Lok Sabha Elections 2024

দুই শাসকের প্রচারে একটি শব্দও নেই বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে

রাজ্য জেলা লোকসভা ২০২৪

ইসলমাপুর এলাকায় প্রচারে মহম্মদ সেলিম।

 

চন্দন দাস ও অনির্বাণ দে: ভগবানগোলা

বাইরে তাপমাত্রা চল্লিশ পার। হলকা হাওয়া থেকে বাঁচতে কাপড়ে মুখ ঢেকেছেন বছর তিরিশের সুলেখা বিবি। হাওয়ায়, বাতাসে, আকাশে যেন আগুনের হলকা, বলছেন সুলেখা।
ভগবানগোলার হাবাসপুরে রাস্তার ধারের বাড়িতে দক্ষ আঙুলে সুতোর কারসাজিতে বাঁধা হচ্ছে বিড়ি। মুন্সি বিড়ি নিতে এলে টাকা দেবে। তবেই বাজারহাট হবে। জানাচ্ছেন সুলেখা।
কত টাকা? হাজার বাঁধলে একশো সত্তর। শুকনো মুখে বলছেন।
ব্যস! এটুকুই? জবাব, হ্যাঁ।
সাগরদিঘিতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে এসে অভিষেক ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘‘২৪০ টাকা মজুরি আমি দেড় মাসের মধ্যে করে দেব।’’ দেড় বছর হতে চলল। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপোর সেই কথা ফলেনি। বামপন্থীরা বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি এবং অন্যান্য সুযোগের দাবিতে লাগাতার লড়াই করছেন। মুর্শিদাবাদ কেন্দ্রে কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী মহম্মদ সেলিম। এদিনও তিনি ইসলমাপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচার করেছেন। গ্রামবাসীরা তাঁদের অভিযোগ, সমস্যার কথা জানিয়েছেন। সেখানেও এসেছে বিড়ি শ্রমিকদের সঙ্কটের কথা। মহম্মদ সেলিম বলেছেন, ‘‘সংসদে বামপন্থীরা বিড়ি শ্রমিকদের হকের কথা, রুটি-রুজির কথা তুলে ধরবে। তাঁদের প্রাপ্য আদায় করে আনবে। তৃণমূল-বিজেপি যা করেনি, করবে না।’’
অভাবের সুযোগ নিয়ে বিড়ি শ্রমিকদের দিয়ে অত্যন্ত কম দামে বিড়ি বাঁধাচ্ছেন মালিকরা। “মজুরি চাইলেই বলে, বেশি কথা নয়। বলে,  বিড়ি বাঁধতে হবে না। মাঝে মধ্যে ভাবি, বিড়ি বাঁধা বন্ধ করেই দেব। কিন্তু খাব কী ? বাচ্চাদের বড় করব কীভাবে?” প্রশ্ন সুলেখা বিবির। প্রতিবেশী প্রতিভা বিবি বারবার মুন্সিকে বলেছেন মজুরি বাড়ানোর কথা। পঞ্চায়েতের তৃণমূলের মেম্বারদেরও বলেছেন ব্যাপারটা দেখতে। কেউই দেখেননি। তাই বলছেন তাঁরা। মুর্শিদাবাদের প্রায় ১৫ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক কেমন আছেন? তাঁদের ৯৩ শতাংশ মহিলা। খোঁজও রাখে না সরকার।
অবশ্য এই বাক্যে আপত্তি বছর সাতাশের খুশবু মণ্ডলের। কলেজে পড়া সম্পূর্ণ করেছেন খুশবু। টিউশন পড়ান। বিড়ি বাঁধেন। তাতেই চলে মা-মেয়ের সংসার। শনিবার মুর্শিদাবাদে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মন দিয়ে সেই ভাষণ শুনেছেন খুশবু। মুখ্যমন্ত্রীর কথা শুনে খুশবু বলছেন, “উনি রাজ্যের মাথা। ওনার দলের নেতাদেরই বিড়ির ব্যবসা। উনি জানেন না, এটা হতে পারে না। মিথ্যা বলছেন।’’
কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী?
সুতি, হরিহরপাড়ায় মমতা বন্দোপাধ্যায় বলেছেন, বিড়ি শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষায় নথিভুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। বিড়ি শ্রমিকরা না কি অনেক সুবিধা পাচ্ছেন। মুর্শিদাবাদ লোকসভার হরিহরপাড়ার সভা থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “বিড়ি শ্রমিকদের জন্য শ্রম দপ্তর থেকে সামাজিক সুরক্ষা কার্ড করেছি। মেয়ের বিয়ের টাকা, অক্ষম হলে টাকা, অসুস্থ হলে টাকা নিতে পারে।’’
