Rice mill scam

ধান কেনায় বড় দুর্নীতির অভিযোগ

জেলা

ধান নিয়ে অপেক্ষা করে ফিরে গিয়েছে কৃষক। একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে সরকারকে ধান বিক্রি করে গেছেন ‘কৃষক’! কৃষকদের কাছ থেকে বিপুল ধান কেনার সাফল্য দাবি করেও দুর্নীতি এড়াতে পারল না খাদ্য দপ্তর।
ধান কেনার চলতি মরশুমে কৃষকদের কাছ থেকে এখনও পর্যন্ত ৪৭ লক্ষ টন ধান কেনার দাবি করেছে খাদ্য দপ্তর। গত মরশুমের থেকেও ৭ লক্ষ টন বেশি ধান সরকার কিনেছে। কিন্তু কৃষকদের অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ার পর যাচাই করতে গিয়ে খাদ্য দপ্তরের আধিকারিকদের চোখ কপালে ওঠার অবস্থা। 
খাদ্য দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, একই ব্যাক্তি একাধিক অ্যাকাউন্ট নাম্বার ব্যবহার করে ধান বিক্রির টাকা তুলে নিয়েছে। আবার একাধিক ব্যাক্তির খোঁজ পাওয়া গেছে, যিনি একটি মাত্র অ্যাকাউন্ট নাম্বার ব্যবহার করে ধান বিক্রি করছেন। সাধারণ কৃষকের পক্ষে একাধিক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা কার্যত অসম্ভব। আবার সরকারের কাছে একাধিক কৃষক কেবলমাত্র একটি  অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিয়ে ধান বিক্রি করবে সেটাই কষ্টকল্পিত বলে মনে করছে খাদ্য দপ্তর। ফলে চলতি ধান বিক্রির সময় প্রকৃত কৃষককে বাদ দিয়ে রাইস মিল থেকে ফড়েরাই যে রাজত্ব করেছে তা নিশ্চিত। খাদ্য দপ্তরের এক শীর্ষ আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘কৃষকদের ধান বিক্রির টাকার অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখতে গিয়ে দুর্নীতির এই ঘটনাগুলি সামনে এসেছে। যে সব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ধান বিক্রির টাকা গেছে তা ভালো সংখ্যায়। বিপুল টাকার লেনদেন হয়েছে দান বিক্রির মধ্য দিয়ে।’’
রাজ্যের পাঁচ থেকে ছয়টি জেলায় এইভাবে ধান বিক্রির বিপুল টাকা নয়ছয় হয়েছে বলে খাদ্য দপ্তরের আধিকারিকরা জানাচ্ছেন। পরিস্থিতি সামলাতে দুর্নীতির অভিযুক্ত জেলাগুলিকে চিহ্নিত করেছে দপ্তর। কলকাতার খাদ্য ভবন থেকে প্রতিটি জেলার জন্য তদন্তকারী দল তৈরি করে পাঠানো হচ্ছে। সূত্রের খবর, মুর্শিদাবাদ ও জলপাইগুড়ি জেলাতে ইতিমধ্যেই খাদ্য দপ্তরের টিম রওনা হয়েছে। জেলা ঘুরে রিপোর্ট সংগ্রহ করে খাদ্য দপ্তরে জমা দিতে বলা হয়েছে।
ঘটনা হলো, কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার টাকা জোগায় কেন্দ্রীয় সরকার। এমনিতেই দুর্নীতির অভিযোগে ১০০দিনের কাজ, আবাস যোজনার টাকা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। এরপর ধান কেনাতেও দুর্নীতির অভিযোগে টাকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দপ্তরের আধিকারিকরা। ফলে দুর্নীতির হদিশ পাওয়ার পর গোটা বিষয়টি খাদ্য দপ্তরের তরফে চূড়ান্ত গোপন রাখা হয়েছে। 
