শুভজিৎ সরকার
ছাত্রসমাজের বড় প্রশ্ন, কবে হবে ছাত্র ভোট?
উত্তর নেই সরকারের! উত্তর নেই কারণ তারা ভোটটা করাতে চায় না।
২০১৭ সালের পরে রাজ্যে দুটো পঞ্চায়েত নির্বাচন, দুটো লোকসভা নির্বাচন, একটা বিধানসভা নির্বাচন এবং আরও একাধিক উপনির্বাচন, পৌরসভার নির্বাচন হয়েছে,আরও আনেক ভোটের মধ্যে দিয়েও গেছে বাংলার মানুষ। শুধু ছাত্র ভোটটাই হচ্ছে না !
২০১৮ সালে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়া ছাত্রের গ্র্যাজুয়েশন করে মাস্টার্স পাশ করে যাওয়ার পরও সে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ দেখেনি। রাজ্য সরকারের মনোভাব স্পষ্ট, তারা ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং সামগ্রিকভাবে ছাত্র রাজনীতিটাকেই শীতঘুমে পাঠিয়ে দিয়েছে। ছাত্র মনন থেকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, পালটে দেওয়ার চিন্তা সরিয়ে আনুগত্যের এক বাতাবরণ তৈরি করাটাই এদের লক্ষ্য। ২০১১ রাজ্যে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর থেকেই শিক্ষাঙ্গনকে রাজনীতি মুক্ত করার ডাক দেন 'পরিবর্তনের সরকারের' শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। সেদিন তার উদ্যেশ্যে অনেকে না বুঝলেও পরবর্তীকালে সেটা জলের মতো স্পষ্ট হয়। উনি বলতে চেয়েছিলেন শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার সাথে জড়িতরা রাজনীতি করবেনা, তাদের জায়গা হয়ত নেবে অন্যরা, এবং সেটাই হয়েছে, এলাকার তৃণমূলের কাউন্সিলর, ওয়ার্ড সভাপতি, ব্লক সভাপতিরা তাদের সাঙ্গোপাঙ্গদের দিয়ে কলেজের নিয়ন্ত্রণ রেখেছে। নির্বাচন হয়নি কিন্তু অবৈধভাবে ইউনিয়ন রুমগুলো খোলা এবং সেগুলো তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। কলেজের অভ্যন্তরে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পতাকা ছাড়া অন্য পতাকা রাখা যাবে না, তৃণমূল ছাত্র পরিষদ নয় বরং বলা উচিত একেবারে তৃণমূল কংগ্রেসের দলীয় রাজনীতির পীঠস্থান হয়ে উঠেছে কলেজগুলো।
কলেজে কনট্র্যাকচুয়াল স্টাফ হিসাবে নিয়োগ করা হচ্ছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতাদের, অনেক জায়গায় ক্যান্টিন, ফটো কপি সেন্টার খুলে ব্যবসা করছে কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতা বা স্থানীয় তৃণমূলের নেতারা। কিছু লোক দেখানো টেন্ডার হয়েছে তবে এমনভাবে করা হয়েছে যে নির্দিষ্ট সেই ব্যক্তিই যাতে কাজটা পায়। স্থায়ী পদে নিয়োগ করছেনা রাজ্য সরকার কারণ স্থায়ী কাজ পেলে এরা কেউ তৃণমূলের দলীয় কাজে থাকবে না। কারণ পুরোটাই একটা ব্যবসা।
