মৃত্যুর আগে ফেসবুকের পোস্ট ঘিরে চাঞ্চল্য
নিজস্ব সংবাদদাতা: কৃষ্ণনগর, ১৭অক্টোবর— দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ ও নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় সামনে এল আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকে জানিয়েছেন, ‘প্রাইমারি অ্যান্টি-মর্টেম বার্ন পাওয়া গেছে। যা পেয়েছি অ্যান্টি-মর্টেম বার্নই পেয়েছি। অ্যাসিডের কোনও প্রমাণ আমরা পাইনি। কিছু কেমিক্যাল টেস্ট বাকি আছে।''
‘অ্যান্টি-মর্টেম বার্ন’- অর্থাৎ মৃত্যুর আগে পোড়ানো হয়েছে। পুড়িয়ে মারা হয়েছে। অর্থাৎ খুন করা হয়েছে নৃশংসভাবে দ্বাদশ শ্রেণির ওই ছাত্রীকে। ঘটনার পরেই সুকৌশলে একটি মহল থেকে আত্মহত্যার তত্ত্ব নামানো হয়েছিল। এমনকি, ওই ছাত্রীর ফেসবুকের একটি পোস্ট উল্লেখ করেছিল পুলিশ, যাতে মনে হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়ার কথা জানিয়েছে সে। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে প্রোফাইলে, ‘..মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়, সকলে ভালো থেকো’’ বলে পোস্ট দেওয়া হয়েছিল। এখন প্রশ্ন, তাহলে এই বার্তা কে পাঠালো? স্বাভাবিকভাবেই এ ধারণা স্পষ্ট হচ্ছে, গোটা ঘটনার সাথে শুধু একজন নয় আরও অনেকে যুক্ত। জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় লাগোয় পাড়ার দুর্গা পুজোর মণ্ডপের মধ্যে অর্ধনগ্ন ও পোড়া অবস্থায় যেভাবে রাতের অন্ধকারে খুন করে দেহ ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল, তার থেকে স্পষ্ট ঘটনাস্থলও সেটিও নয়। ঘটনাপ্রবাহেই স্পষ্ট এটি পূর্বপরিকল্পিত।
নদীয়া চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ অনুযায়ী এদিন ময়নাতদন্ত হয়। মৃতার দেহ কৃষ্ণনগর শক্তিনগর জেলা হাসপাতালে সংরক্ষিত রাখা ছিল। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা নাগাদ কড়া পুলিশি নিরাপত্তায় দেহ জেলা শক্তিনগর হাসপাতাল থেকে কল্যাণীর উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। দুপুর ১টা ১০ মিনিট নাগাদ কল্যাণী হাসপাতালে পৌঁছায়। দুই দফায় ময়নাতদন্তের কাজ সম্পন্ন হয়। ২টা ৩০ মিনিটি নাগাদ শেষ হয় ময়নাতদন্তপর্ব। কল্যাণী আদালতে এসিজেএম সায়নী মুখার্জির উপস্থিতিতে ফরেনসিক টিমের কর্তাব্যক্তি, কর্তব্যরত দুই চিকিৎসক ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেন। এই ঘটনায় মৃতার পরিবারের পক্ষে আইনজীবী ময়নাতদন্তের দ্বিতীয় পর্বে উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন মৃতার মা, বাবা, দাদু, মাসি ও মামি। সকলের সামনেই সম্পন্ন হয়েছে ময়নাতদন্ত পর্ব। আর জি করের ঘটনার পুলিশ বাড়তি তৎপরতা দেখায় ময়নাতদন্তে।
বুধবার সকালে কৃষ্ণনগর কালেক্টরেট পুলিশ সুপার অফিস থেকে কিছু দূরেই রাস্তায় মণ্ডপের সামনে এক যুবতীর অর্ধনগ্ন, অর্ধদগ্ধ দেহ উদ্ধার হয়। মুখ সহ শরীরের সামনের দিকের অংশ পোড়া অবস্থায় ছিল। রীতিমতো শিউরে ওঠার মতো দৃশ্য। এদিকে, বুধবার মৃতার মায়ের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে রাহুল বোস নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে কৃষ্ণনগর কোতোয়ালি থানার পুলিশ। বৃহস্পতিবার তাকে কৃষ্ণনগর আদালতে পেশ করা হয়। সরকারি আইনজীবী জানান, পুলিশের পক্ষ থেকে তদন্তের স্বার্থে অভিযুক্তকে পাঁচ দিনের পুলিশ হেপাজতে নেবার আবেদন জানানো হয়। বিচারক আবেদন মঞ্জুর করেছেন। এই মামলায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ১৩৭(২)/১৭০(১)/১০৩(১)/১২৪(১)/৬১(২) তৎসহ ৩৮ ধারায় অভিযোগ দায়ের করেছে পুলিশ।
এদিন কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার সুপার এ অমরনাথ জানান, বুধবার গ্রেপ্তার করার পর অভিযুক্ত রাহুল বোসকে দফায় দফায় জেরা করেছে পুলিশ। আরও দু’জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় আনা হয়েছে। মৃতার বাড়ি এলাকা থেকে শুরু করে গোটা শহরের সমস্ত সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখছে প্রশাসন। বৃহস্পতিবার এই ঘটনার তদন্তে সিআইডি ডিআইজি’র নেতৃত্বের একটি টিম কৃষ্ণনগর এসে পৌঁছেছে।
এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার এদিন বলেন, ‘‘এই ঘটনার তদন্তে কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশ সুপার এ অমরনাথের নেতৃত্বে একটি সিট গঠন করা হয়েছে। তদন্তে রাজ্য সিআইডি’রও সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। ঘটনার নেপথ্যে সব সম্ভাব্য কারণ আমরা খতিয়ে দেখছি। সিআইডি’র সাহায্য নিচ্ছি। ফরেনসিক তদন্ত চলছে।’’ মৃতার পরিবারের সিবিআই তদন্তের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এখনো খুনের কারণ স্পষ্ট নয়, তদন্ত চলছে। পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট না পেলে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ কী সে সম্পর্কে কিছু বলা সম্ভব নয় এখনই। বাবা-মা দাবি করেছেন। সেটা শুনেছি।’’ তবে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে কীনা তাও এখনই জানাতে পারেননি এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ)।
যদিও নির্যাতিতার মা বলেছেন, ‘‘পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। একজনের পক্ষে সম্ভব নাকি! রাহুলের গ্যাং মিলে এটা করেছে। আমরা সিবিআই তদন্তের দাবি জানাবো। আমার একমাত্র মেয়ে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। কী ক্ষতি করেছিল যে এভাবে খুন করে মুখ পর্যন্ত পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে?’’ কোতোয়ালি থানায় লিখিত এফআইআরে তাঁর মেয়েকে অভিযুক্ত রাহুল বোস ও তার অন্যান্য আরও অনেকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে এবং প্রমাণ লোপাটের জন্য অগ্নিসংযোগকারী কোনও দ্রব্য দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন তিনি।
এদিকে এদিনও দফায় দফায় কোতোয়ালি থানার সামনে বিক্ষোভে শামিল হয়েছে বামপন্থী ছাত্র-যুব-মহিলা সহ ব্যাপক অংশের নাগরিকরা। সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক সুমিত দে এদিন বলেন, গোটা রাজ্যজুড়েই পুলিশ প্রশাসনকে দলদাসে পরিণত করেছেন রাজ্যের খোদ মুখ্যমন্ত্রী। প্রতিটা ঘটনায় প্রশাসন ও মুখ্যমন্ত্রীর আচরণে উৎসাহিত হচ্ছে অপরাধীরাই। গরিব পরিবারের একমাত্র কন্যার এমন পরিণতি মানা যায় না। শেষ পর্যন্ত আমরা পরিবারের পাশে থাকব। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি শুভঙ্কর সরকার আগামী ১৯ অক্টোবর রাজ্যের প্রত্যেকটা থানার সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেছেন।
কল্যাণী জওহরলাল নেহরু মেমোরিয়াল হাসপাতালে এদিন সকাল থেকেই বাম ছাত্র-যুব-মহিলা সহ কল্যাণীর নাগরিকরা বিক্ষোভে শামিল হন। কংগ্রেস নেতাকর্মী, সমর্থকরাও সেখানে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ দেখান। ছিল পুলিশের ব্যাপক নিরাপত্তা যাতে কোনভাবেই কেউ ভেতরে ঢুকতে না পারে। আর এই নিরাপত্তার দায়িত্বে সিভিক ভলান্টিয়ারদের উপস্থিতি দেখে প্রতিবাদে গর্জে ওঠে মানুষজন। মানুষের মেজাজ বুঝতে পেরে পুলিশ প্রশাসন সিভিক ভলান্টিয়ারদের বের করে দিতে বাধ্য হয়। হাসপাতাল থেকে মরদেহ কল্যাণীর উদ্দেশে রওনা দেওয়ার সময় থেকে কৃষ্ণনগর ফেরা পর্যন্ত মৃতার পরিবারের সাথে ছিলেন বামপন্থী নেতৃত্ব। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে ছিলেন সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য অলকেশ দাস, শান্তনু ঝা, পার্টিনেতা এসএম সাদি, সিক্তা জোয়ারদার, সিপিআই নেতা সবুজ দাস, দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, মধুসূচন্দা গুহ, কংগ্রেস নেতা দিব্যেন্দু বোস প্রমুখ। বিকালে সিপিআই(এম) কৃষ্ণনগর-১ এরিয়া কমিটির ডাকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। সোনাপট্টি মোড় থেকে শুরু হয়ে সদর হাসপাতাল তিন রাস্তার মোড়ে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
ময়নাতদন্ত শেষে কল্যাণী থেকে মরদেহ শক্তিনগর হাসপাতাল হয়ে নিয়ে আসা হয় বাসভবনে। সেখান থেকে নবদ্বীপ শ্মশান ঘাটে পৌছায়, সেখানেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
Comments :0