AI special

ডিপ ডেকের বিরুদ্ধে লড়াই

বিশেষ বিভাগ

অবিন মিত্র

বর্তমান যুগ ইন্টারনেটের যুগ। স্পষ্ট করে বলতে গেলে এই যুগে সোশাল মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। কোনও গুরুত্বপূর্ণ খবর সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে যত দ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছায়, অন্য কোনও মাধ্যম এখনও তা করে দেখাতে পারেনি। তাই জনকল্যাণমূলক কাজের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্যও এটি একটি উৎকৃষ্ট জায়গা। কোনোরকম সত্যতা যাচাই না করেই বহু ভুয়ো খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। গুজব, সংবাদরূপ ধারণ করে দ্রুত মানুষের মুখে মুখে পৌঁছে যায়। খুব দ্রুত, সহজেই মানুষের চিন্তাধারাকে নিয়ন্ত্রণ করার এর থেকে সহজ উপায় কি ?আর এখানেই ডিপফেক টেকনোলজির জয়জয়কার।
সামাজিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করার দিকে এগচ্ছে এই প্রযুক্তি।

ডিপফেক কি ?

ডিপফেক কি জানার আগে সিন্থেটিক মিডিয়া সম্পর্কে জেনে নেওয়া জরুরি। সিন্থেটিক মিডিয়া শব্দটি কোনও ধরনের ডাটার কৃত্রিম উৎপাদন, বিকৃতিকরণ অথবা পরিবর্তন, সামগ্রিকভাবে এই সবকিছুকে বুঝাতে ব্যবহার করা হয়।

যে কোনোরকম তথ্য, যেমন লেখা, ছবি, ভিডিও’র কৃত্রিম উৎপাদন, পরিবর্তন অথবা তাকে বিকৃত করা কে বলা হয় "সিন্থেটিক প্রোডাকশন।" সাধারণত এটি করা হয় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স বা AI) ব্যবহারের মাধ্যমে। আর ডিপফেক হচ্ছে এক ধরনের সিন্থেটিক মিডিয়া। যার মাধ্যমে কোনও অডিও ক্লিপ, ছবি অথবা ভিডিওতে কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে অন্য একজন ব্যক্তির মাধ্যমে প্রতিস্থাপিত করা হয়। যেমন ধরুন, আপনি আপনার নিজের বক্তব্যের একটি ভিডিও নিলেন এবং অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের একটি হাই কোয়ালিটি ছবি (যেখানে মুখ স্পষ্ট) নিলেন, এখন এই দু'টির মিশ্রণে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভিডিও তৈরি হলো যেখানে অমিতাভ বচ্চন আপনার বলা কথাগুলো তার নিজের ভঙ্গিতে, নিজের কণ্ঠস্বরে বলছেন ! এটিই "ডিপ লার্নিং" এবং "ফেক প্রোডাকশন"এর মিশেলে তৈরি ডিপফেক, বাংলায় "নিখুঁত মিথ্যে।"


কিভাবে তৈরি হয় ডিপফেক ?

AI এর অন্যতম উপাদান মেশিন লার্নিং। এই মেশিন লার্নিং-এর একটি শাখা আছে যার নাম ডিপ লার্নিং। ডিপ লার্নিং-এর কাজ মানুষের মস্তিষ্কের আচরণ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কাজ করা।  মানুষের মস্তিষ্কে যে নিউরনের নেটওয়ার্ক আছে অনেকটা সেই ধাঁচেই কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়েছে "আর্টিফিসিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক।" এর কাজ হচ্ছে তথ্য থেকে তার চারিত্রিক উপাদান চিহ্নিত করা।
সাধারণত দু'টি, কিছু ক্ষেত্রে একাধিক বিশেষ নিউরাল নেটওয়ার্কের মধ্যে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন তথ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। তারপর শুরু হয় তাঁকে আরও নিখুঁত করার কাজ। একাধিক নেটওয়ার্ক একাধিক তথ্য, চরিত্র বিশ্লেষণ করে, ভুল চিহ্নিত এবং সম্পাদন করে, তৈরি করে সম্পূর্ণ নতুন একটি তথ্য যেখানে একাধিক উপাদান রয়েছে, যা আগে কখনো কোথাও প্রকাশ পায়নি। এভাবেই তৈরি হয় ডিপফেক ছবি, ভিডিও, অডিও সহ আরও অনেক কিছু।

সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ডিপফেক-এর প্রভাব কতটা ?

