোমবাতি জ্বেলে বিসর্জনের ঘাটের দিকে পা মিলিয়েছে মানুষ। সংখ্যালঘু এলাকায় মানুষকে মোমবাতি জ্বালাতে দেখা গেছে, নিস্তব্ধতা ও শোকের পরিবেশে। একজনের বেঁচে থাকা অলক্ষে অন্যজনের বেঁচে থাকার সঙ্গে যোগ হয়েছে। হয়তো তারা নিজেদের পরিবারের দিকে তাকিয়েছেন। নিজের বাড়ির মেয়েটার দিকে ভেবেছেন যে তার কন্যাটি যখন শরীরে নারী হয়ে উঠবে আর মন থাকবে শিশুর মতো এই হিংস্র সমাজে তার পরিণতি কি হবে। ধীরে ধীরে পা এগিয়েছে দরজার বাইরে, রাস্তায়, দ্রোহের চত্বরে। যখন জুনিয়র ডাক্তারেরা কর্মবিরতি পালন করছিল তখন দেখছিলাম সিনিয়র ডাক্তারেরা তাদের ছাত্রদের, সহকর্মীদের আশ্বাস দিচ্ছিল -তোমাদের রোগীদের আমরা দেখে দিচ্ছি, তোমরা সমাজটাকে দেখো। একটা ধর্ষণ এবং খুনির আখ্যান এটা শুধু নয়। এক বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটের পরিণতি। দুর্নীতি আর প্রশাসনিক ক্ষমতা, কর্তৃত্ববাদ যার কেন্দ্রে। যার শিকার এক এক স্তরে এক এক ধরনের মানুষ। সবকিছুর ভাঁজে লুকিয়ে আছে কোনও না কোনও অত্যাচারের গল্প-আখ্যানের স্বর। বহুমুখী আন্দোলনের স্তর- উপস্তরে এই ধরনের মানুষেরা বিন্যস্ত হয়েছে। আন্দোলনের অনুষঙ্গ ধরাবাঁধা গৎ এর বাইরে। কেউ বলেনি তবু মনের তাগিদে মাটির ঘরের বাইরে দেয়াল জুড়ে নিজের মতো করে প্রতিবাদের ছবি কিংবা দু'এক কথা এঁকেছে বা লিখেছে। এই আন্দোলনের দাবিগুলো যখন উঠেছিল তখন অনেকের কাছে মনে হয়েছিল— অসম্ভব। তারা জানতো না সেই অমোঘ কথা-' যা অসম্ভব তাই দাবি করো '। কারণ আজ যা অসম্ভব কাল তা সম্ভব।
চিন্তার স্পর্শে সমৃদ্ধ দ্রোহপথ
ধর্ষণ, খুন, পরিকল্পনা করে হাত গুছিয়ে কপালে রেখে দেওয়া, জুতোর পাটি পাশে সাজিয়ে রাখা, ফিঙ্গারপ্রিন্ট মুছে ফেলা, তড়িঘড়ি নিয়ম ভেঙে সময়সীমার পর পোস্টমর্টেম, তাও আবার উত্তরবঙ্গের লবির লোকেদের দিয়ে ,লাশ তড়িঘড়ি মা বাবার অগোচরে পুড়িয়ে দেওয়া, রাত বারোটায় এফ আই আর, সেমিনার রুম ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করা, ক্রাইম স্পট ঘেঁটে দেওয়া, যেটুকু প্রমাণের অবশেষ ছিল গুন্ডা দিয়ে ভাঙচুর করে তা লোপাট করা, একগাদা আইনজীবী, ২১ থেকে বেড়ে ৩৪, উকিলের পেছনে লাখো লাখো টাকা ইত্যাদি। এত কিছু করেও যখন কাজ হলো না তখন রাস্তায় নেমে পড়ে মিছিল করা। আর মিছিলে স্লোগান দেওয়া -অপরাধীর ফাঁসি চাই, এনকাউন্টার চাই। এ যেন নিজের দিকে নিজের আঙুল তোলা। স্লোগান যিনি দিচ্ছেন একদিকে তিনি এ রাজ্যের প্রথমা, আবার নিজে পুলিশ এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ঘটনার দায়ে যার প্রথম পদত্যাগ করার প্রয়োজন। 