Midnapore Hospital

মেদিনীপুরে জাল স্যালাইনে মৃত্যু এক প্রসূতির, কোমায় ৩

রাজ্য জেলা

পরিবার পরিজনরা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন সিসিইউ’র সামনে।

চিন্ময় কর: মেদিনীপুর

ভেজাল স্যালাইনে মৃত্যু এক প্রসূতির! মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এই প্রসূতি মৃত্যুর নেপথ্যে কালো তালিকাভুক্ত সংস্থার স্যালাইনকেই দায়ী করা হচ্ছে। গত এক বছর আগে কালো তালিকাভুক্ত হওয়া ওই সংস্থার ফের সরকারি হাসপাতালে বরাত পাওয়ার পিছনে কি সেই নর্থ বেঙ্গল চক্র, এমনই অভিযোগ উঠে এল প্রসূতি মৃত্যুকে ঘিরে। তাঁকে যে স্যালাইন দেওয়া হয়েছিল তাতে ছত্রাকের মতো কিছু ভাসতে দেখা যায় বলে অভিযোগ। ওই ভেজাল স্যালাইনের জেরে আরও ৩ প্রসূতির অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গিয়েছে।

এই ঘটনার প্রতিবাদে শুক্রবার বিকালে এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে ডেপুটেশন কর্মসূচি নেওয়া হয়। তবে তাঁদের সময় দিয়েও আধিকারিকরা এর অনেক আগেই দপ্তরে তালা চাবি লাগিয়ে গা ঢাকা দেন বলে অভিযোগ। শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত প্রশাসনিক দপ্তরগুলির সামনে ছাত্র যুব মহিলাদের বিক্ষোভ অবস্থান চলেছে। 

বৃহস্পতিবার মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরকারি স্যালাইনে একের পর এক প্রসূতি অসুস্থ হওয়ার ঘটনায় ৫ জনকে তড়িঘড়ি আইসিইউ এবং সিসিইউ-তে স্থানান্তরিত করা হয়। এই ঘটনায় তুমুল বিক্ষোভে দেখান পরিবার পরিজনরা। শুক্রবার সেই ৫ জন প্রসূতির মধ্যে এক জনের মৃত্যু হয় এবং ৩ জন কোমায় চলে গিয়েছেন। 

ঘটনায় মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে তুমুল বিক্ষোভ শুরু হয়। মুহূর্তে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। অন্যদিকে প্রসূতি বিভাগ মাতৃমা ভবন সহ আইসিইউ’র সামনে পরিবার পরিজনদের কান্নার রোল পড়ে যায়, হাহাকার করতে থাকেন পরিবারের সদস্যরা। তা সামাল দিতে বিশাল পুলিশ বাহিনী সহ র্যােফ নামানো হয়। তাতেও বিক্ষোভ থামেনি। তড়িঘড়ি তদন্ত কমিটি ঘোষণা করে দায় এড়ানোর চেষ্টা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

বিক্ষোভকারী এবং অসুস্থ পরিবারের সদস্যদের ক্ষোভ, ‘‘কী আর তদন্ত হবে! তিলোত্তমা’র ঘটনায় জড়িতদের আড়াল করা হয়েছে। আর জি কর হাসপাতালে সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলায় কর্মরত মহিলা চিকিৎসককেই ধর্ষণ করে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। সেই তথ্য লোপাট করে যে সরকার ও তার প্রশাসন, সেই প্রশাসন ভেজাল স্যালাইনে এক জন গরিব পরিবারের রোগীর মৃত্যুতে ন্যায় বিচার দেবে, তা আশা করা যায় না।

মৃত প্রসূতি মায়ের নাম মামনি রুইদাস, বাড়ি গড়বেতা থানা এলাকায়। বুধবার ভোর রাতে অস্ত্রোপচারে পুত্রসন্তান জন্মানোর পর তাঁকে শয্যায় দেওয়া হয়। বৃহস্পতিবার স্যালাইন দেওয়ার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটি নির্দিষ্ট ব্যাচের স্যালাইনে একের পর এক প্রসূতির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। তার মধ্যে ৫ জনকে তড়িঘড়ি আইসিইউ এবং সিসিইউ-তে স্থানান্তরিত করা হয় ওই দিন সন্ধ্যায়। তাঁদের মধ্যে মামণি রুইদাসের মৃত্যু হয় শুক্রবার। আরও ৩ জন কোমায় আচ্ছন্ন। এছাড়া আরও ৪৯ জন অসুস্থ হয়েছেন।