ছবি, ভিডিও’র ক্ষেত্রে ডিপফেক-এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সিংহভাগই মহিলা। বিশেষত ডিপফেক প্রযুক্তির প্রথম ব্যবহার করা হয় পর্নোগ্রাফির ক্ষেত্রে। জনপ্রিয় অভিনেত্রীদের মুখ ক্লোন করে ডিপফেক-এর মাধ্যমে তৈরি হতে থাকে অশ্লীল ছবি, ভিডিও। বহু সেলিব্রেটি পরবর্তী কালে আবিষ্কার করেছেন যে, ডিপফেকের মাধ্যমে তৈরি ভিডিও রমরমিয়ে চলছে বিভিন্ন পর্নোগ্রাফিক সাইটে। অথচ সেখানে মুখ, অভিব্যক্তি হুবহু তাঁদের হলেও, শরীর তাঁদের নয়। সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার জনপ্রিয় অভিনেত্রী রশ্মিকা মন্দনার একটি ডিপফেক ভিডিও ইন্টারনেটে ভাইরাল হবার পর থেকে নতুন করে ফের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে 'ডিপফেক'। তবে শুধু জনপ্রিয়রা নন, বহু সাধারণ মহিলাও এই ডিপফেকের শিকার হয়েছেন, সোশাল মিডিয়া থেকে ছবি সংগ্রহ করে হামেশাই চলে এই অপরাধ।

ধীরে ধীরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রতারণার উদ্যেশে প্রভাব বিস্তার করছে ডিপফেক। অতীতে ইউক্রেনের এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ডিপফেক ভিডিও তৈরি করে, ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা বলানো হয়েছিল প্রদেশের একাধিক মেয়রের সাথে। পরবর্তীতে  ফাঁস হয়েছিল যে, ভিডিও কলের ওপর দিকে একজনের মুখ ব্যবহার করে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি কথোপকথন চালিয়েছেন। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে। ভারতের আঙ্গিনায় এই ডিপফেক-এর রাজনীতিকরণ বিজেপি’র হাত ধরে। অবশ্যই তা রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য। ২০২০ সালে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি তাঁদের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী মনোজ তিওয়ারির দুটি ডিপফেক ভিডিও প্রকাশ করে। দুটোই অরবিন্দ কেজরিওয়াল এর বিরুদ্ধে ঘৃণা ভাষণ। একটি তে তিনি হরিয়ানভি ভাষায় ও অপরটিতে হিন্দিতে বক্তব্য রাখছেন। দুটি ভিডিও একই, কিন্তু ভাষা, নিখুঁত উচ্চারণ, মুখের অভিব্যক্তি আলাদা। হরিয়ানার মানুষ শুনলে মনে করতেই পারেন, মনোজ তিওয়ারি মন খুলে তাঁদের ভাষাতেই কথা বলছেন। এরকম অসংখ্য ভিডিও স্থানীয়ভাবে তৈরি হয়েছে ভারতেই, যা এলাকার রাজনৈতিক, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করেছে। সাম্প্রতিক অতীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের আগুনে ঘি ঢেলেছে ডিপফেক ভিডিও।


ডিপফেক ছবি/ভিডিও চেনার উপায় কি ?

