Santali Language Day

সাঁওতালি ভাষা দিবস স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলন প্রসঙ্গে

উত্তর সম্পাদকীয়​

পুলিন বিহারী বাস্কে
২২ ডিসেম্বর সাঁওতালি ভাষা দিবস। বিশেষ করে সাঁওতালি ভাষা ভাষী আদিবাসী মানুষের কাছে অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদার দিন। যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে এই দিনটি পালন করা হয়। কারণ ২২ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে ভারতীয় সংবিধানে সাঁওতালি ভাষা অষ্টম তফসিল এ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্য বহু পুরানো। প্রায় ১০- ১৫ হাজার বছর আগে থেকে ভাষা ব্যবহার করা হতো আদিবাসী গোষ্ঠী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে। এই ভাষা বহু প্রাচীন ও সমৃদ্ধিশালী। ব্রিটিশ শাসনকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু করার সময়কাল থেকে যখন বনাঞ্চল এলাকায় রাজস্ব বৃদ্ধির বাসনার ফলে আদিবাসী ওপর শোষণ বঞ্চনা ক্রমাগত বাড়তে লাগলো। কিন্তু সমস্যা হলো ভাষা ও সংস্কৃতির। তখন থেকেই খ্রিস্টান মিশনারি বনাঞ্চল এলাকায় আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় তাদের প্রভাব ও প্রসারের লক্ষ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মিশন গড়ে তোলার ছিল। সেই সময় কালে কয়েকজন মিশনারি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে যেমন ফিলিপস, ক্যাম্পবেল, স্ক্রফরুড ও বোডিং।
২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী প্রায় ৬৫ লাখ আদিবাসী মানুষ সাঁওতালি ভাষা ব্যবহার করেন। ভারতবর্ষে বিভিন্ন রাজ্যে আদিবাসী মানুষ যারা সাঁওতালি ভাষা প্রচলিত তাঁদের বসবাস ঝাড়খণ্ড,ওডিশা, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ ।
ভাষা দিবসের পাশাপাশি আমরা ২২ ডিসেম্বর হাসা ( জল, বন ও জমিন) দিবসও পালন করি। কারণ ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর সাঁওতাল বিদ্রোহের (হুল ) পর আমরা সাঁওতাল পরগনা নামে একটি পৃথক জেলা পেয়েছি। যার মধ্যে রয়েছে বিহারের ভাগলপুর, বীরভূমের কিছু অংশ এবং বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যে সান্তাল পরগনা অবস্থিত। কারণ হুল বিদ্রোহ ছিল মূলত, জল, বন ও জমির জন্য। যার কারণে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ২২ শেষ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সাঁওতাল পরগনাকে একটি পৃথক জেলা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। তাই ২২ ডিসেম্বর হাসা দিবস হিসাবেও পালিত হয়।
আমাদের সাঁওতালি ভাষাকে সংবিধানের অষ্টম তফসিল কোনও দরদ, দান বা ভিক্ষা দিয়ে কিউ দেয়নি। আমাদের বীর জনগণ দীর্ঘকাল সংগ্রাম করে জীবন উৎসর্গ করে এই স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে।
আদিবাসীরা ভারতের আদি বাসিন্দা। তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি সুপ্রাচীন। আদিবাসীরা হড় সেই জন্য হড় ব্রড় মানে ভাষা।
প্রথমে আদিবাসী মানুষ তেগাদ এলাকায় ছিল তাদের ভাষা খের ওয়াল ভাষা ও বলা হয়। বহিরাগত আক্রমণের কারণ এ, খের ও য়াল গোষ্ঠী ভেঙে যায়, যার মধ্যে মুণ্ডা, বিরহড় মাহলে ইত্যাদি ১৩ টির বেশি জাতি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এবং এই লোকেরা চাই গাড়, থেকে চম্পা গাড় অর্থাৎ বিহার জেলার দিকে শুরু করে সেখানে এক অংশকে সাঁওতাল বলা শুরু হয়। তাই আজ ও বেশির ভাগ সাঁওতাল ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারে রয়েছে।
ভারতের মানুষ সাঁওতালি ভাষা এবং জল, বন ও ভূমির পরিচয় পেয়েছি ১৮৫৫ সালের ৩০ জুনের সর্বপ্রথম বিদ্রোহের মাধ্যমে ৷ ১৯২৫ সালে গুরুগমকে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু অলচিকি হরফ সৃষ্টি করেছেন। বামফ্রন্ট সরকার, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার হুড়া থানার অন্তর্গত কেনবনা ডাহিতে লাখো লাখো মানুষের সমাগমের মধ্যে দিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সাঁওতালি ভাষা এবং লিপিকে নীতিগত ভাবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭৯ সালে, পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুকে স্মারক দিয়ে যে সম্মানে ভূষিত করেন।