একদিকে তৃণমূলের ঝান্ডাধরা বাহিনী আরেকদিকে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের গণতান্ত্রিক অধিকার, মুক্তচিন্তার কথা বলার যে অধিকার। এই মেরুকরণের রাজনৈতিক লড়াই হলে স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পাসের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী ভারতের ফেডারেশনের পক্ষ নেবে এই অনুমান থেকেই ক্যাম্পাসগুলোতে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন বন্ধ। বহিরাগতদের যাতায়াত এবং এমন এক মৌরসিপাট্টা চলছে বছর বছর যা ভাঙার চেষ্টা করতে গিয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে যারা শিরদাঁড়া সোজা রেখে কথা বলার চেষ্টা করেছে। তাতে থেমে যায়নি সবকিছু। এখন রাজ্যের অনেক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েই গণতন্ত্রের আওয়াজ আস্তে হলেও উঠছে।
তৃণমূল সরকার ছাত্র রাজনীতি বিষয়টাকেই একেবারে তুলে দিতে চেয়েছিল। ছাত্র রাজনীতি মানে তৃণমূলের বকে যাওয়া নেতার পয়সা তোলার কারবার এই এক মনোভাব তৈরি করতে চেয়েছিল প্রথম থেকেই। এই পরিস্থিতি তৈরি হলে সামগ্রিক রাজনীতি নিয়ে ছাত্র বা কমবয়সি মনে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। বাম আমলে বা তার আগে যেটা ভাবা যেত না। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির এই নিজের চাওয়ার খেসারত দিতে হচ্ছে আজকের প্রজন্মকে। এরা যখন কলেজের গেটে পৌঁছালো স্কুলের বৈতরণী পার করে তখন রাজ্যে তৃণমূলের সরকার, বিশেষ করে যারা ১৯৯০-এর মাঝের বা শেষের দিকে জন্মগ্রহণ করেছে। যখন এরা কলেজে ঢুকছে স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি বিষয়টাই অবলুপ্ত হওয়ার দিকে এগচ্ছে সেই সময়।
এখন ছাত্র সংসদের অফিসে তৃণমূলের পাড়ার নেতা কলেজের কিছু ছাত্র আর একাধিক প্রাক্তন ছাত্রদের নিয়ে তাস খেলে। অনেক জায়গায় ইউনিয়ন রুমে সাধারণ ছাত্রদের ডাকও দেয় এই বহিরাগতরা এবং তাদের বেশি ডাকে যাদের মধ্যে প্রতিবাদী সত্তা রয়েছে। ব্যতিক্রম কিছু শিক্ষাঙ্গন অবশ্যই রয়েছে, যেমন প্রেসিডেন্সি এবং যাদবপুর। যেখানে ক্যাম্পাসের ইউনিয়নে এসএফআই পরিচালিত ইউনিয়ন চলেছে এই স্বৈরাচারী সরকারের আমলেও। ২০১৯-এর নভেম্বর এবং ২০২০-এর ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করায় রাজ্য সরকার এই রাজ্যে ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রেসিডেন্সিতে জয়ী হয় এসএফআই, যাদবপুরের আর্টসে জয়ী এসএফআই, যাদবপুরের সাইন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে জয়ী হয় স্বাধীন মঞ্চ। তৃণমূল জয়ী হয় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়তে, যদিও বিরোধী সংগঠন কাউকে নমিনেশন ফাইল করতে দেওয়া হয়নি সেখানে। প্রেসিডেন্সি এবং যাদবপুরের ইউনিয়নে গণতান্ত্রিকভাবে জয়ী হয় এসএফআই এবং স্বাধীন মঞ্চ। যাদবপুরের ইউনিয়নের নির্বাচনে তৃণমূলের প্রার্থীরা গোহারা হারে। প্রেসিডেন্সিতে তাদের সংগঠন নাই, তারা নির্দলীয় কায়দায় প্রার্থী দিলেও তাদের কোনও লাভের লাভ হয়নি। মূলত নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় এসএফআই বনাম স্বাধীন এক মঞ্চ। এই মঞ্চের বহু লোকই ক্যাম্পাস জীবনের পরে বাইরে তৃণমূল এবং বিজেপি সঙ্গে যুক্ত। তাসত্বেও বড় কথা নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্ররা ইউনিয়ন তৈরি করেছে।
