একটা দল স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় লুটিয়ে পড়ল! আরেক দল তখন জয়ের বাঁধনছাড়া উদ্যাপনে ব্যস্ত।
ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে ১-০ হারিয়ে ২৩ বছর পর ঐতিহ্যবাহী সতেরোতম ডুরান্ড জয় মোহনবাগান সুপার জায়ান্টের। জয় নিশ্চিত হওয়ার পর সামলানো যায়নি আব্দুল সাহাল সামাদদের। প্রবল উচ্ছ্বাসে দিশাহারা মোহনবাগানের ফুটবলাররা। দশজনে খেলে জিতে, আনন্দের মাত্রাটা বেড়ে গিয়েছিল তাঁদের। একে অপরকে জড়িয়ে ধরা, পিঠ চাপড়ে দেওয়া। সমর্থকদের সামনে গিয়ে ভাইকিং ক্ল্যাপস। ট্রফি নিয়ে সেলিব্রেশন। সবই চলল! কিছুই বাকি রাখলেন না জেসন কামিন্স, আর্মান্দো সাদিকুরা। আনোয়ার আলি ভাষা হারালেন মোহনবাগানের জার্সি গায়ে প্রথম ট্রফি জিতে। আইএসএল জেতানোর পর, ফাইনালের নায়ক দিমিত্রি পেত্রাটোস। ট্রফি হাতে ফেন্সিংয়ের সামনে গিয়ে মেরিনার্সদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলেন। বললেন, ‘মোহনবাগান সমর্থকদের এই আনন্দের মুহূর্তটাই উপহার দিতে চেয়েছিলাম।’
জবাব দেওয়ার ম্যাচ ও ডুরান্ড জয়ের স্বাদ পেল সমর্থকরা। স্টেডিয়াম লাগোয়া এলাকা দখলে যায় বাগানের। বাইপাস রীতিমতো কাঁপল ‘জয় মোহনবাগান, জয় মোহনবাগান’ স্লোগানে। অন্যদিকে, টিপ্পনী শুনেও শান্ত থাকলেন ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা। হারের হতাশায় মুখ বুজেই মাঠ ছাড়লেন, তাঁরা। একটা ভুল। কয়েক মুহূর্তের আত্মতুষ্টিতে স্বপ্নপূরণ হলো না তাঁদের। এদিন পেত্রাটোসের বাঁ-পা ও বিশাল কাইথের দস্তানার কাছেই পরাস্ত ইস্টবেঙ্গল। সর্বভারতীয় ট্রফি জয়ের খরা কাটল না লাল হলুদের। ম্যাচ শেষে হরমনজোৎ খাবরাদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে সান্ত্বনা দিলেন মোহনবাগানের ফুটবলাররা। যে বড় ম্যাচ নিয়ে, সমর্থকদের এত রেষারেষি, শুভাশিস বসুদের এই স্পিরিট প্রশংসনীয়। ওই একটা মুহূর্ত বহুদিন ফুটবল প্রেমী মানুষদের মনে থেকে যাবে।
রবিবাসরীয় দুপুর। ১৯ বছর পর কোনও সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতার ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল দু’দল। শহরের সমস্ত রাস্তা মিশেছিল যুবভারতীতে। উন্মাদনা টের পাওয়া যাচ্ছিল, বিধাননগর স্টেশন চত্বর থেকেই। উৎসবের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বনের একটা অংশ বড় ম্যাচ। টিকিটের চাহিদা ছিল মারাত্মক। ব্ল্যাকারদের থেকেও বেশি দাম দিয়ে, ফুটবলপিপাসুরা ম্যাচ দেখার লাইসেন্স নিয়ে মাঠে ঢুকলেন। কেউ কেউ চেষ্টা করলেন, বিনা টিকিটে মাঠে ঢুকতে। যারা ধরা পড়লেন, তাঁরা গ্রেপ্তার হন। গ্যালারি পুরো না ভরলেও, পরিপূর্ণ ছিল। মাঠে বল গড়ানোর শুরু থেকেই ৫০ হাজার সমর্থকদের হইহই চিৎকার। গর্জন একে অপরকে দেখে নেওয়ার হুঙ্কার, খোঁচা।
