বিক্রমজিৎ ভট্টাচার্য
গত ১৪ বছরে যখনই রাজ্যের তৃণমূল সরকার কঠিন বিপদে পড়েছে, ত্রাণকর্তা হিসাবে আরএসএস তাদের উদ্ধার করেছে। সারদা কেলেঙ্কারি দিয়ে শুরু করুন, কেন্দ্রীয় এজেন্সি শীতঘুমে । কত গরিব মানুষ তাদের শেষ সঞ্চয় খুইয়ে আত্মহত্যার রাস্তা বেছে নিলেন, উজাড় হলো তাদের পরিবার । তৃণমূলের একসময়ের সাংসদ, অধুনা সবচেয়ে সক্রিয় মুখপাত্র অন ক্যামেরা তৎসহ সিবিআই’র কাছে লিখিত বয়ানে বারবার জানিয়েছেন সারদার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। সারদার টাকা সরাসরি তার বাড়িতে রাখা ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময়ই করে উঠতে পারল না কেন্দ্রীয় এজেন্সি। ঠিক ১২ বছর হলো, এক যুগ । ‘যা গেছে তা গেছে’ সারদা সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর আপ্তবাক্যেই শিলমোহর পড়ল ।
বেশ। এরপর নারদা ঘুষ কেলঙ্কারিতে আসুন, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সংসদের এথিক্স কমিটি মিটিং ডাকার সময়ই পেল না, ঘুষখোর সাংসদরা বহাল তবিয়তে স্বপদে রইলেন। মুখ্যমন্ত্রী বললেন ‘আগে জানলে টিকিট দিতাম না’, কি আশ্চর্য, পরের বারও টিকিট দিলেন। এক্ষেত্রেও সিবিআই সহ কেন্দ্রীয় এজেন্সিরা হা ডু ডু খেলেই চলেছেন, ঠিক ৯ বছর হলো। অভিযুক্তদের মধ্যে দু’জন ইতিমধ্যেই মৃত, তদন্ত কিন্তু চলছে!
বিভিন্নরকম পাচারের কাজে তৃণমূলের সাথে পাল্লা দেওয়ার মতো গোটা পৃথিবীতে কোনও শক্তি নেই । সেটা কয়লা, বালি, পাথর, গোরু যেটাই হোক না কেন। এক্ষেত্রেও কোর্টের নির্দেশে সেই তদন্ত, সেই কেন্দ্রীয় এজেন্সি যুগল। অন্যান্য কেলেঙ্কারির তদন্তের মতো ঠিক এগুলোর অভিমুখও যখন কালীঘাটের বন্দ্যেপাধ্যায় পরিবারের দিকে এগচ্ছে ঠিক তখনই কোনও অজ্ঞাত কারণে তৃণমূলের মেজ বা সেজ কোনও নেতাকে গ্রেপ্তার করে বার্তা দেওয়া হয় এই তো দোষী ধরা পড়েছে। ব্যাপারটা হলো অর্ধেক সত্য, সত্যি প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী চুরি করেছেন, তার বান্ধবীর বাড়ি থেকে ৫০ কোটি টাকা নগদ উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু এর মাথা তো তিনি নন। সত্যি বীরভূমের বাহুবলী মস্তান নেতা গোরু,কয়লা ইত্যাদি পাচারে যুক্ত, কিন্তু এক্ষেত্রেও তো মাথা তিনি নন, এরা মেজ আর সেজ ক্যাটেগরির। হাস্যকরভাবে সিবিআই তাদের চার্জশিটে কখনও লিখছে ‘জনৈক অভিষেক’ ! আবার কোথাকার কোন কালীঘাটের কাকু বলছেন সেই জনৈক অভিষেক ‘রাফলি ১৫ কোটিতে খুশি, লাগলে আরও ১০ দিয়ে দেব’! পেশাদার অপরাধীরাও লজ্জা পায় এদের দেখলে ।
আসল কথা হচ্ছে, পিরমিডের চূড়া অবধি যাতে না যাওয়া হয় সেই রাজনৈতিক নির্দেশ আসে নাগপুর থেকে ভায়া দিল্লি হয়ে এজেন্সির কাছে। বাংলার মানুষ ঠিক এটাকেই ‘সেটিং’ বলে । বিজেপি’র সাথে বোঝাপড়া আছে বলেই তৃণমূল এখনও রাজ্যে ক্ষমতায় আছে ।
আরজি কর হাসপাতালে অন ডিউটি মহিলা চিকিৎসক নৃশংসভাবে খুন ও ধর্ষিতা হলেন, যেটা দেখে শুনে রাজ্য সহ গোটা দেশ শিউরে উঠল, সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠল, সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে এলেন, সেটারও তদন্ত করে কেন্দ্রীয় এজেন্সি এমন রিপোর্ট দিল যাতে বিচারক পর্যন্ত বিস্মিত হলেন। এক্ষেত্রেও সহায় সেই আরএসএস। মোহন ভাগবত নিজে রাজ্যে দাঁড়িয়ে বলে গেছেন রাজ্য সরকারের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখতে হবে। আবার মুখ্যমন্ত্রীর সেই বিচক্ষণ উক্তি ‘উৎসবে ফিরুন’। খুন হওয়া অভয়ার হতভাগ্য বাবা মা এখনও সঠিক বিচারের আশায় এ দরজা ও দরজা ঘুরছেন, ওদের জীবনে আর উৎসব কোনোদিনই আসবে না। অভয়ার দোষ কি ছিল? অভয়া জেনে গেছিল এ রাজ্যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সরকারি দলের নেতাদের মদতে চলা বিপুল আর্থিক দুর্নীতির কথা।