এসএফআই ইউনিয়ন দখল করেছে এমন ভাষা বা ভঙ্গিমা দেখানো হয়নি বরং বারবার বলা হয়েছে সাধারণ ছাত্ররা এসএফআই-কে ইউনিয়ন চালানোর দায়িত্ব দিয়েছিল। এটাই নীতি, সাধারণ ছাত্রসমাজের সত্তাকে গুরুত্ব দেওয়া সংগঠনের ইন্টারেস্টের থেকে, এসএফআই নির্বাচনের দাবি করেছে কোভিড পরবর্তী অবস্থায় ক্যাম্পাস খোলার পর থেকেই।
গত ১৩ বছরের তৃণমূলের জমানায়, রাজ্যের বেশিরভাগ জায়গায় অনেকেই আছে যারা কলেজের সাধারণ ছাত্রদের নীতি আদর্শের কথা বলেছে বলে তার উপর অত্যাচার হয়েছে, সে থানায় গিয়ে অভিযোগ করার সময় জানতে পারে তার নামে অন্য কোনও মিথ্যা কেস সাজিয়েছে তৃণমূলের নেতা বা তার বাহিনী। কেউ কেউ আবার একটু অন্যরকমের তারা আবার এরকম বামপন্থী বা অন্য মনোভাবের ছাত্রকে ডেকে বলে ভাই/বোন 'তুই যা ইচ্ছা কর, তোর রাজনীতিটা কিন্তু এই কলেজে করিসনা, কলেজের বাইরে তোর যা ইচ্ছা কর। সবই তো বুঝিস উপর মহলে আমাদের দেখাতে হয় যে বিরোধী কেউ নেই!
এই যে মনোভাব, তৃণমূলের সর্বগ্রাসী এই মনোভাব ওদের উপর থেকেই আসে। গণতন্ত্র বিষয়টা ধ্বংস করতে চায় বিভিন্ন কায়দায়। তৃণমূলের সর্বময় নেত্রীর কাছে এই ইউনিয়নগুলোর রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকলে এরকম এবং এতটা অগণতান্ত্রিক ভাবনা থাকতো না। কিন্তু এদের কাছে কলেজের/ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়ন আসলে টাকা তোলার মেশিন। কোন জায়গা বাদ পড়লে ওদের বুক ধড়পড় করে।
ক্ষমতায় আসার আগে দলতন্ত্রের অভিযোগ করা তৃণমূল নেত্রী আজ গোটা সমাজে দলতন্ত্রের বীজ রোপণ করেছেন। রাজ্যের শাসক দলের নেতারা বিভিন্ন এলাকার নিজেদের জমিদারি পরিণত করেছেন। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নেতারা কলেজে কলেজে আজ যে ভাবধারাকে বিকশিত করছে, প্রগতিশীল কথাটা পতাকায় লিখলেই যে প্রগতিশীল হওয়া যায়না তার নিদর্শন তৃণমূলের নেতারা। আসলে রাজনীতি মানে রাজার নীতি নয়, রাজনীতি মানে নীতি দিয়ে রাজ এবং প্রগতিশীল সমাজ মানে ধীরে ধীরে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির শেষ হওয়া এবং গণতন্ত্রের প্রসার। ব্যক্তির থেকে গোষ্ঠীর গুরুত্ব, কিন্তু বর্তমান শাসক দল ব্যক্তি এবং আরও ভয়ানক যে একুশ শতকের এক নতুন পরিবারতন্ত্রের রাজনীতির জন্ম দিয়েছে। এর ভয়াবহতা মারাত্মক। একেবারে প্রান্তিক মানুষের মধ্যে যেই ভাবনা গণতন্ত্র তৈরি করে, 'রাজা কা বেটা রাজা নেহি বনেগা, জো হাকদার হে ও রাজা বনেগা' (রাজার ছেলে রাজা হবে না, যে যোগ্য সেই রাজা হবে, সহজ ভাষায় যে ক্ষমতায় আসার যোগ্য সেই ক্ষমতায় বসবে), এই ভাবনাকে সরিয়ে 'রাজাকা বেটা রাজা বনেগা' (রাজার ছেলেই রাজা হবে) এই রাজনীতিকেই গুরুত্ব দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। এর জন্য সামগ্রিকভাবে সমাজের বিরাট ক্ষতি হচ্ছে।
