STORY — SANDIP JANA / MUKTADHARA - 30 October

গল্প — লোকোপাইলট / মুক্তধারা

সাহিত্যের পাতা

STORY   SANDIP JANA  MUKTADHARA - 30 October

মুক্তধারা

গল্প

লোকোপাইলট
সন্দীপ জানা

করোনা মহামারির ধাক্কা সামলে সবে ছন্দে ফিরছিল সবকিছু। নিত্য জীবনযাপন,
সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ইত্যাদির ওপর থেকে সরকারি বিধিনিষেধ সবে একটু
শিথিল হয়েছে। মেজোমেসো বললেন, ‘ঝন্টুর বিয়েটা এইবেলা সেরে নেওয়াই ভালো।
আবার কখন কি হয়ে যায়। পাকা সম্বন্ধ ফেলে রাখা ভালো নয়, পোকা ধরে যায়।
স্থানীয় থানা, নেতা-টেতাদের ধরে-টরে কোনোরকমে অনুষ্ঠান করার অনুমতি পাওয়া
গেল। আয়োজনে মেজোমেসো কমতি রাখতে চান না। শ-দুই লোকের আয়োজন করলেন।
আসলে আত্মীয়-স্বজনেরা শেকড়-বাকড়ের মতো যেভাবে ছড়িয়ে আছে তাতে কাকে
নেন আর কাকেই বা বাদ দেন। মহামারির সময়ে সবাই যখন চুপসে এতটুকু, তার মধ্যে
কাঁড়ি-কাঁড়ি খরচ করে এমন হইহই ব্যাপার নিন্দনীয় ও ঈর্ষণীয় বটে। যাই হোক,
অনেকের মতো মেজোমেসো হয়তো ভাবেন মহামারি যখন লেগেছে, কখন ফট করে ফুটে
যাব, তার আগে সাধ-আহ্লাদ মিটিয়ে নেওয়া ভালো।
কিন্তু বিয়েটা হচ্ছে অনেক দূরে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বন্ধ, সাহস করে প্রাইভেট
গাড়িগুলো কেউ রাস্তায় নামাতে চাইছে না। তারপরে দুশো লোকের গ্যাদারিং। এ-এক
ফ্যাসাদ। বর এবং বরযাত্রীর গাড়ি পেতে মেজোমেসোর ঘাম ছুটে গেল। হঠাৎ
জগাদার মাথায় বুদ্ধিটা এল। জগাদা ঝন্টুদার পরের ভাই। ঝন্টুদার হলেই জগাদার
চান্স! তাই তার উৎসাহ সবচেয়ে বেশি। সে বলল, ‘নামখানা স্টেশনে তো গোটাচারেক
লোকাল ট্রেন মাসখানেক ধরে পড়ে পড়ে জং খাচ্ছে। বলে কয়ে একটা ম্যানেজ করলেই
কেল্লাফতে! একটু ধুয়েমুছে ফুল-টুল দিয়ে সাজিয়ে নিলেই হল।


শুনে তো আমাদের চোয়াল ঝুলে হাঁ। বিয়েবাড়িতে লোকাল ট্রেন ভাড়া হবে বর,
বরযাত্রীর জন্য! প্রস্তাবটা পেড়ে জগাদার কিন্তু একবারও মনে হল না যে সে
ননসেন্স জাতীয় কিছু বলেছে। বরং ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হবে বলেই তার
বিশ্বাস। শুধু যে বলেই খালাস তেমন লোকও নয় জগাদা। সে বলল, ‘ওসব পারমিশন
টারমিশনের চিন্তা করতে হবে না, ও আমি করিয়ে নেব। এমনিতে বিয়ের আয়োজন
কিভাবে হবে তা নিয়ে মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়, তার মধ্যে আবার জগার
যত্তসব..! মেজোমেসো চটে কাঁই। হাতের কাছে কিছু না- পেয়ে পায়ের চটি খুলে
জগাদার দিকে রে-রে করে তেড়ে এলেন। মশকরা হচ্ছে! যত্তসব বুজরুকি।
জগাদা কিন্তু সেসব গায়ে মাখল না, বরং দ্বিগুণ উৎসাহ আর চ্যালেঞ্জ নিয়ে
কাজে লেগে গেল। আমাদের মতো দুটো হাতের বদলে ওর নাকি অনেক জায়গায় অনেক
‘হাত’ আছে। জগাদা দেখিয়েও দিল ওর বাঁয় হাত কা খেল। একদিনের জন্য
লোকালট্রেন ভাড়া নেওয়ার অফিসিয়াল এগ্রিমেন্ট এনে সক্কলের সামনে মেলে
ধরল। মেজোমেসো এবারটায় পায়ের চটি খুললেন না বটে, গালে কষিয়ে একটা চড়
বসালেন। নিজের গালে। জগাটাকে এত যা তা ভাবা কি তার উচিত হচ্ছিল!
কিন্তু সমস্যা একটা ছিল, যেটা জগাদার মাথায় প্রথমে আসেনি। রেলওয়ে
একদিনের জন্য শুধুমাত্র ট্রেনটা ভাড়ায় দিয়েছে। কোনো লোকোপাইলট তারা দেবে
না। লোকাল ট্রেন পরিষেবা তখনও পুরোপুরি চালু হয়নি, লোকোপাইলটের অনেকেই

 

