Myanmar Earthquake

বার্মায় উদ্ধার অন্তঃসত্ত্বা সহ জীবিত চার, মৃত বেড়ে ২ হাজার

আন্তর্জাতিক

সোমবার বার্মার স্থানীয় সময় সকাল সোয়া সাতটা নাগাদ উদ্ধারকারী দল ২৯ বছর বয়সী মহিলাকে উদ্ধার করেন, যিনি ৬৫ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে ছিলেন। উদ্ধারের সময় মেয়েটির শারীরিক অবস্থা ভালো ছিল। এদিন মধ্যরাতে পাঁচ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে উদ্ধার অভিযানের পর, চীনের উদ্ধারকারী দল বার্মার মান্দালয়ের গ্রেট ওয়াল হোটেলে একজন চাপা পড়া ব্যক্তিকে উদ্ধার করে। তিনি প্রায় ৬০ ঘন্টা ধরে আটকা পড়ে ছিলেন। তিনিই চীনের উদ্ধারকারী দলের উদ্ধার করা প্রথম মানুষ। এরপর চীনের উদ্ধারকারী দল ৬০ ঘন্টা ধরে চাপা পড়া একটি শিশুকে উদ্ধার করেছে এবং তারপর একজন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে উদ্ধার করেছে। বার্মায় অবস্থিত চীনা দূতাবাস এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছে, ভূমিকম্পের প্রায় ৬০ ঘন্টা পর মান্দালয়ের গ্রেট ওয়াল হোটেলের ধ্বংসস্তূপ থেকে এক মহিলাকে উদ্ধার করেছে একটি উদ্ধারকারী দল। তার অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানা গেছে।
রবিবার পর্যন্ত বার্মায় ভূমিকম্পে ১৭০০জন নিহত, ৩৪০০জন আহত এবং প্রায় ৩০০জন নিখোঁজ রয়েছে বলে জানানো হয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এদিন বার্মায় চীনের দূতাবাস নিশ্চিত করেছে যে, ভূমিকম্পে ১৪ জন চীনে নাগরিক আহত হয়েছেন। তবে সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে দু’হাজার পেরিয়ে গিয়েছে মৃতের সংখ্যা।
পচাগলা দেহের বীভৎস দুর্গন্ধে ছেয়ে গিয়েছে তছনছ হয়ে যাওয়া মান্দালয় শহরের অলিগলি, রাস্তাঘাট। মার্চ মাসের শেষ রবিবার মধ্য বার্মার এই শহরে তাপমাত্রা ছিল ৪১ ডিগ্রি। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মধ্যে কোদাল, গাইতি, শাবল হাতে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে শয়ে শয়ে টন পাথরের চাঁই পরিষ্কার করে চলেছেন হাজার হাজার মানুষ। জুন্টা প্রশাসনের সরকারি সাহায্য এসে পৌঁছাচ্ছে না। পৌঁছালেও তা যাচ্ছে সরকারি দপ্তরের কোষাগারে, কিংবা ব্যয় হচ্ছে প্রভাবশালীদের ক্ষতিপূরণ দিতে। স্থানীয় পৌর বিভাগ গোটা কয়েক এক্সক্যাভেটর ও ভারী যন্ত্রপাতি মোতয়েন করলেও তার ভরসায় মানুষ বসে নেই। হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে খোঁজার তাগিদে খিদে, ক্লান্তি, ঘুম ভুলে হাত দিয়েই ভারী ভারী পাথরের টুকরো সরানোর কাজে নেমেছেন মান্দালয়ের হাজার হাজার মানুষ এবং কয়েক দল স্বেচ্ছাসেবী।
দু’দিন আগে সর্বস্ব হারিয়ে, শহরের রাস্তা ও ফুটপাতেই অস্থায়ী বাসস্থান তৈরি করে থাকছেন মান্দালয়ের ১৫ লক্ষ বাসিন্দা। রবিবার পর্যন্ত দেশের ১৬৪৪ জনকে হারিয়ে বার্মার সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা এবং হতাশা স্পষ্ট। ধ্বংসস্তূপের তলায় চাপা পড়ে নিখোঁজ রয়েছেন আরও হাজার হাজার মানুষ। তাদের উদ্ধার করা হলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়বে। ‘‘মিনিট খানেকের এক ভূমিকম্পে বার্মা যেন তিন দশক পিছিয়ে গিয়েছে,’’ মন্তব্য করেছেন এদেশের এক সাংবাদিক। ফলে বিপর্যয় কাটিয়ে দেশে আদৌ কোনও দিন স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরবে কি না, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। 