ছাত্র রাজনীতির বিকাশ না ঘটলে দেশের রাজনীতির সাথে যারা যুক্ত হবে তারা তাদের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্যই রাজনীতিতে আসাটা কারণ হিসাবে বেছে নেবে।। নীতি, আদর্শের লড়াই হবেনা, টাকার খেলা হবে। যা এখন ঘটে চলেছে। সমাজের অন্ধকার জগতের মানুষের রাজনীতিতে প্রভাব বাড়বে, যেই কারণে নতুন আলোর সন্ধান পাওয়াটা এক কঠিন কাজ হবেই। হায়দরাবাদ, জেএনইউ থেকে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কোভিড পরবর্তী পরিস্থিতে সব স্বাভাবিক হওয়ার পর নির্বাচন হয়েছে। ছাত্র মননে রাজনীতির বার্তা পৌঁছেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ঠিক যেমন ওখানকার নিত্য দাবি নিয়ে আন্দোলন হয়েছে একই কায়দায় বাইরের সমাজের সমস্যার বিরুদ্ধে পথে নেমেছে ক্যাম্পাসগুলোর ছাত্র সমাজ। ছাত্রদের দাবি দেশের লোকসভা নির্বাচনের ইস্যু হয়েছে। বাংলার মাটিতে এসএফআই পরিচালিত যেই ছাত্র সংসদগুলো ছিল তারাও বৃহৎ সমাজের আঙ্গিকে ছাত্র সমাজকে ভাবানোর চেষ্টা করেছে তবে নির্বাচন না হলে এই রাজনৈতিক পরিধির গুরুত্ব থাকবে না। কারণ ছাত্র নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই তো শাণিত হওয়া, সমাজের সব কিছু সাথে একাত্ম হওয়ার প্রক্রিয়া যুক্ত।
অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দরকার, এটা সামাজিক এক দাবি, শিক্ষাঙ্গনের গণতন্ত্রের পক্ষে থাকার দাবি এবং সর্বোপরি বর্তমান পরিস্থিতি দেখিয়েছে ডিগ্রি কলেজ থেকে মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের হত্যা হয়েছে বলেই নৈরাজ্যের আবহাওয়া এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। চলমান ডাক্তারদের আন্দোলনের মধ্যেও এই ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসির প্রশ্ন উঠেছে, থ্রেট কালচার এবং কলেজের ভিতরে এক গোষ্ঠীর একাধিপত্য - সমগ্রটাই আসলে ক্যাম্পাসের মধ্যে ছাত্র সমাজের গণতান্ত্রিক পরিসরের দাবি এটাই উঠে এসেছে।
ছাত্র রাজনীতির সাথে একজন ছাত্রের সামাজিক বিকাশ ঘটার প্রক্রিয়া যুক্ত। ছাত্র রাজনীতির পাঠ তাকে জীবনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, জীবনের অনেক লড়াইয়ের জন্য তৈরি করে দেয়। ছাত্র রাজনীতির মধ্যে দিয়ে মূল রাজনীতিতে বিকশিত হওয়া মানে আবার এই নয় যে ছাত্র সমাজ তাদের নিজেদের দাবি এবং ছাত্রসত্তা ভুলে প্রাথমিক কাজ হিসেবে ক্যাম্পাসের বাইরের প্রসঙ্গকে প্রাথমিক কাজ না ভাবে। ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্র ক্যাম্পাস আর ক্যাম্পাসের দাবিই ছাত্র আন্দোলনের কর্মীর প্রাথমিক কাজ। তবে ছাত্র সমাজের দাবি ছিনিয়ে আনাটাই প্রথম কিন্তু শেষ কাজ নয়।
Comments :0