ওডিশা, ময়ূরভঞ্চ জেলার সোনারাম সোরেন প্রথম সাঁওতালি ভাষার স্বীকৃতি জন্য আওয়াজ তোলেন। যাকে আমরা ভঞ্চ বীর বায়ার এবং ভুরকা ইপিল নামে চিনি। তিনি ছিলেন প্রথম আদিবাসী আইনজীবী প্রথম মন্ত্রী এবং চার বারের বিধায়ক। আদিবাসীদের ভাষা, শিক্ষা সংস্কৃতি ইত্যাদির জন্য তিনি জীবদ্দশায় অনেক সংগ্রাম করেছেন। সংবিধানের অষ্টম তফসিলে সাঁওতালি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সংগ্রাম মূলত ৩০ জুন ১৯৮০ সালে দিল্লি চলো অভিযানের মাধ্যমে শুরু হয়েছিল সালখান মুর্মুর নেতৃত্বে এই অভিযানে এক লাখের বেশি আদিবাসী অংশ নিয়েছিল। সেই সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন নীলম সঞ্জীব রেড্ডি যাকে আদিবাসীরা তাদের দাবিপত্র জমা দিয়েছিল। এরপর আদিবাসীরা তাদের আন্দোলন অব্যাহত রাখে। কিন্তু সিপিআই(এম) সাংসদ রাই প্রথম ২০ আগস্ট ১৯৯২ সালে লোকসভায় অষ্ঠম তফসিলে সাঁওতালি ভাষা অন্তর্ভুক্ত বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। সেই সময়  সি পি আই এম সাংসদরা ছিলেন বাসুদেব আচারিয়া, রুপ চাঁদ মুর্মু, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, তাঁরা সাঁওতালি ভাষাকে অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য লোকসভায় তাদের মতামত তুলে ধরছিলেন। একই বছর ১৯৯২ সালে মণিপুরী, কোঙ্কানি এবং নেপালি ভাষাগুলিকে সংবিধানে অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হলেও সাঁওতালি ভাষা অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি। আদিবাসীরা সংগ্রাম চালিয়ে যায়।
১৯৯৮-৯৯, লোকসভা নির্বাচনে, সিপিআই (এম) পার্টি আবার তার ইশ্‌তেহার এবং নির্বাচনী প্রচারে অষ্টম তফসিলে সাঁওতালি ভাষা অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি উত্থাপন করেছিল। যা আগুনে জ্বালানি যোগ করেছে।
১৯৯৮ সালের ৫ জুলাই, আদিবাসী রা পার্সি সাগদ (ভাষা রথ) নামে একটি রথ শুরু করে যা ঝাড়খণ্ড থেকে বিহার, ওডিশা, আসাম পশ্চিম বঙ্গ ইত্যাদিতে শুরু হয়েছিল, যা জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে ছিল যা আরও গতি দেয় আন্দোলনে ।
সংবিধানের অষ্টম তফসিলে সাঁওতালি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাম, ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ কলকাতা চলো অভিযান, নভেম্বর ২০০০ ঝাড়খণ্ড অন্তর্ভুক্তি, ডিসেম্বর ২০০০ পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড ওডিশা ১২ ঘণ্টার রেল অবরোধ, আগস্ট ২০০২ সালে পুরুলিয়া জেলায় ১১৬ টি গ্রামে প্রায় ১০,০০০ আদিবাসী মানুষ, ২৫ কি মি পদযাত্রা করলেন। ২০০৩ সালে দিল্লি অভিযান করা হলো। ২০০৩ সালে পার্লামেন্টে সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া, সাংসদ ডাঃ রামচন্দ্র ডোম পার্লামেন্টে উত্থাপন করেন, সাংসদ সন্ধ্যা বাউরি সমর্থন করেন। সাংসদ রুপচাঁদ মুর্মু ও তৎকালীন মন্ত্রী উপেন কিস্কুর নেতৃত্বে জোরালো আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাশ করানো হয়। তার আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  অটলবিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করেন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া, সাংসদ ডাঃ রামচন্দ্র ডোম, সাংসদ অলকেশ দাস, সাংসদ রূপ চাঁদ মুর্মু ও  সুবোধ হাঁসদা,( এসেকা সদস্য পব), দুঃখী রাম হাঁসদা ( সেক্রেটারি এসেকা পব)। এইভাবে ২০০৩ সালে ৯২ তম সংবিধান সংশোধন করে অষ্টম তফসিলে আমাদের ভাষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ।
স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পঠনপাঠন শুরু হয়। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার উভয় সরকারই সাঁওতালি ভাষা প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাতে শিক্ষক নিয়োগ ক্ষেত্রেই হোক, শিক্ষা বোর্ড গঠনের ক্ষেত্রেই হোক, এবং আলাদাভাবে বাজেট ক্ষেত্রেই হোক সদিচ্ছার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতা ২০০৯ সালে লোকসভায় সাংসদ ছিলাম কিন্তু সাঁওতালি ভাষায় বলার সুযোগ পাইনি অর্থাৎ দোভাষী ছিল না। অথচ ছয় বছর আগে সাঁওতালি ভাষা অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত হয়। মাতৃভাষা থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম। আর একটা বিষয় লক্ষ্য করে ছিলাম আদিবাসী বীর যোদ্ধা বাবা তিলকা মাঝি, সিধু, কানু ফুলো, ঝানো বা বিরসা মুণ্ডা এদের মূর্তি পার্লামেন্টে চত্বরে ছিল না। পরে কেবল বিরসা মুণ্ডার মূর্তি বানানো হয়েছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতি সমাজের পরিচয় ও দর্পণ। কেউ যদি সমাজকে ধ্বংস করতে চায় তাহলে সব চেয়ে সহজ উপায় হলো এর সাহিত্য ও ভাষা সমাজের নিজস্ব সাহিত্য, ভাষা ও সংস্কৃতি নেই সে সমাজ কখনো সংগঠিত হতে পারে না এবং অধিকার ও দাবি আদায়ের জন্য লড়াই করতে ও সক্ষম হয় না। যার কারণে সেই সমাজকেই সব চেয়ে বেশি নৃশংসতার শিকার হতে হয়।

Comments :0

Login to leave a comment