এদিন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল দু’দলই একাদশে পরিবর্তন করে। জুয়ান বসান জেসন কামিন্সকে। আক্রমণভাগে দিমিত্রির সঙ্গে জুড়ে দেন আর্মান্দো সাদিকুকে। একটু পিছন থেকে অপারেট করার কাজটা ছিল হুগো বুমোসের উপর। মাঝমাঠে সাহাল, অনিরুদ্ধ। ইস্টবেঙ্গল কোচ কুয়াদ্রাত নিশু কুমারকে না খেলিয়ে ডানদিকটা সচল রাখার জন্য খেলান মহম্মদ রাকিপকে।
প্রথমার্ধ জুড়ে তুল্যমূল্য লড়াই। তাতে যদিও গোলের দেখা মেলেনি। শুরুর ১৫ মিনিট দাপট ছিল মোহনবাগানের। মূলত বাঁ প্রান্ত দিয়ে আক্রমণে উঠছিলেন আশিক, সাহালরা। তবে তখন গোলের কোনও পজিটিভ সুযোগ তৈরি হয়নি। বাগানের প্রথম ঝাপটা সামলে খেলায় ফেরে ইস্টবেঙ্গল। ম্যাচের ৩০ মিনিটে প্রথম গোলের সুযোগ। সিভেরিওর সঙ্গে ওয়াল খেলে গোলে শট নেন নন্দকুমার। কিন্তু তালুবন্দি করেন বিশাল কাইথ। ম্যাচের ৩৫ মিনিটে গোড়ালিতে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন এলসি। তবে তার ফায়দা তুলতে পারেনি বাগান। প্রথমার্ধে জোড়া গোলের সুযোগ পায় ফেরান্দোর দল। ৩৭ মিনিটে মিস চাহালের। বিরতির ঠিক আগে, পেত্রাটোসের প্রয়াস অল্পের জন্য বারের উপর দিয়ে চলে যায়। তাঁর আগে, ৪৪ মিনিটে সিভেরিও বলে মাথা ছোঁয়াতে না পারলেও, ভলি মারার সুযোগ পেয়েছিলেন গত ডার্বির নায়ক নন্দকুমার। বল পোস্টের উপর দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে ম্যাচের সহজতম সুযোগ নষ্ট করেন।
দ্বিতীয়ার্ধে যেন নাটকে মোড়া। ৬১ মিনিটে সিভেরিওকে অযাচিত এবং বিপজ্জনক ফাউল করে, লাল কার্ড দেখে মাঠ ছাড়েন অনিরুদ্ধ। তাতে মোহনবাগান দশজনে পরিণত হয়। গর্জন থেমে যায় মোহনবাগান গ্যালারির। উচ্ছ্বাসে ফেটে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা। কিন্তু তাঁদের ফুটবলাররা শেষ আধঘন্টা দশজনের বাগানকে পেয়েও কাজের কাজটা করতে পারেনি। একজন কম নিয়েও খেলেও যেটা করে দেখাল জুয়ানের দল। বাগানের তিনটি পরিবর্তনেই ম্যাচ ঘুরে যায়, তিনি কুয়াদ্রাতের পরিবর্তন দেখে, নামিয়ে দেন কামিন্স, গ্লেন ও লিস্টনকে।
দু’মিনিটের মধ্যে কাঙ্ক্ষিত গোল পেয়ে যায় তাঁরা। ম্যাচের ৭১ মিনিট তখন। প্রায় মাঝমাঠ থেকে একাই বল টেনে নিয়ে যান পেত্রাটোস, তাঁকে এগিয়ে আসতে দেখেও, কোনও ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলার বাধা দেননি। ডি বক্সের কাছে আসতেই নিলেন গোলমুখী শট। সিভেরিও ও পার্ডোর মাঝখান থেকে বল চলে যায় গোলের ভেতর। তবে পার্ডোর পায়ে লেগে বল দিক পরিবর্তন দিক করে, ডানদিকে ঝাঁপিয়ে পড়েও ধরে পারেননি প্রভসুখন গিল। ১-০ এগিয়ে যায় মোহনবাগান বিলবোর্ড টপকে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে মোহন গ্যালারি সামনে চলে যান অস্ট্রেলিয়ার ফুটবলাররটি। ম্যাচ শেষে বলেই ফেললেন, গোলের পর নিজের আবেগ সামলাতে পারেননি। বাকি সময়ে চেষ্টা করেও, গোলের দেখা পায়নি ইস্টবেঙ্গল। বিপক্ষের থেকে বল পজেশন ও গোলে শট বেশি নিয়েও আটকে গেল লাল হলুদ। নিভলো মশাল।
Durand Cup final
জবাব দিয়ে ডুরান্ড জয় মোহনবাগানের
×
Comments :0