ভূমিকম্পে রাস্তাঘাট, নদী সেতু ও পরিবহণ ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ফলে বড় শহরগুলির বাইরে যে সমস্ত বিপর্যস্ত এলাকা রয়েছে, সেখানে ত্রাণ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। তারই সঙ্গে দেশ জুড়ে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি থাকায় ত্রাণ সরবরাহ ও জরুরি উদ্ধারকাজে বড় রকমের সমস্যা তৈরি হয়েছে। বিদ্রোহীদের দখলে থাকা এলাকাগুলিতে ক্ষয়ক্ষতি কিংবা হতাহতের কোনও হিসেব এখনও মিলছে না। মান্দালয়ে উদ্ধারকাজের সঙ্গে যুক্ত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান কারা ব্রাগ রবিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘‘হাজার হাজার আহত মানুষের ভিড় সামলাতে গিয়ে হাসপাতাল ও বিভিন্ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভয়ঙ্কর অবস্থা। সাধারণ ওষুধপত্রও মিলছে না। খাবার ও পানীয় জলের অভাব রয়েছে।’’   
এরই মধ্যে বার্মার জুন্টা প্রশাসনের তরফে উদ্ধারকাজে টালবাহানা ও গাফিলতির পাশাপাশি দেদার দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ উঠেছে। ভয়াবহ সঙ্কটের পরিস্থিতিতেও বার্মার জুন্টা প্রশাসন শুধুমাত্র সরকারি দপ্তর কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের উদ্ধার ও পুনর্বাসনে সাহায্য করছে বলে অভিযোগ উঠেছে নানা মহল থেকে। ফলে সাধারণ মানুষকে উদ্ধারে সরকারি সাহায্য এসে পৌঁছাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে সরকারের উপর ভরসা হারিয়ে, নিজেদের উদ্যোগে উদ্ধারকাজে নেমেছেন হাজার হাজার মানুষ। 
ভূমিকম্পে বাসস্থান, রুটি-রুজি, যোগাযোগ ও পরিবহণ ব্যবস্থার যাবতীয় উপাদান তছনছ হয়ে গিয়েছে। ঘরছাড়া হয়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তবে এর মধ্যেও গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যা অব্যাহত রেখেছে বার্মার জুন্টা প্রশাসন। রবিবার বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ ভূমিকম্পে বিপর্যস্ত শান প্রদেশে বিরোধীদের দখলে থাকা নাউঙচো অঞ্চলে বিমান হানা চালায় জুন্টার সেনাবাহিনী। এই হানায় অন্তত সাত জনের মৃত্যু হয়। সঙ্কটের এই পরিস্থিতিতেও দেশের ‘স্বীকৃত’ সরকারের এমন বর্বরোচিত আচরণে নিন্দার ঝড় উঠেছে গোটা বিশ্বে। নিন্দায় সরব হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। 
শুক্রবার থেকে শনিবারের মধ্যে বার্মার একাধিক অঞ্চলে অন্তত ১৫ বার ছোট ও বড় কম্পন অনুভূত হয়। রবিবার দুপুরেও মান্দালয়ে ৫.১ তীব্রতায় অনুকম্পন অনুভূত হয়েছে। এতে শহরে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলেও কোনও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেনি। এরই মধ্যে দেশি-বিদেশি উদ্ধারকারী দল অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিখোঁজদের উদ্ধার ও আহতদের প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ভারত, চীন, বাংলাদেশ, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ও ব্রিটেনের মতো বিভিন্ন দেশ। তবে ভূমিকম্পে মান্দালয় বিমানবন্দর কার্যত তছনছ হয়ে যাওয়ায় বিদেশ থেকে ত্রাণ সামগ্রী বোঝাই বিমান এসে পৌঁছাতে পারছে না। শুক্রবারের প্রবল কম্পনে রাজধানী নায়প্যিদার বিমানবন্দরের কেন্দ্রীয় বিমান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রটি ধসে পড়ে। ফলে গোটা দেশেই অসামরিক বিমান পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।  