রাজ্য সরকারের সামাজিক সুরক্ষা যোজনা থেকে শুধুমাত্র ৬০ বছরের পর এককালীন অর্থ পাওয়া যায়। শ্রমিকদের মেয়ের বিয়ের জন্য বা অসুস্থ হলে কোনও টাকাই পাওয়া যায় না। এই প্রকল্প ২০১১ সালের আগে থেকেই ‘অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য রাজ্য সরকারের সাহায্যপ্রাপ্ত ভবিষ্যনিধি প্রকল্প’ নামে চালু ছিল। মুখ্যমন্ত্রী শুধু নাম বদলেছেন। বরং বিড়ি শ্রমিকদের জন্য যে ওয়েলফেয়ার স্কিম চালু ছিল, কেন্দ্র আর রাজ্য সরকারের নীতিতে তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। 
রবিবার জলঙ্গীতে এসে একইরকম মিথ্যাচার করেছেন বিজেপি’র রাজনাথ সিংহও। তিনি বলেছেন, “বিড়ি শ্রমিকদের জন্য শ্রমিক কল্যাণ যোজনা চালাচ্ছে সরকার। দেশের ৫০ লক্ষ বিড়ি শ্রমিক। স্বাস্থ্য, আবাসের সুবিধা  দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।’’ কিন্তু শ্রমিকরা বেশ কয়েক বছর ধরে গৃহনির্মাণের জন্য কোনও অর্থ পাননি। বন্ধ হয়েছে বিড়ি শ্রমিকদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার স্কলারশিপও।
সিঙ্গুরে শিল্প আটকানোর মঞ্চে মমতা ব্যানার্জির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বিজেপি’র প্রতিনিধি রাজনাথ সিং। তাঁদের দু’জনের অবস্থানের মিল এবার পাচ্ছেন ভগবানগোলা, জিয়াগঞ্জ, জলঙ্গীর বিড়ি শ্রমিকরা। কেউই বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি।
বিড়ি শ্রমিকদের মজুরি আসলে কত? এই প্রশ্নটাই কোটি টাকার।
রাজ্যে সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ঠিক করে রাজ্য সরকারের শ্রম দপ্তর। ২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর  রাজ্যের তৎকালীন জয়েন্ট লেবার কমিশনার (পি)-এর স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, এক হাজার বিড়ি বেঁধে মুর্শিদাবাদ জেলার শ্রমিকদের পাওয়ার কথা ২৭৬ টাকা ৪৪ পয়সা। এটা সরকার ঘোষিত নূন্যতম মজুরি।
তবে এই মজুরি বাড়েনি তারপর। রাজ্য সরকারের পরবর্তী ন্যূনতম মজুরির তালিকায় নেই বিড়ি শ্রমিকদের উল্লেখও। শেষ ঘোষিত মজুরি কার্যকর করতে কোনও উদ্যোগ নেয়নি সরকার। বিড়ি শ্রমিকদের সংগঠন এবং বিড়ি মালিকদের মধ্যে যৌথ চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে ঠিক হয় শ্রমিকদের মজুরি। ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর অরঙ্গাবাদ বিড়ি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের কনফারেন্স হলে শেষ বারের মতো মজুরি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রায় ৩ বছর পর সেবার মজুরি বাড়ে মাত্র ২৬ টাকা। হাজার বিড়ি পিছু মজুরি ঠিক হয় ১৭৮ টাকা।
সেই মজুরিও সব শ্রমিক পাচ্ছেন না। চুক্তিতেই লেখা ছিল, ওই চুক্তি ‘অন্তর্বতীকালীন’। তারপর বারবার মজুরি চুক্তি নিয়ে বৈঠকের দাবি জানিয়েছেন শ্রমিকরা। তবে কর্ণপাত করেনি মালিকপক্ষ। শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন কি না, তা দেখার জন্য রয়েছে রাজ্য সরকারের শ্রম দপ্তর। তবে বিড়ি শ্রমিকদের মজুরির প্রশ্নে মালিকদের পক্ষেই রাজ্য সরকারও।
বিড়ি শ্রমিকদের অভিজ্ঞতা, মালিকদের রাজনৈতিক পরিচয়েই রয়েছে মালিকদের শক্তি।
মুর্শিদাবাদ জেলায় তৃণমূলের দু’টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এর মধ্যে জঙ্গিপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি খলিলুর রহমান এবং চেয়ারম্যান জাকির হোসেন দু’জনেই বিড়ি মালিক। শুভেন্দু অধিকারীর হাত ধরে রাজনীতিতে এসে ২০১৯ সালে জঙ্গিপুরে প্রার্থী হয়েছিলেন খলিলুর রহমান। এবারও তিনিই প্রার্থী। জঙ্গিপুর মহকুমার ৬ বিধায়কের মধ্যে ৩ জনই বিড়ি শিল্পের মালিক। মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সভাধিপতি আসনেও বসানো হয়েছে বিড়ি মালিক পরিবারের রুবিয়া সুলতানাকে। এতে জেলার শ্রমিকদের উপর আরও চেপে বসছে শোষণের যন্ত্র।
তাই জঙ্গিপুর বা মুর্শিদাবাদ— তৃণমূল, বিজেপি’র প্রচার থেকেই উধাও বিড়ি শ্রমিকরা।

Comments :0

Login to leave a comment