এখন যেটা চর্চায় আছে, সেটা হলো গত ১৪ বছরের তৃণমূলের আরেক বড় কেলেঙ্কারি। টাকার বিনিময়ে রাজ্য জুড়ে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অবৈধ শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ। ১৯৯৭ সালে তৈরি হওয়া স্কুল সার্ভিস কমিশন ২০১১ পর্যন্ত ১৪ বছরে মোট ১২ টি পরীক্ষা নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ করে গেছে। রাজ্যকে ৫ টি অঞ্চলে ভাগ করে ৫ টি জোন অফিস ছিল, হেড অফিস ছিল সল্টলেক। এই ব্যবস্থায় কখনও কোনও বেনিয়ম বা ঘুষের অভিযোগ ওঠেনি। বামফ্রন্ট সরকারের করে যাওয়া পদ্ধতি মেনে শেষ পরীক্ষা নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। খেলা শুরু হলো এরপর থেকেই। জোন অফিসগুলো বন্ধ করে সবকিছু কেন্দ্রীভূত করা হলো সল্টলেক হেড অফিস থেকে। তিন বছর বন্ধ রইল শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা। ২০১৩ থেকে ২০১৬ এই তিন বছরে রাজ্যের স্কুলগুলোতে যেমন লাফিয়ে বাড়তে থাকল শূন্য পদে শিক্ষকের চাহিদা তেমনি তিন বছরে তার দশগুণ লাফিয়ে বাড়তে থাকল মাস্টার্স ডিগ্রি সহ বিএড করে শিক্ষকতার পরীক্ষার অপেক্ষায় বসে থাকা উচ্চ শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। মানুষের বা সমাজের সঙ্কটকে সুযোগে বদলে নেওয়ার দক্ষতা দেখালো দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অপরাধীদের দল তৃণমূল কংগ্রেস। একদিকে এসএসসি পরীক্ষার অফিসিয়াল নোটিফিকেশন হলো, আরেকদিকে দলের নেতামন্ত্রীরা তাদের কিছু চামচেকে দিয়ে আনঅফিসিয়াল নোটিফিকেশন করে চাকরির রেট ধার্য করলেন । বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রতিবেদন ও তদন্তকারী সংস্থার রিপোর্ট পড়ে জানা যায় সর্বনিম্ন রেট কখনই ১০ লক্ষের নিচে নামেনি, সর্বোচ্চ ২০ লক্ষ অবধিও উঠেছে। মোট ২২লক্ষ পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছিলেন ২০১৬-তে, নিয়োগ হয়েছিল ২৬০০০, এই নিয়োগের মধ্যে রয়েছে অসংখ্য টাকা দিয়ে শূন্য পাওয়া, সাদা খাতা জমা দেওয়া, কম নম্বর পাওয়া অর্থাৎ অবৈধ উপায়ে হওয়া শিক্ষক। বৈধ আর অবৈধকে এমন সুন্দর করে এরা গুলিয়ে দিয়েছেন যে সুপ্রিম কোর্টের সামনে আর কোনও উপায় ছিল না পুরো প্যানেল বাতিল করা ছাড়া। একটা শিক্ষিত প্রজন্মকে পরিকল্পনা মাফিক দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে তাদের জীবন এবং তাদের পরিবারকে সর্বোপরি সমাজে ‘শিক্ষা’র মতো গুরত্বপূর্ণ বিষয়কে সরাসরি শেষ করার সাফল্য এক এবং একমাত্র কৃতিত্ব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর, যার অনুপ্রেরণা ছাড়া একটা গাছের পাতাও নড়ে না।
আরএসএস’র দুই টিম বিজেপি ও তৃণমূল। দুই দলের মধ্যে নেতাদের আদান প্রদানও চলে স্পেস এক্স যানের মতো গতিতে। ২০১৬-র শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার সময়ে সবচেয়ে বেশি টাকা খাওয়া হয়েছে নাকি দুই মেদিনীপুর জেলায় আর উত্তরবঙ্গ থেকে। বর্তমান বিজেপি দলের বড় নেতা ও তৎকালীন তৃণমূল সরকারের নম্বর টু মন্ত্রী তখন সেই দায়িত্বে, এই অভিযোগ কে তুলছে, না স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নিজেই। আবার সেই বিরোধী নেতা বলছেন সব হয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে। আসলে দু’জনেই সত্য বলছেন। টাকা ওদের দলই নিয়েছে, আর আজ ওরা সবকিছু গুলিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। সাধারণ মানুষ এইসব দুর্নীতির প্রতিবাদে পথে নামলে এরা একটা নির্দিষ্ট সময় অবধি দেখে নিয়ে মানুষকে ঘুরিয়ে দেয় ধর্মের রাস্তায়, যেটা আরএসএস’র প্রেসক্রিপশন। কারণ এরা জানে যে কোনও প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সংগঠক বামপন্থীরাই , আর তারাই একমাত্র লড়াই চালিয়ে যাবে বাংলার মানুষকে এই দুর্নীতি ও মাফিয়া চক্র থেকে বের করতে।
Comments :0