চলতি বছরে রাজ্যে ৬০ লক্ষ টন ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল রাজ্য সরকার। চলতি মরশুমে ধানের কুইন্টাল পিছু ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ২২৪০টাকা। এরাজ্যে তার সঙ্গে কুইন্টালে মাত্র ২০টাকা সরকার পরিবহণ ভরতুকি দেয়। নভেম্বরের গোড়ায় ধান ওঠার সময় এমএসপি’র বেশ নিচে ছিল ধানের দাম। তখন কৃষক বিক্রি করতে চাইলেও সরকারকে পাশে পায়নি। ফলে কৃষক সরকারের কাছে হয়রানির পর আড়তদারের কাছেই ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কম দামেই ধান বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। চলতি মরশুমে এমনিতেই বর্ষা দেরিতে আসার কারণে একবার ধান রোয়ার পর নষ্ট হয়ে যায় গাছ। ফের নতুন করে ধান বসাতে হয়েছিল। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে উৎপাদনও কম হয়েছে। তার সঙ্গে বেড়ে গেছে উৎপাদন খরচও। তাই সরকারের ভরসায় না থেকে চাষের দেনা মেটাতে গিয়ে আগেই কৃষক আড়তদারের কাছে দান বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু মরশুমের মাঝখানে সরকারি ধান কেনার শিবিরে হু হু করে বাড়তে থাকে কৃষকদের ধান বিক্রি। ৬০ লক্ষ টন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে বর্তমানে ৪৭ লক্ষ টন ধান কেনা হয়ে গেছে। চলতি মরশুমে হয়রানি কমাতে রাজ্যের তরফে কৃষকদের কাছে নতুন অনলাইন ব্যবস্থা চালু করেছিল খাদ্য দপ্তর। ধান বিক্রির জন্য নথিভুক্ত হওয়ার কৃষকরা কবে সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে চায়, তার দিন ঠিক করার জন্য অনলাইন ব্যবস্থা এবার চালু হয়েছিল। অতীতে ধান বিক্রি করতে গিয়ে দিন না পাওয়ার জন্য নতুন এই ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত কৃষকদের কাজে লাগেনি। কৃষকদের ধান বিক্রির জন্য শুরুতে নিজেদের মোবাইল নাম্বার দিয়ে নথিভুক্ত হতে হবে। মোবাইল নাম্বার দেওয়ার পর ‘ওটিপি’ দিয়ে যাচাই করে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পরের ধাপে ধান বিক্রির জন্য অনলাইন ব্যবস্থায় কবে কৃষক ধান বিক্রি করতে চায়, তার দিন নিজেই ঠিক করার কথা বলা হয়েছিল। ভুক্তভোগী কৃষকরা ওই সময় বারে বারে অভিযোগ করেছিলেন, ধান বিক্রি করতে গিয়ে কোনোভাবেই একমাসের আগে দিন পাওয়া যায়নি। 
কেন পাওয়া যায়নি, এখন সেটা পরিষ্কার সামনে আসছে। আসলে এরাজ্যে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার গোটা ব্যবস্থাই কার্যত নিয়ন্ত্রণ করে একাংশ রাইস মিল মালিক ও ফড়েরা। কৃষকদের হঠিয়ে দিয়ে এক ব্যাক্তি একাধিক অ্যাকাউন্ট নাম্বার ব্যবহার করে লুট করে নিয়েছে ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য।
চলতি মরশুমে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনার দুর্নীতি ঠেকাতে বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা চালু করার কথা বলাও হয়েছিল। ধান বিক্রির সময় কৃষকদের আঙুলের ছাপ দিয়ে ধান কেনা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নিয়েও শেষ পর্যন্ত অজানা কারণে তা রূপায়ণ করা হয়নি। এখন দুর্নীতির হদিশ মেলায় আগামী ধান কেনার মরশুমে বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করার কথা ভাবছে খাদ্য দপ্তর। তবে আধিকারিকরাই বলছেন, ‘‘চলতি ব্যবস্থাকে আরও ত্রুটিমুক্ত করার জন্য ধান বিক্রির সময় আঙুলের ছাপ বাধ্যতামূলক করা উচিত। কিন্তু ফড়েদের চাপে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকরী হওয়া মুশকিল।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment