অর্ধেন্দু সেন
আর জি কর হাসপাতালে আগস্ট মাসের নয় তারিখে এক কর্তব্যরত ডাক্তারকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। কলকাতা শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে এই নির্মম ঘটনা কলকাতাবাসীকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। একমাস ধরে প্রত্যেকদিন হাজার হাজার মানুষ বিশেষ করে মহিলারা রাস্তায় নেমে ক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ক্রমে এই আন্দোলন কলকাতা ছাড়িয়ে গোটা রাজ্যে গোটা দেশে এমনকি বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। আন্দোলনকারীদের হাতে বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড দেখা গেলেও সহজেই বোঝা যায় আপাতত মানুষ বিচার চাইছেন। চাইছেন এই ঘটনায় দোষীদের দ্রুত চিহ্নিত করে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক। আন্দোলন যাতে এই লক্ষ্যে স্থির থাকে তাই রাজনৈতিক দলগুলিকে এর বাইরে রাখা হয়। দলীয় পতাকা হাতে একজনকেও মিছিলে দেখা যায় না। এ এক অভূতপূর্ব আন্দোলন। এমনটা এ শহর আগে দেখেনি। মেয়েদের রাত দখলের ডাকে সাড়া দিয়ে মহিলারা ১৪ আগস্টের রাতটা রাজ্যের প্রায় ২০০ টি জায়গায় জমায়েত করে কাটিয়ে দিলেন। এর পরে আর মহিলাদের নাইট ডিউটি থেকে অব্যাহতি দেবার কথা শোনা যায়নি।
মাননীয় উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে খুব দ্রুত হস্তক্ষেপ করেন। আদালতের মনোভাব দেখে মুখ্যমন্ত্রী বুঝতে পারেন তদন্তের ভার কলকাতা পুলিশের হাতে রাখা যাবে না। তাও চেষ্টা করেন কিছুদিন সময় পেতে। কিন্তু আদালতের নির্দেশে তার পরের দিনই তদন্ত চলে যায় সিবিআই’র হাতে। পরে অবশ্য বোঝা যায় অনেক দেরি হয়ে গেছে; বাগজোলা দিয়ে ততক্ষণে অনেক জল বয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য হলেও জানা যায় যে এই অপরাধের কথা পুলিশ বা মৃতা ডাক্তারের পরিবার জানার আগেই অধ্যক্ষ মারফত খবর চলে যায় 'নর্থ বেঙ্গল লবি'-র কাছে। একে একে লবির রথী মহারথীরা জড় হন হাসপাতালে। তখনও মৃতার দেহ রাখা আছে কোনও কর্ডন ছাড়াই। লবির সেখানে অবাধ প্রবেশ। মৃতদেহ কোনও সময়ে গেল ময়নাতদন্তে? চালান খুঁজে না পেলে তো বোঝা যাবে না! অসংখ্য জিডি এন্ট্রি করা হলো কেন? ময়নাতদন্তের পরেও অস্বাভাবিক মৃত্যুর কেস হলো কেন?
জুনিয়র ডাক্তাররা ততক্ষণে আন্দোলন শুরু করেছে অধ্যক্ষকে অপসারণের দাবিতে। চাপে পড়ে অধ্যক্ষ পদত্যাগ করেছেন। কিমাশ্চর্যম! সরকার তাঁর পদত্যাগ গ্রহণ না করে তাঁকে অন্য এক কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত করে! কতটা দুর্নীতি থাকলে একজন সরকারি চাকুরে এতটা প্রভাবশালী হতে পারে? জানতে পেরে আদালত প্রায় ধরে বেঁধে তাঁকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেন। দু’দিন পরে সিবিআই তাঁকে গ্রেপ্তার করে তছরুপের অভিযোগে।
অনেকে বলছেন উনি মুলকাণ্ডে গ্রেপ্তার হলে ভাল হতো। অতোটা না হলেও চলবে। উনি জেল থেকে বেরলে ওনাকে সাদা গোলাপের মালা দিয়ে বরণ করা না হলেই যথেষ্ট।
এরপর আমরা দেখলাম মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ বিষয়ে মামলা রুজু করলেন। প্রথম শুনানিতে দেখা গেল আদালত ডাক্তারদের সুরক্ষার ব্যাপারটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। আদালতের নির্দেশে আর জি কর হাসপাতালের সুরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করল সিআইএসএফ। এরা দেশজুড়ে এয়ারপোর্টের সুরক্ষা দেখেন। এদের তত্ত্বাবধানে হাসপাতাল নিশ্চয়ই নিরাপদ হবে। কিন্তু নিরাপত্তার খরচ? সেটা প্লেনের টিকিটে যোগ হলে অসুবিধা হয় না কিন্তু রুগীর টিকিটে যোগ হলে? যাক সে কথা পরে ভাবা যাবে। নিরাপত্তা তো হোক!
গতকাল ছিল দ্বিতীয় শুনানি। খানিকটা প্রত্যাশিতভাবেই আদালত ডাক্তারদের নির্দেশ দিলেন কাজে ফিরতে। উৎসবে না। কাজে। শুধুই নিরাপত্তার পরিবর্তে? ওদের যে অন্য দাবি ছিল? ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে এবং তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে অভিযুক্তদের শাস্তি। হাসপাতালে ভয়মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ। পুলিশ কমিশনারের ইস্তফা। সেগুলি নিয়ে আলোচনার পথ খোলা আছে তো? আদালত হয়তো জানেন বাংলায় একটা অলিখিত চুক্তি আছে। পুজো এসে গেলে আমরা সব দাবি দাওয়া সব আন্দোলন স্থগিত রাখি। তাই কাজে নিশ্চয়ই ওরা ফিরতেন। কিন্তু রাজ্যজুড়ে যে আন্দোলন হলো সেটা কি আদালতের চোখে পড়ল না?
আদালতের এখন সবচেয়ে বড় কাজ সিবিআই’র তদন্ত যাতে সুষ্ঠুভাবে হয় তা নিশ্চিত করা। একাজ শক্ত হবে তা নিশ্চয়ই আদালত বুঝতে পেরেছেন। আমরা জানি তদন্তের স্বার্থে সিবিআই’র স্ট্যাটাস রিপোর্ট প্রকাশ্যে আনা যায় না। কিন্তু আদালত কি মনে করেন যে তদন্তের গতিপ্রকৃতির কিছুই মানুষকে জানানো যাবে না? তাহলে তো আন্দোলনকে অপমান করা হবে। কলকাতাকে অপমান করা হবে। জাস্টিস পারদিওয়ালা তাহলে কেনই বা বললেন এরকম তদন্ত তিনি জীবনে দেখেননি? আমাদের এটুকু জানান যে ফুটেজ থেকে অভিযুক্তকে শনাক্ত করা গেছে কি না! তিনি একা ছিলেন কি না! ময়নাতদন্ত যতোটা হয়েছে তাই অপরাধের পুনর্নির্মাণের জন্য যথেষ্ট কি না! নইলে মানুষ কাজেও ফিরতে পারবে না। পুজোয়ও না।
মুখ্যমন্ত্রী প্রায়ই বলেন আন্দোলনেই তাঁর জন্ম; আন্দোলনেই তাঁর মৃত্যু হবে। এই আন্দোলনটা কিন্তু ওনার মনঃপুত হলো না। প্রথমে মোক্ষম দাওয়াই। দুষ্কৃতীরা এসে আন্দোলনের মঞ্চ ভেঙে দিল। তারপর ভাঙচুর করল হাসপাতালের ভেতরে। মুখ্যমন্ত্রী বললেন রাম ও বামের কাজ। তাহলে পুলিশ ঠেকাতে পারল না কেন? কমিশনার বললেন রিপোর্ট ছিল না। কথাটা পুলিশেরও পছন্দ নয়। তাই কৌশল বদলাল। মুখ্যমন্ত্রী বিরাট মিছিল বার করলেন। তিনিও বিচার চান। বিরোধীরা বললেন স্বাস্থ্য মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিচারপ্রার্থী। আমার বিচার তুমি করো! নির্বাচনী প্রচারে উনি ঘণ্টার ব্যবহার করে আমাদের পুলকিত করেছিলেন। এই মিছিলে কিন্তু ঘণ্টা দেখলাম না।
তারপর আবার চমক। প্রধানমন্ত্রী দশ বছরে যা পারেননি মুখ্যমন্ত্রী করে ফেললেন দু’দিনে। বিধানসভায় পাশ হলো অপরাজিতা বিল। ধর্ষণের বিচার হবে ৩০ দিনে। সাজা হবে ফাঁসি। যেকথা তিনি বললেন না তা হলো অন্য রাজ্যের দুটি বিল তিন বছর ধরে পড়ে আছে রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য। এছাড়া ফাঁসির হুকুম হলে উচ্চ আদালতের সম্মতি লাগবে। রাষ্ট্রপতির কাছে মার্সি পিটিশন হবে। তার জন্য কত সময় ধরা আছে? নির্ভয়া কেসে ফাঁসি হয়েছিল ঘটনার আট বছর পরে। আমরা হাতে কতটা সময় রাখবো?
আদালত জুনিয়র ডাক্তারদের নির্দেশ দিলেন কাজে ফিরতে। উৎসবে না। কাজে। শুধুই নিরাপত্তার পরিবর্তে? ওদের যে অন্য দাবি ছিল? ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে এবং তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে অভিযুক্তদের শাস্তি। হাসপাতালে ভয়মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ। পুলিশ কমিশনারের ইস্তফা। সেগুলি নিয়ে আলোচনার পথ খোলা আছে তো? আর রাজ্যজুড়ে যে আন্দোলন সেটা কি আদালতের চোখে পড়ল না?
(লেখক রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব)
Comments :0