ছুটিতে। এই মহামারির সময় বিয়েবাড়িতে ভাড়া খাটার কোনো সুপ্ত বাসনা তাদের মনে
নেই। শেষপর্যন্ত আমাদের পাড়ার নকুলদাকে পাওয়া গেল। জীবনে কি চালায়নি
নকুলদা! সাইকেল বাইক, রিক্সা, অটো, টোটো, ম্যাটাডো, লরি, ট্রলার,.. সংসার, এক
ওই ট্রেন ছাড়া। এবং নকুলদার বিশ্বাস ট্রেন চালানোটা তেমন কোনো কঠিন ব্যাপার
নয়। লরি চালানোর চেয়ে ঢের সহজ। শুধু মোটর অন-অফ, ট্রেনের স্পিড বাড়ানো-
কমানো। লাইনে লাইনে ট্রেন চলবে, আর পাঁচটা গাড়ি কাটিয়ে কাটিয়ে যাওয়ার ব্যাপার
নেই, ট্রাফিক নেই, ট্রাফিক পুলিশ নেই, রাস্তার ওপর দোকানপাট, চ্যাংড়া বাইক
চালকের বেলেল্লাপনা নেই। লাইন ক্রসিং-ট্রসিং কোথাও থাকলে সেসব
ইলেকট্রনিক রুট রিলে কন্ট্রোল কেবিন থেকে হয়ে যায়। রেলের চাকা লাইনের বাঁকে
বাঁকে ঠিক বেঁকে যায়, স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে কাটাতে হয় না। ও-জিনিস চালানো ঢের সহজ।
দিনের দিন নকুলদা লোকোপাইলটের চেয়ারে বসল। বর মানে ঝন্টুদা সহ দুশো
বরযাত্রী সবাই লোকাল ট্রেনের বারোটা কামরায় হাত-পা ছড়িয়ে বসল। জগাদা
দায়িত্ব নিয়ে গোটা ট্রেনটাকে ফুল-টুল দিয়ে বেশ সাজিয়ে এলাহি ব্যাপার করেছে।
আমি একেবারে সামনে লোকোপাইলট নকুলদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হর্ন দিতে দিতে
নকুলদা মোটরের স্পিড বাড়াতে লাগল। ট্রেনের চাকা গড়াতে ওঁর মুখটা উজ্জ্বল হয়ে
উঠল। সে আমার দিকে ভ্রূ নাচিয়ে মুচকি হাসল। আমিও ভেতরে ভেতরে বেশ একটা
উত্তেজনা অনুভব করছিলাম। এতবছর ধরে লোকালট্রেনে যাতায়াত করছি,
লোকোপাইলটের কেবিনটা বাইরে থেকে দেখেছি শুধু। একটিবারের জন্য ওই কেবিনের
ভেতরে ঢোকার মনে মনে প্রবল বাসনা ছিল এতদিন। আজ সেটা পূর্ণ হল।
সবে সন্ধ্যা হয়েছে। করোনা বিধিনিষেধ অনুযায়ী এ-তল্লাটে সন্ধার পর দোকান-
পাট সব বন্ধ। বাজারের কোলাহল নেই, গাড়ি ঘোড়ার শব্দও নেই। অন্ধকার চিরে
আমাদের ট্রেন ছুটে চলেছে এক্সপ্রেসের মতো। কোথাও থামাথামি নেই। নকুলদা
থেকে থেকে হর্ণ দিচ্ছে। বলে, ‘সবাই জানে ট্রেন বন্ধ, তাই লাইনের ওপর গামছা
পেতে কে হয়তো নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতে পারে, জলপানের আসর বসতে পারে। তাদের
অ্যালার্ট করে দিচ্ছি আর কি’ ।


নকুলদার ট্রেন চালানোর কায়দা মনে মনে তারিফ করার মতো। একেবারে পাকা
লোকোপাইলটের মতো। ট্রেন চালানো তবে এত সহজ? চাইলে আমিও নকুলদার থেকে
শিখে নিতে পারি! আমি শেখানোর জন্য ওকে সাধাসাধি করলাম। ও বলে কিনা আগে
ট্রেনের হর্ণ বাজানোটা শেখ, তারপর ট্রেন চালানো শিখবি। ওই যে একটু আপ
স্কেলে, একটু ডাউন স্কেলে, একটানা অথচ যেন একটু থেমে থেমে। আমি হর্নের নচ
চেপে ব্যাপারটা একটু আয়ত্ত করতে চেষ্টা করছি, কিন্তু কিছুতেই যেন সেই
ব্যাপারটা আনতে পারছি না। আপ ডাউনের বদলে হর্ণ একটানা শুধু পোঁ-পোঁ বেজে
উঠছে...।
...একটানা ট্রেনের হর্ণের শব্দে ঘুমটা ভাঙল। লোকাল ট্রেন চালু হয়ে গেছে
এতদিনে। কিন্তু লকডাউনে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সিগন্যাল অপারেটরদের আলস্য চেপে
গেছে। ভোরের প্রথম ট্রেন এসে সিগন্যাল না-পেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সিগন্যালম্যান
দিব্যি নাক ডেকে ঘুম দেয়। স্বপ্নে ট্রেন চালানোটা সবে শিখছিলাম নকুলদার কাছে।
শিখে নিতে পারলে হয়তো একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আমার জন্য অপেক্ষা করছিল।
কিন্তু সেটা এদের জ্বালায় এ-যাত্রায় আর হয়ে উঠল না। তবে একটু সুযোগ পেলেই

আমি পাকা লোকোপাইলট হয়ে দেখিয়ে দিতে পারি। ট্রেন চালানো ঢের সহজ, নকুলদা
তো তেমনই বলে।

Comments :0

Login to leave a comment