শনিবার ভারতীয় বায়ু সেনার দু’টি ত্রাণ বোঝাই সি-১৭ বিমান রাজধানী নায়প্যিদায় এসে নেমেছে। ভারত থেকে ১২০ জনের এক উদ্ধারকারী দল ও সেনাবাহিনীতে কর্মরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য কর্মীদের একটি দল বার্মায় এসে পৌঁছেছে। অপারেশান ব্রহ্মার নামে কয়েক টন খাবার, জরুরি ওষুধপত্র, তাঁবু পাঠিয়েছে ভারত। বিমান ও নৌজাহাজে করে রবিবার পর্যন্ত বার্মায় মোট ১৩৭ টন ত্রাণ সামগ্রী পাঠানো হয়েছে। রবিবার মান্দালয়ে ১৭টি ত্রাণ বোঝাই ট্রাক, ১৩৫ জনের উদ্ধারকারী দল ও ১.৩৮ কোটি ডলার মূল্যের অর্থসাহায্য পাঠিয়েছে চীন। রাশিয়ার থেকেও ১২০ জনের এক উদ্ধারকারী দল পাঠানো হয়েছে। বার্মায় সাহায্য পাঠাতে তৎপর হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের একাধিক সংস্থা। 
অন্যদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্ককে নিখোঁজ বেশ কয়েক জনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। ফলে ওই দেশে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১৮ হয়েছে। এর মধ্যে ১১ জনের মৃত্যু হয়েছে রাজধানী ব্যাঙ্ককে। শুক্রবার ব্যাঙ্ককের চাটুচক বাজারে ধসে পড়া ৩০ তলার নির্মীয়মাণ ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকা শ্রমিকদের বেশির ভাগেরই মৃত্যু হয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রবিবার ব্যাঙ্কক পুলিশ সূত্রে এমনই জানা গিয়েছে। এই ঘটনার ৪৮ ঘণ্টা পরেও অন্তত ৫০ জন ওই ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে রয়েছেন বলে অনুমান করা হচ্ছে। তবে সময় যত এগচ্ছে, তাঁদের জীবিত উদ্ধার করার সম্ভাবনা তত ক্ষীণ হচ্ছে। 
শুক্রবার নির্মীয়মাণ এই বহুতলটি ভেঙে পড়ার সময়েই ১০ জনের মৃত্যু হয়। রবিবার বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার সূত্রে শুক্রবার থেকে থাইল্যান্ডে মোট ১৮ জনের দেহ উদ্ধার হয়েছে বলে জানা যায়। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে ৩২ জন। অন্তত ৫০ জন ব্যাঙ্ককের ওই নির্মীয়মাণ বহুতলের ধ্বংসস্তূপের তলায় আটকে থাকার দরুণ নিখোঁজ। তাঁদের মধ্যে প্রায় সবাই সেখানে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ব্যাঙ্ককের ডেপুটি গভর্নর তাইডা কামোলভেজ সংবাদমাধ্যম বিবিসি-কে জানিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপের ভিতর থেকে উদ্ধারের কাজ কিছুটা কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, ৩০ তলার ধ্বংসস্তূপ সেখানে জড়ো হয়ে রয়েছে। তবে উদ্ধারকারী দল এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্যাঙ্ককের ডেপুটি গভর্নর জানিয়েছেন, তিনি এখনও উদ্ধার অভিযানের বিষয়ে আশাবাদী। 
শুক্রবারের নামাজের সময় বার্মায় ভূমিকম্পে ৭০০ জনেরও বেশি মুসলিম নিহত হয়েছেন। বার্মার একটি মুসলিম সংগঠন জানিয়েছে যে পবিত্র রমজান মাসে শুক্রবারের নামাজের সময় দেশটিতে ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ৭০০ জনেরও বেশি মুসলিম নিহত হয়েছেন। স্প্রিং রেভোলিউশন মায়ানমার মুসলিম নেটওয়ার্কের স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য তুন চি সোমবার বলেছেন যে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের কাছে ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রায় ৬০টি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। মসজিদে নিহতদের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ভূমিকম্পে নিহত দুই হাজারের জনেরও বেশি মানুষের সরকারি সংখ্যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত কিনা তা তাৎক্ষণিকভাবে স্পষ্ট নয়।

Comments :0

Login to leave a comment