'খেলা হবে' স্লোগানের মাস্টার্স স্ট্রোক দেওয়া নেত্রী নিজেই খেলা বন্ধ করে দেন। ডার্বির ভয়ে। গোটা গ্যালারি যে আওয়াজ তুলবে- উই ওয়ান্ট জাস্টিস। তাতেও পার পাওয়া গেল না। শুধু সেই দুই বড় দলই নয়, যোগ দিল আর এক বড় মহামেডান। তিলোত্তমা মিলিয়ে দিল সকলকে। বাংলা শেষ কবে এই জিনিস প্রত্যক্ষ করেছে ? যখন ডাক্তারদের অবস্থান আন্দোলন তুঙ্গে তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচার মতো দাবিগুলো করলার রসের মতো মেনে নিলেন বা মেনে নেওয়ার ভান করলেন। আর বললেন-এখন বন্যা, আন্দোলন নয়। অথচ বন্যার জল যখন শুকায়নি তখন নিদান দিলেন 'এনজয়' এর। উৎসবের। বন্যা পীড়িত সারা রাজ্যের মানুষের চোখের সামনে চলচ্চিত্রের নায়িকাদের নিয়ে নাচলেন এবং খেললেন। অদূরে আদালতে থাপ্পড়ে সরিবে নেওয়া ব্যারিকেডের মুক্তাঙ্গনে চলল বিকল্প দ্রোহকালের উৎসব। প্রতিবাদের, প্রতিরোধের, বিচারের দাবির। কে বলতে পারে সেই কালো মাথাগুলোর মধ্যে ছিল না গোরু পাচার, কয়লা পাচার, ত্রিফলা, ত্রিপল, শিক্ষা, দেউচা -পাঁচামি কয়লা খনি, আবাস যোজনা ,১০০ দিনের কাজ ইত্যাদি দুর্নীতির শিকার অজস্র মানুষেরা? দ্রোহকালের কুশীলবেরা 'এখনো নীরব যারা'- তাদের উদ্দেশ্যে যেন বার্তা দিল - বিচার যত থমকে রবে আওয়াজ তত তীক্ষ্ণ হবে। আন্দোলন তথাকথিত রাজনীতির ছিল না। কিন্তু উপলব্ধি মানুষকে সত্যে উপনীত করে। আন্দোলনের প্রথম স্তরের সেই কারণে স্লোগান ছিল-আর জি করের মাথা ধরো। মেলাবেন তিনি মেলাবেন। আন্দোলনে মিলে গেল
শহর,গাঁ, ফেস টুপি, দাড়ি ,স্নিকারস, হিজাব, শাড়ি ,সালোয়ার কামিজ। মানববন্ধনে সন্তানের হাতে বাবার হাত, মা এনেছে তার ছেলেকে, গোটা পরিবার শামিল হয়েছে বিদ্রোহে। চিন্তার স্পর্শ সমৃদ্ধ করছে আন্দোলনের গতিশীল কাঠামোকে। আমার হাত বান্ধিবি, পা বান্ধিবি/ মন বান্ধিবি কেমনে ? আমার চোখ বান্ধিবি, মুখ বান্ধিবি/ পরান বান্ধিবি কেমনে? হয়তো বাঁধাধরা তত্ত্বের বিরুদ্ধে। তবু বাঁধন ভেঙেই আশার আলোর সম্ভাবনা।
বাঁধন আরও শক্ত হবে
গৌরী লঙ্কেশের খুনিরা বাইরে, খুনের কারিগরদের বিপুল সংবর্ধনা। যেমন বিলকিস বানুর ধর্ষকদের জেলের বাইরে বিপুল সংবর্ধনা গেরুয়াবাদীদের। এ রাজ্যে তিহার জেল ফেরত বাহুবলীও সেই কায়দায় সংবর্ধনা পেল। বাঁধন হালকা হলেই অন্ধকারের জীবগুলো আবার হামলে এসে পড়বে। মশালের তেল ফুরোলে অন্ধকার চেপে বসবে। আগুনের আঁচ যদি নিভে আসে, তাকে গনগন করে তোল। উঁচু থেকে যদি না হয়, নিচের থেকে করো। বাঁধন আরও শক্ত করতে হবে। জনগণকে যুক্ত করে জনগণের বাঁধন। দৃঢ়তার বাঁধন। ছড়িয়ে দিতে হবে এমন জায়গায় যেমন ডাক্তার মেয়ে অনশন করছে আর তার ডাক্তার বাবা অনশন মঞ্চে এসে তার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। ঘৃণা তৈরি করতে হবে এমন যেমন সন্দীপ ঘোষকে প্রিজম ভ্যানে লোকের ছুঁড়ে দেওয়া থুতু খেতে হচ্ছে। বীনেশ ফোগেটকে যারা ব্যঙ্গ করে পরামর্শ দিয়েছিল জামা খুলে ফেললেই হতো-তাহলেই তো ওজন কমে যেত-তারাও এখন কুমিরের কান্না শুরু করেছে। আন্দোলনের আশেপাশে উঁকি ঝুঁকি দেওয়া শুরু করেছে। যারা হুমকি দেয় আন্দোলনের দিকে আঙুল তুলে যে বদলা হবে-রবীন্দ্র সংগীত বাজবে না -তাদের সঙ্গে এদের ফারাক নেই। মুখ্যমন্ত্রীকে এখন এই ঘটনায় কেউ বিশ্বাস করে না। তবুও। স্মৃতির সরণিতে ফিরে যেতে হয়। এর আগের ঘটনাগুলোতে তার উক্তি-সাজানো ঘটনা, ছোট ঘটনা, লাভ অ্যাফেয়ার, ধর্ষণের ক্ষতিপূরণ- তাও বয়স হিসাবে ইত্যাদি। সরকারি দলের একজন রাজ্যসভা থেকে পদত্যাগ করেছেন। প্রতিবাদে। সংসদের একজন প্রাক্তনী, মুখপাত্র ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। একজন বর্তমান রাজ্যসভা সংসদ প্রতিবাদী হয়েছিলেন বলে লালবাজার থেকে তাকে তলব করা হয়েছিল। সন্দীপ ঘোষের গ্রেপ্তারের পর তিনটে স্ট্যাম্পের ছবি পোস্ট করেছেন তিনি। তার একটি ভাঙা। নিচে বক্তব্য: হোয়াট নেক্সট? ইতিহাসের পরের পাতায় কি আছে তা তৈরি করবে জনগণ এবং তার আন্দোলন।
ঘটনার পিছনের পর্দা খুলবেই
এ সরকার বিশ্বাস করে-পাওয়ার উইথআউট মিস ইউজ লসেস ইটস চার্ম। এরা ভয় দেখাতে ভালোবাসে। আর জি কর এরকম একটা ভয়। ইংলিশ চ্যানেল জয়ী বর্ধমানের সায়নী দাস বলে উঠেছে-রাতের উত্তল সমুদ্র এত ভয় পাইনি যা আরজি করের ঘটনায় পেয়েছি। রিসার্চ পেপার বদলে দেওয়ার ভয়, ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয়, নম্বর কমিয়ে দেওয়ার ভয়, দূরে বদলি করার ভয়, আক্রমণ আর অত্যাচারের ভয়। লোভ। টাকা দিয়ে প্রশ্নপত্র হাতে তুলে দেওয়ার লোভ। এসব থ্রেট কালচারের হোতারা ওরাল পরীক্ষায় মেয়েদের প্রশ্ন করে-কি ক্রিম লাগাও ঠোঁটে? শুকনো কেন ঠোঁট? স্বাভাবিকতার সব হিসাব-নিকাশ উলটে দিয়ে তোলাবাজ এই ডাক্তারদের বিলাসবহুল জীবন, হাতে সেডান বা আপেল ঘড়ি। লেটেস্ট ভার্সনের আইফোনের মডেল। শেয়ারে লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ। ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাট। গ্যারেজে আধা কোটির গাড়ি। এসব কথা কেউ কেউ বললে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এ বলে তুই আর জি কর, ও বলে তুই হাথরস বা বদলপুর। নারদার টাকা নিয়ে এ দল থেকে ও দলে যাওয়া নেতা কি করেই বা দুর্নীতির প্রকৃত প্রতিবাদ করতে পারেন? এসব কিছু ধরা পড়েছে ছড়ার মতো অন্তমিল থাকা স্লোগানে। জন্ম নিচ্ছে নতুন নতুন স্লোগান। কান টানলে মাথা আসে, মাথা টানলে পা/ পায়ের তলায় লেখা ছিল, প্রতীক সততা। যে রাজ্যের সব বিধানসভা কেন্দ্রে মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী থাকেন, যে রাজ্যে একটাই পোস্ট, যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সবজান্তা। সে রাজ্যের দুর্নীতির আসল ভাব কোথাব যায় এই রাজ্যের সবাই জানে। সেজন্যেই কুৎসিত মানুষগুলোকে আড়াল করা। আসলে নিজেকে আড়াল করা।
মানুষ সত্যের উৎস সন্ধানে যেতে চাইছে। এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় ধারক সত্য। সত্যের উৎস সন্ধানে আন্দোলনকে বেগবতী করতে হবে। সময়কে অতিক্রমের স্পর্ধা এই আন্দোলনের বড় বৈশিষ্ট্য। একটা গাড়ির পিছনে সদ্য নতুন রঙে লেখা-পারবি তো? হ্যাঁ পারব। আত্মবিশ্বাসের বাতাস বইছে। নব নব আবিষ্কারের আনন্দ এ আন্দোলনের ইতিহাসে। বৃত্ত বড় হচ্ছে। আরও হবে। নতুনদের যুক্ত করার জন্য আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠেছে -আমি তারেই জানি, তারেই জানি/আমায় যে জন আপন জানে।
Comments :0