আপাতদৃষ্টিতে ডিপফেক ছবি/ভিডিও আসলের মতই দেখতে ও শুনতে হয়। আলাদা করে বোঝা মুশকিল। তবুও খুঁটিয়ে লক্ষ্য করলে কিছু পার্থক্য, কিছু খুঁত ধরা পড়েই। 
ইন্টারনেটে বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা বর্তমানে এই প্রযুক্তির উপর কাজ করছে। একটি মিডিয়া ল্যাব প্রকাশিত একটি গবেষণা পত্র থেকে প্রাথমিকভাবে ডিপফেক চেনার কয়েকটি উপায় খুঁজে পাওয়া গেলেও তা শিরোধার্য নয়, প্রতিদিন একটু একটু করে নিজেকে আরও উন্নত করছে AI নির্ভর এই প্রযুক্তি। যদিও সাধারণভাবে ডিপফেক বুঝতে কয়েকটি বিষয়ে খুঁটিয়ে নজর দেওয়া প্রয়োজন। যেমন,

১) মুখের দিকে ভালো করে মনোযোগ দিতে হবে। হাই কোয়ালিটি ডিপফেক গুলি প্রায় সবসময়ই মুখের রূপান্তর হয়। গাল এবং কপালের দিকে লক্ষ্য করে দেখতে হবে ভালো করে, ত্বক ও মুখের ভাঁজ কি খুব মসৃণ ? ডিপফেক ছবি/ভিডিও অনেক সময় খুব অল্প মাত্রায় হলেও অসঙ্গতিপূর্ণ হয়।

২) চোখ এবং চোখের উপর নিচের এলাকাগুলো ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে। চোখের ছায়াগুলো ঠিকভাবে পড়ছে আর নড়াচড়া করছে কি না।

৩) ব্যক্তির নড়াচড়ার কারণে তার তাকানোর কোনও পরিবর্তন হলো কি ? এসব ক্ষেত্রে আলোর প্রতিফলনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে, এমন চিত্র দেখা যেতে পারে।

৪) মুখের দাড়ি কিংবা মাথার চুলের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। চুল বা দাড়ি কি কৃত্রিম মনে হচ্ছে ? ডিপফেকের কারণে অনেকসময় গোঁফ, চুল বা দাড়ি সামান্য বিকৃত হয়ে যেতে পারে।

৫) চোখের পলকের দিকে লক্ষ্য রাখুন। ভিডিওতে উপস্থিত ব্যক্তির পলক পড়ছে কি না, পড়লেও অস্বাভাবিকভাবে পড়ছে কি না।

৬) ঠোঁটের নড়াচড়া দেখতে হবে। কিছু ডিপফেক ভিডিও লিপস সিঙ্কিং-এর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে দেখতে হবে ঠোঁটের নড়াচড়া পুরো ভিডিও জুড়ে স্বাভাবিক রয়েছে কি না।

এছাড়াও বর্তমানে ইন্টারনেটে ডিপফেক ছবি, ভিডিও চেনার AI নির্ভর এপ্লিকেশন, ওয়েবসাইট রয়েছে। এগুলো সাধারণত ডিফফেক ডিটেক্ট টুল হিসাবে ব্যবহার করা হয়। Deepware Scanner,Microsoft Video Authenticator,DeepfakeProof from DuckDuckGoose, Deepfake-o-Meter প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ডিপফেক তৈরির ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি প্রতিদিন নতুন করে পারদর্শী হচ্ছে, উন্নত হচ্ছে। তাই ডিপফেক চেনার জন্য শুধুমাত্র টেকনোলজির উপর নির্ভরশীল হওয়াটা যথেষ্ট নয়। বরং এর জন্য আমাদের নিজেদের সচেতন থাকাও খুব জরুরি।

প্রযুক্তি মানবজাতির কাছে আশীর্বাদ আবার কিছু ক্ষেত্রে অভিশাপও। ইতিমধ্যে সমাজে, আমাদের দেশে ফেক নিউজ একটি জ্বলন্ত সমস্যা। সাথে যুক্ত হয়েছে ডিপফেক। ডিপফেক ডিটেকশন নিয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে। ডিপফেক যাচাইয়ের জন্য ভবিষ্যতে হয়তো AI নির্ভর আরও স্বয়ংক্রিয়  প্রযুক্তির আবিষ্কার  হবে, তবে বর্তমানে এই বিষয়ে নিজেকে সতর্ক, সচেতন ও দক্ষ করা ছাড়া বিকল্প কিছু নেই।

 

Comments :0

Login to leave a comment