প্রাথমিকভাবে মেয়াদ উত্তীর্ণ স্যালাইনের অভিযোগ উঠলেও প্রকৃত তথ্য উঠে আসে বিক্ষোভের পর। ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে তৈরি স্যালাইন বোতলে ২০২৬-এর জুলাই পর্যন্ত ব্যবহারের মেয়াদ উল্লেখ করা আছে। কিন্তু স্যালাইনের বোতলের ভিতরে ছত্রাকের মতো কিছু ভাসছে, তা স্পষ্টই দেখা গিয়েছে। এ নিয়ে তীব্র আলোড়ন হয় হাসপাতাল ক্যাম্পাসে। খবর পৌঁছায় স্বাস্থ্য দপ্তরেও। মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এমন ঘটনায় উঠে আসে শিলিগুড়ির সংস্থা ‘পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালস’-এর সরবরাহ করা ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ (স্যালাইন) এর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার কথা। চিকিৎসকদের তরফে জানা গিয়েছে, এর আগে বারুইপুর মহকুমা হাসপাতালেও ওই সংস্থার তৈরি রিঙ্গার্স ল্যাকটেট নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল। ড্রাগ কন্ট্রোল বিভাগ থেকে গত ১০ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ, তা সত্বেও তৃণমূল সরকারের বদান্যতায় খোদ মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রীর নিজের বিভাগের ছাড়পত্রে সেই সংস্থার স্যালাইন সহ ১৪টি নিম্নমানের ও ভেজাল ওষুধ সরকারি হাসপাতালে একছত্র আধিপত্য নিয়ে কারবার চালিয়ে যাচ্ছে। 

স্বাস্থ্য দপ্তর ভেজাল ওষুধের ঘটনায় তড়িঘড়ি সমস্ত সরকারি হাসপাতালকে ওই সংস্থার তৈরি নির্দিষ্ট ব্যাচ নম্বরের রিঙ্গার্স ল্যাকটেট সহ মোট ১৪ ধরনের ওষুধ ও স্যালাইন ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে। জন বিক্ষোভের আঁচ পেয়ে তদন্তের জন্য স্বাস্থ্য দপ্তর এবং ড্রাগ কন্ট্রোল থেকে গঠিত হয়েছে দু’টি পৃথক তদন্ত কমিটি।

গত বছর নভেম্বর মাসে কর্নাটকের বেল্লারি জেলা হাসপাতালে চার প্রসূতির অস্ত্রোপচারের পর মৃত্যুর ঘটনার তদন্তেও উঠে এসেছিল ‘পশ্চিমবঙ্গ ফার্মাসিউটিক্যালস’-এর নাম। ওই হাসপাতালে ‘রিঙ্গার্স ল্যাকটেট’ সরবরাহ করত পশ্চিমবঙ্গের এই সংস্থা। বিভিন্ন পরীক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় গত মাসেই কর্নাটক সরকার কালো তালিকাভুক্ত করেছিল শিলিগুড়ির এই সংস্থাকে। এ বার মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রসূতি মৃত্যুর ঘটনাতেও ওই সংস্থার তৈরি করা রিঙ্গার্স ল্যাকটেটের বিরূপ প্রতিক্রিয়াই দায়ী, এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছে চিকিৎসক মহলও। এই প্রসঙ্গে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর ষড়ঙ্গী বলেন, ‘ড্রাগ কন্ট্রোল নমুনা সংগ্রহ করেছে। কোথা থেকে কী হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সুপার জয়ন্ত রাউত অবশ্য বলেন, ওই প্রসূতিদের চিকিৎসায় কী কী ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছিল তা জানানো হয়েছে স্বাস্থ্য ভবনকে। বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষ। উল্লেখ্য মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিবার পরিজনদের বিক্ষোভ বন্ধ করতে শুক্রবার বিকালে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়েছে ৫ জনের মধ্যে ৪ জন অসুস্থ প্রসূতিকে। 

এদিকে কলকাতায় স্থানান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে মেদিনীপুর মেডিক্যা্ল কলেজের অধ্যক্ষ মৌসমী নন্দী, এমএসভিপি সহ ওয়ার্ড মাস্টারের দপ্তরে তালা পড়েছে। আধিকারিকরা কেউই ক্যাম্পাসে নেই। যতক্ষণ না পর্যন্ত আধিকারিকদের কেউ দপ্তরে এসে ডেপুটেশন নিচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত দপ্তরের সামনে ছাত্র-যুব -মহিলাদের অবস্থান বিক্ষোভ চলবে বলে জানানো হয়েছে সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে।

Comments :0

Login to leave a comment